অভিনয়টুকুই প্রাপ্তি

ছবি: বেলাশুরু

পরিচালনা: নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২০ মিনিট

অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, শঙ্কর চক্রবর্তী, প্রদীপ ভট্টাচার্য, ইন্দ্রানী দত্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য, খরাজ মুখোপাধ্যায়, মনামী ঘোষ, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়

RBN রেটিং: ২.৫/৫

ধরা যাক মাধ্যমিকে কোনও ছাত্র ভালো ফল করার পর উচ্চমাধ্যমিকে অকৃতকার্য হলো। সে ক্ষেত্রে তো অবাক হওয়ারই কথা, তাই নয় কি? ‘বেলাশুরু’ও অনেকটা সেরকম। ‘বেলাশেষে’র প্রবল সাফল্যের পর পরিচালকদ্বয় যখন সেই ছবির সিক্যুয়েলের কথা ঘোষণা করেন তখন থেকেই ‘বেলাশুরু’ মুক্তির দিন গুনছিলেন দর্শক। তবু কোথাও যেন সেভাবে মন জয় করতে পারল না নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটির নতুন ছবি।



স্বামীর সঙ্গে ৫০ বছরের বৈবাহিক জীবন কাটানোর পর বিশ্বনাথ সরকার (সৌমিত্র) ও আরতি সরকার (স্বাতীলেখা) বর্তমানে শান্তিনিকেতনেই থাকেন। কিন্তু অ্যালজ়হাইমার্স রোগে আক্রান্ত আরতি এখন আর কাউকে চিনতে পারেন না। তার মননে রয়েছে ফরিদপুরে কাটানো ছেলেবেলা, অতীন্দ্রদাদা, বক্সীমাঝি। অবশ্য তার নিজের বিয়ের দিনের কথা খুব ভালোভাবে মনে থাকলেও তিনি কিছুতেই চিনতে পারেন না তার স্বামীকে। এ হেন অবস্থায় বারবার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আরতি। স্বামী ও ছেলেমেয়েদের চেষ্টায় খুঁজেও পাওয়া যায় তাকে।

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

‘বেলাশেষে’র মধুরেণ সমাপয়েতের পর বড় ছেলে বারীন (শঙ্কর) এবং বউমা শর্মিষ্ঠার মধ্যে ঘটে গেছে বিবাহ বিচ্ছেদ। ছোট মেয়ে পিউ (মনামী) ও পলাশের (অনিন্দ্য) সম্পর্কের তালটা কোথাও যেন কেটে গেছে। অন্যদিকে বুড়ি (অপরাজিতা) ও জ্যোতির্ময়ের (খরাজ) আরেকটি ছেলে হয়েছে। পুরোনো সব ভুলে মিলি (ঋতুপর্ণা) এবং বিজন (সুজয়প্রসাদ) এখন ভীষণ ভালো বন্ধু। কিন্তু এই সব ঘটনাই হারিয়ে গেছে আরতির স্মৃতি থেকে। তাই তার স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতেই ফের একত্রিত হয় এই পরিবার। তবু কোথাও যেন সেই পরিবারকেই ঠিক খুঁজে পাওয়া গেল না এখানে। ‘বেলাশেষে’তে যে ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে গল্প তৈরি হয়, তার একটা প্রভাব পড়ে চরিত্রগুলির ওপর। তবু এখানে সেভাবে কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা নিখাদ গল্প হবে, সেটাই বোঝা গেল না। কয়েকটি আবেগপূর্ণ সংলাপ, একঝাঁক ভালো অভিনেতা, শান্তিনিকেতনের মন ভোলানো দৃশ্য এবং অনেকগুলো গানের মাঝে হারিয়ে গেল ছবির গল্প।

অভিনয়টুকুই প্রাপ্তি

‘বেলাশুরু’র খামতি ঠিক কোথায়? ছবিটা অনেকগুলো জায়গায় খাপছাড়া লাগল। চিত্রনাট্য বেশ দুর্বল। এই ছবিতে কোনও গল্প নেই। আছে কিছু সমাজিক বার্তা যা পরিচালকদ্বয় তাঁদের সব ছবিতেই দিয়ে থাকেন। কিন্তু শুধুমাত্র সামাজিক বার্তাই একটি ছবির মূল বিষয় হতে পারে না। ছবিতে কাহিনীর ভীষণ দরকার ছিল।

