স্বাধীনতার কাঁটাতারে

ছবি: প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন

পরিচালনা: কুমার চৌধুরি

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট

অভিনয়ে: পিয়ালি সামন্ত, আরমান শাহ, ইকবাল শাহ, নীলাঞ্জনা বিশ্বাস, রণজয় ভট্টাচার্য, রঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়, অভিজিত মুখোপাধ্যায়, রাশি দত্ত, স্বাপন দাস, স্বপ্না বসু

RBN রেটিং: ৩/৫

বাঙাল-ঘটির রোজনামচায় ফল্গুধারার মতো বয়ে চলে কাঁটাতারের ইতিকথা। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে যখন দিকে-দিকে শোনা যায় ‘ও আমার দেশের মাটি’, তখন মাটির জন্য মন কেঁদে ওঠে অনেকেরই। ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ ছবির পরতে-পরতে মিশে আছে এই মাটিরই গন্ধ, স্বজন হারানোর চাপা যন্ত্রণা আর বিচ্ছেদের কাঁটাতার। কুমার অনেকটা সময় নিয়ে বুনেছেন কাঁটাতারের এই ইস্তেহার।



কয়েক বছর আগের কথা। সমুদ্রতটে সিরিয়ার এক মৃত শিশুর ছবি ভাইরাল হয়। সে দেশে তখন যুদ্ধ। মানুষের চোখে শুধু ভয়, জীবনের জন্য আকুতি। নেটদুনিয়া আঁতকে উঠেছিল সে বীভৎসতায়! মায়ানমারে রোহিঙ্গারা যখন শিকড় ছাড়া হয়, তখন মিডিয়ার এতটা প্রভাব ছিল না। কিন্তু ইতিহাস, সে তো নিশ্চুপেই বোনা হয় জীবন খাতার পার বেয়ে।

সাল ২০১৫। শমি আখতার (পিয়ালি) মায়ানমারের হরিফারা গ্রামের বাসিন্দা। সে নথিও মজুত ছিল, সরকারী মোহর ছিল তাতে। তবু শমিরা ব্রাত্য। শমি মাদ্রাসায় যেত, বন্ধুদের সঙ্গে পুকুরে স্নান করতো, নানির কাছে গল্প শুনতো। বেশ কাটছিল তার যুবতীবেলা। এর পরে একদিন সময় এল, ছাড়তে হবে দেশ, ছেড়ে যেতে হবে মাটি। স্বদেশে স্বীকৃতি জুটল না শমিদের! তার মতো অনেককেই রাতারাতি দেশ ছাড়তে হলো। সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় প্রাণ গেল অনেকের। কেউ-কেউ আশ্রয় নিল বাংলাদেশের উখিয়া শিবিরে। কেউ এল ভারতে। কেউ আশ্রয় পেল কাশ্মীরে। এক মুহূর্তে ভাঙল স্বপ্ন।

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ ছবি বোনা হলেও, কাহিনীর উপপাদ্য একটি সাধারণ মেয়ের ভালোবাসা, স্বপ্ন গাথা। ধর্মের নামে বজ্জাতিতে সাধারণ স্বপ্নেরা কীভাবে মরে যায়, সে নিয়েই এই ছবি। শুধু মায়ানমার নয়, ভারতও তো চাক্ষুষ করেছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কারবারিদের চোখরাঙানি।

ভারতে এসে শমি আশ্রয় পেল উত্তর কলকাতার সিটি কলেজের কাছে এক হোমে। সেখানে তার জেনি ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ হলো। শমিকে বাঁচিয়ে রাখল জেনির বেহালা। তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল কাশ্মীরি বিক্রেতা ইকবালের (আরমান) সঙ্গে। 

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন পিয়ালি। ছবিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তাঁর উপরেই ছিল। সে কাজে তিনি সফল। শমির কাজলমাখা চোখ কাঁটাতার পেরিয়ে অপেক্ষায় থাকে নানির। অপেক্ষার কালো মেঘের মতো ঘনীভুত হতে পারতো পিয়ালির চোখের অভিব্যক্তি। কাশ্মীরি হিসেবে ইকবালের আরেকটু মানানসই হওয়া প্রয়োজন ছিল। বিশেষত তাঁর সংলাপ বলার ধরণ বেশ কয়েক জায়গায় অপরিণত মনে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভাষা, বাচনভঙ্গি সম্পর্কে পরিচালক যত্নবান হলেও, অভিনয় আরও বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার প্রয়োজন ছিল। ছবির বেশিরভাগ জুড়ে রয়েছে কলকাতা। কাশ্মীরও রয়েছে অল্পবিস্তর। তবে স্বাভাবিক কারণেই মায়ানমারে শুটিং করা সম্ভব হয়নি।



মেঘ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবহ আলাদা প্রশংসার দাবি রাখে। তবে ছবির দৈর্ঘ্য আরেকটু কমানো যেত।

গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্বিচারে গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে, বিভিন্ন সময়ে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। উখিয়ার কুতুপালং হলো বর্তমানে বিশ্বের সবথেকে বড় শরণার্থী শিবির। কলকাতার বহু দর্শকেরই হয়তো রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। প্রাসঙ্গিক হলেও প্রথম ছবির জন্য বেশ কঠিন বিষয় নির্বাচন করেছেন কুমার। কাঁটাতার পার করে এসে সাধপূরণের দলিল অনেক থাকলেও, ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন’ আলাদা তার সারল্যের গুণে।



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Angana

A traveler and a lover with a musical heart. An avid reader and writer. Reads anything that falls on her hands. Has an analytical mind and is highly opinionated

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *