দুর্দান্ত অভিনয়েও ঢাকা পড়ে না চিত্রনাট্যের খামতি
ছবি: বুলবুল
পরিচালনা: অনভিতা দত্ত
অভিনয়ে: তৃপ্তি দিমরি, অবিনাশ তিওয়ারি, রাহুল বোস, পাওলি দাম, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৩৪ মিনিট
রেটিং: ৩/৫
অবিভক্ত বাংলার এক জমিদারবাড়ি। বাড়ির ছোট্ট মেয়ে বুলবুলের বিয়ের তোড়জোড় চলছে। গাছে চড়া, পুতুল খেলা, রূপকথার জগতে বিচরণ করা, অবুঝ বুলবুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঠাকুরবাড়ির ‘বড়বউ’ করে দেওয়া হয়। বয়সে তার চেয়ে প্রায় দুই কুড়ি বছরের বড়, স্বামী ইন্দ্রনাথ ওরফে ঠাকুরমশাই, তার মানসিক ভারসাম্যহীন ভাই মহেন্দ্র ওরফে মেজঠাকুর, মহেন্দ্রর স্ত্রী বিনোদিনী এবং বুলবুলের চেয়ে বয়সে কিছুমাত্র বড়, তার খেলার সঙ্গী ছোট্ট দেওর সত্যকে নিয়ে এই বালিকা বধূর সংসার।
এই পর্যন্ত গল্পটা অনেকেরই জানা। ১৮৮১ সাল, বৃটিশ রাজত্ব। বাল্যবিবাহ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, বাংলার জমিদারবাড়ি এবং সেই বাড়ির অন্দরমহলের কাহিনী, ইঁটের খাঁজে চাপা পড়ে থাকা আর্তনাদ। তারই মাঝে অত্যাচারিত বুলবুলের শুভ শক্তি, অশুভ শক্তির অদ্ভুত বৈচিত্র্য তুলে ধরলেন অনভিতা।
প্রায় সমবয়সি, খেলার সঙ্গী দেওর সত্যর সঙ্গে বুলবুলের ঘনিষ্ঠতা, বিনোদিনীর হিংসাপরায়ণ মনোভাব এবং অর্থ-যৌন লালসা, বাড়ির বড়বউয়ের বিরুদ্ধে ইন্দ্রনাথের মন ক্রমশ বিষিয়ে দিতে থাকে। সত্যকে বিলেত পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইন্দ্রনাথ। দাদার আর্দশে বড় হওয়া সত্য স্বপ্নপূরণের আশায় বিদেশ পাড়ি দেয়। অন্যদিকে, একমাত্র খেলার সঙ্গীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, বয়সে বড় বিনোদিনীর ষড়যন্ত্র, স্বামীর পাশবিক অত্যাচার, সুযোগসন্ধানী ভাসুরের শারীরিক নির্যাতনের শিকার ঠাকুরবাড়ির বড়বউয়ের মধ্যে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন। তার শরীরে এক অশুভ সত্বার জন্ম হয়। সমাজে তথাকথিত ভালোমানুষ, অত্যাচারী পুরুষ দেখলেই রাতের অন্ধকারে সেই অশুভ শক্তি পিশাচিনীর রূপ ধারণ করে একের পর এক হত্যালীলায় মেতে ওঠে।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
‘বুলবুল’ এককথায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাহিনী। তবে নারীকেন্দ্রিক গল্প হলেও অন্যান্য অনেক হিন্দি ছবির তুলনায় ‘বুলবুল’ অনেকটাই ডার্ক। অনেকদিন পর স্বল্পভাষী ইন্দ্রনাথ ও মহেন্দ্রর দ্বৈতচরিত্রে রাহুলের অভিনয় দুর্দান্ত। সত্যর চরিত্রে অবিনাশ এবং বুলবুলের ভূমিকায় তৃপ্তির রসায়ন দর্শককে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কাদম্বরী বৌঠানের কথা মনে করাবে। বিনোদিনীর চরিত্রে পাওলি এবং গ্রামের ডাক্তার সুদীপের ভূমিকায় পরমব্রতর অভিনয় যথাযথ ও সাবলীল। অভিনয়ের ক্ষেত্রে সকলেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘বুলবুল’-এর বিশেষ প্রাপ্তি তার সিনেম্যাটোগ্রাফি। ছবিতে লাল রঙের ব্যবহার দর্শককে চোখের আরাম না দিলেও রোমহর্ষক মুহুর্ত, প্রতিশোধ তুলে ধরার জন্য যথাযথ। আর যার কথা না বললেই নয় তিনি হলেন সঙ্গীত পরিচালক অমিত ত্রিবেদী। গোটা ছবিতেই পাশ্চাত্যের সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রার সুর দর্শকের মনে অদ্ভুত এক মেলানকলি সৃষ্টি করলেন তিনি। সদাচঞ্চল ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে বুলবুলের প্রণোচ্ছলতা ফুটিয়ে তোলার আবহে লগ্নজিতা চক্রবর্তী এবং শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠ অসাধারণ।
আরও পড়ুন: অনুষ্কার হাত ধরে প্রকাশিত হলো ‘অভিযাত্রিক’-এর প্রথম পোস্টার
তবে এতকিছুর পরেও দূর্বল চিত্রনাট্যের জন্য ‘বুলবুল’ স্রেফ আরেকটা হরর ছবি হয়েই থাকে যায়। প্রথম দশ মিনিটের মধ্যেই দর্শক আন্দাজ করে নিতে পারবেন শেষ পর্যন্ত কী হতে চলেছে। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলার জমিদারবাড়ির অন্দরমহলের অত্যাচার এবং প্রতিবাদের এই কাহিনীতে কোনও চমক নেই। চিরাচরিত ভূতের গল্পে যেমনটা হয়ে থাকে, এখানেও তাই। তবে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদী নারীর রণচণ্ডী রূপের সঙ্গে মা কালীর মিল থাকলেও, অশুভ শক্তিকে মা কালীর সঙ্গে কখনওই তুলনা করা যায় না। তাছাড়া ছবিতে দেখানো কাশফুলের সঙ্গে দুর্গাপুজোর যোগাযোগ থাকলেও কালীপুজোর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। চিত্রনাট্যের খামতি ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন পরম, রাহুল, তৃপ্তি, পাওলিরা। তাঁদের নিখুঁত অভিনয়ের জন্য ‘বুলবুল’ একবার অন্তত দেখাই যায়।