আসা যাক ছবির মূল চরিত্রদের নামে, থুড়ি পদবীতে। ‘বেলাশুরু’ যদি ‘বেলাশেষে’র সিক্যুয়েল হয়ে থাকে তবে বিশ্বনাথ মজুমদার এখানে বিশ্বনাথ সরকার কেন? যেখানে পূর্ববর্তী গল্প ও ঘটনা এই ছবিতেও প্রাসঙ্গিক, সেখানে পদবীর পরিবর্তন চোখে লাগে। ওদিকে শর্মিষ্ঠা স্বামীর থেকে আলাদা থাকার পর অন্য একজনের সঙ্গে নতুনভাবে সংসার পাতার কথা ভাবছে। সেখানে সে কী করে মাত্র এক মিনিটের একপাক্ষিক কথোপোকথনে পুরোনো সবকিছু ভুলে প্রাক্তন স্বামীর কাছে ফিরে যায়? এই ধরণের ঘটনা কিছুটা বাংলা ধারাবাহিকের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন

চতুর্থ কারণ হলো হঠাৎ করে বিজনকে (সুজয়) সমকামী বানানোর চেষ্টা। সন্তান প্রসবে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে অন্য কিছু দেখানো যেত। বিজন সমকামী, ‘বেলাশুরু’তে সেরকম কোনও ইঙ্গিত ছিল না।

পঞ্চম কারণ হিসেবে বলা যায় অহেতুক গানের ব্যবহার। কবীর সুমনের কণ্ঠে ‘বেলাশুরু’ এবং অনুপম রায়ের গলায় ‘সোহাগে আদরে’ গানদুটির মাঝের সময়সীমা একটু বাড়ালে ভালো হতো। বিপুল জনপ্রিয় ‘টাপা টিনি’ গানটিও আরোপিত বলে মনে হয়। এমনকি বাড়ির তিন জামাইয়ের গনশাদাকে (প্রদীপ) মদ খাইয়ে তার পেট থেকে কথা বের করার দৃশ্যও একঘেয়ে লেগেছে। ‘বেলাশেষে’র ইমোশনকে ‘বেলাশুরু’তে ব্যবহার করতে গিয়ে কোথাও যেন ব্যর্থ হলো।

আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ

তবে এই ছবি দেখতে হবে স্বাতীলেখা এবং সৌমিত্রের অভিনয়ের জন্য। কিছু ক্ষেত্রে সৌমিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন স্বাতীলেখা। খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি তিনি। তবে ‘বেলাশুরু’ যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ভালো লাগে খরাজের কমিক টাইমিং। অভিনেতারা প্রত্যেকেই তাঁদের ভূমিকায় যথাযথ। ছবির প্রায় শেষের দিকে ভীষণ খুশির একটি মুহূর্তে হঠাৎ অপরাজিতার এক্সপ্রেশন বদলে যাওয়ার কারণটা বোঝা গেল না। মনামীর অভিনয় কিছু জায়গায় চড়াদাগের লেগেছে। সুমনের কণ্ঠে ‘বেলাশুরু’ এবং শ্রেয়া ঘোষালের ‘কী মায়ায়’ ভীষণ ভালো লাগে। ছবির নামকরণকে সার্থক করে ‘বেলাশুরু’র শেষ দৃশ্য।

শুধুমাত্র ইমোশন, নস্ট্যালজিয়া এবং সামাজিক বার্তা যে ছবির জন্য যথেষ্ট নয় সেটা পরিচালকদ্বয়ের ভেবে দেখা দরকার। ‘ইচ্ছে’, ‘অলীক সুখ’, ‘রামধনু’, ‘মুক্তধারা’, ‘হামি’, ‘কণ্ঠ’র মতো ছবি যাঁরা উপহার দিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। তবে সৌমিত্র-স্বাতীলেখা জুটির শেষ অভিনয়ের সাক্ষী হতে একবার দেখাই যায় ‘বেলাশুরু’। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *