RBN Exclusive: ‘রিভলভার রহস্য’ নিয়ে সান্ধ্য আড্ডায় অঞ্জন, সুপ্রভাত

একই দিনে প্রকাশিত হচ্ছে বই এবং মুক্তি পাচ্ছে সেই গল্প অবলম্বনে ছবি. এমন ঘটনা বাংলা সাহিত্য এবং বিনোদন জগতে বিরলতম। তবু সেটাই ঘটিয়ে ফেলেছেন পরিচালক অঞ্জন দত্ত। তাঁর ‘রিভলভার রহস্য’ ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে আগামীকাল। একই দিনে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হবে অঞ্জনের লেখা ‘ড্যানি ডিটেকটিভ’ সিরিজ়ের দ্বিতীয় বই, যার মধ্যে রয়েছে এই গল্পটিও। ছবির মুখ্য চরিত্র সুব্রত শর্মার ভূমিকায় থাকছেন সুপ্রভাত দাস। এমন একটা বিশেষ ঘটনা ঘটার আগে অঞ্জনের বাড়িতে হাজির টিম রেডিওবাংলানেট। জমে গেল অঞ্জন-সুপ্রভাতের সান্ধ্য আড্ডা। সাক্ষী থাকলাম আমরা। 

সুপ্রভাত: আমাদের ছবি মুক্তির দিন তো এগিয়ে এল। প্রচার কেমন হলো? 

অঞ্জন: আমাকে তো সবটাই দেখতে হয়। আমাদের এখানে কোনও আলাদা সিস্টেম নেই। সকলের জন্য এক নিয়ম। যেভাবে শাহরুখ খান করেন সেভাবে আমরাও করি। তফাৎ শুধু উনি হয়তো একশোটা হোর্ডিং দেবেন, আমি পাঁচটা দেব। আলাদা কিছুই নেই। কাজেই প্রমোশন নিয়ে আমাদের নিজেদেরই ভাবতে হয়। কোথায় দিলে ভালো হবে বা কোথায় দেওয়ার দরকার নেই, সেটা নিয়েও মাথা ঘামাতে হয়। সেইভাবেই আমরা এগোচ্ছি। যেহেতু আমার বই আর ছবি একই দিনে আসছে—যা এর আগে কখনও হয়নি—তাই এটা অবশ্যই একটা বিশেষ ঘটনা। তবে এরকম অনেক ‘হয়নি’কে আমি নিজে ঘটিয়েছি আমার জীবনে।



সুপ্রভাত: আমি তো আপনার নতুন গোয়েন্দা। কিন্তু গোয়েন্দার প্রতি আপনার আকর্ষণ তো আজকের নয়।

অঞ্জন: আমি বরাবরই প্রচুর গোয়েন্দা গল্প পড়তাম, তবে সেগুলো ইংরেজিতে। সেবার দূরদর্শনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা ছোট নাটক, ইংরেজিতে দশ মিনিটের বলার ব্যাপার ছিল। সেটার জন্য আমাকে ডেকেছিলেন বিভাস চক্রবর্তী। সেখানে অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় ছিলেন। উনি বলেছিলেন, ভালোই তো অভিনয় করো, তবে বাংলায় অভিনয় করতে হলে ভাষাটা জানতে হবে। উনি যখন শুনলেন আমি ইংরেজি গোয়েন্দা গল্প পড়তে ভালোবাসি, তখন বললেন, তাহলে তুমি বাংলা গোয়েন্দা গল্প দিয়েই শুরু করো। বাংলায় খুব ভালো-ভালো গোয়েন্দা আছে। সেই আমার শুরু। সেভাবে দেখতে গেলে আমার সঙ্গে নীহাররঞ্জন গুপ্তের পরিচয় কিরীটি রায়ের মাধ্যমে। প্রেমেন্দ্র মিত্রকে আমি চিনেছি পরাশর বর্মা পড়ে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনেছি ব্যোমকেশ বক্সী পড়ে। পরবর্তীকালে এঁদের লেখা অন্যান্য গল্প ও উপন্যাস আমাকে টেনেছে। তবে শুরুটা ওই গোয়েন্দা গল্প দিয়েই। 

সুপ্রভাত: এরপর তো নিশ্চয়ই রুদ্র সেন। অনেকেই এখনও রুদ্র সেনকে ভুলতে পারেন না। 

অঞ্জন: হ্যাঁ এরপর আমি দূরদর্শনের জন্য রুদ্র সেন লিখি। ওটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে সেটা ইটিভিতে করেছিলাম। গোয়েন্দা নিয়ে ছবি করার কথা তখনও মাথায় আসেনি। পরে অনেকে আমাকে বলেছে রুদ্র সেনকে আবার ফিরিয়ে আনতে। এদিকে সব্যসাচীর (চক্রবর্তী) তখন বয়স বেড়ে গেছে। আমি ওকে ছাড়া এই চরিত্রটা আর কাউকে দিয়ে করাতে রাজি ছিলাম না।

আরও পড়ুন: গোয়েন্দার অবতারে আসছেন করিনা

সুপ্রভাত: তারও অনেক বছর পর এল ব্যোমকেশ। এবং সেই সিরিজ় দারুণ ব্যবসা করল। একই পরিচালকের অনেকগুলো ছবি নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি বলতে যা বোঝায়, আপনার ব্যোমকেশের আগে বাংলায় তেমন ছিল না।

অঞ্জন: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আসলে রুদ্র সেনের পর ভাবতে গিয়ে ঠিক করলাম ব্যোমকেশ করব। ২০০৮-এ ব্যোমকেশের আটটা গল্প কিনে নিজের প্রোডাকশন হাউজ় খুলে কাজ শুরু করব ঠিক করলাম। শুরুতে প্রযোজক পেতে খুব সমস্যা হয়েছিল। ব্যোমকেশ আমার কাছে বাংলা সাহিত্যের সবথেকে সাবলীল গোয়েন্দা। ব্যোমকেশের গল্পে সেই সময়ের সমাজটা এত সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে ভাবা যায় না। এদিকে প্রযোজক পেতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। বাজেট ছিল ₹৪৫ লাখ। তার মধ্যে ₹৬ লাখ দিয়ে এক প্রযোজক কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। সেই সময় কৌস্তুভ রায়ের সঙ্গে আলাপ হলো। আবির (চট্টোপাধ্যায়) এবং শাশ্বতকে (চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে ছবিটা করতে চাই শুনে সে রাজি হলো। সেই ছবি এত জনপ্রিয় হলো যে পরপর অনেকগুলো ব্যোমকেশ করলাম। আবির যখন আর করতে পারল না তখন যিশুকে (সেনগুপ্ত) মানাবে ভেবে ওকে আনলাম। সেটাও দর্শকের ভালো লাগল। তারপর সিনেমা, টেলিভিশন, ওয়েব সিরিজ়ে এত বেশি ব্যোমকেশ হতে শুরু করল যে আমার ইচ্ছেটাই চলে গেল। তখন ব্যোমকেশ করা ছেড়ে দিলাম।  

আরও পড়ুন: হাফপ্যান্ট পরে অভিনয়, কিশোরের প্রস্তাবে সত্যজিতের অট্টহাসি

সুপ্রভাত: এই ব্যোমকেশের সূত্রেই আপনার সঙ্গে আমার দেখা

অঞ্জন: হ্যাঁ একদমই। ব্যোমকেশ করতে করতেই তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো। এই সময় আমি অন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। তখন আমি অন্য ধরনের ছবি করছি। তবু একটা ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির ইচ্ছে ছিলই। যে কোনও পরিচালকেরই এই ইচ্ছেটা থাকে। তখন আমি তোমাকে নিয়ে শ্রীকান্ত করব ভাবলাম। তিনটে ছবির সিরিজ়। রাজলক্ষ্মী, অভয়া ও কমললতা, এই তিনজনকে নিয়ে তিনটে গল্প। চিত্রনাট্য তৈরি হলো। নাম দিয়েছিলাম ‘কান্ত’। কারণ শ্রীকান্ত কে সকলে কান্তদা বলেই ডাকত। আমি গল্পটাকে ১৯৬৯-এ ভেবেছিলাম। আবার সেই এক সমস্যা। চিত্রনাট্য লেখার পর প্রযোজক পেলাম না। এইসব চলতে-চলতে কোভিড এসে গেল। তখন তুমিই একদিন বললে রুদ্র সেন নিয়ে বই করুন। এটা আমি কোনওদিন ভাবিনি।



সুপ্রভাত: আপনি এতদিন ধরে গান লিখেছেন, স্ক্রিপ্ট করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন, একটা বই করে রাখলে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে আপনি কী-কী করে গেছেন। আমার মনে হয়েছিল রুদ্র সেন গল্প হিসেবে এলে মানুষ পড়বেই। 

অঞ্জন: তোমার বলাতেই আমি লিখতে শুরু করি। এর আগে রুদ্র সেনের চিত্রনাট্য ছাপার অক্ষরে বার করার একটা কথা হয়েছিল। তবে সেটা আমার তেমন পছন্দ হয়নি। এবারে লিখতে বসে আমার মনে হলো, সাহিত্যের গোয়েন্দারা সকলেই খুব লার্জার দ্যান লাইফ। আমার নিজের কিন্তু এজেন্সির গোয়েন্দা নিয়ে একটা ধারণা ছিল যে একমাত্র প্রাক্তন পুলিশকর্মীদের এরকম লাইসেন্স দেওয়া হয় সেই কেসগুলোর জন্য যেখানে পুলিশ নিজে কিছু করতে পারে না। অর্থাৎ যেখানে কারওর ওপর নজর রাখতে হবে, স্বামী বা স্ত্রীর পরকীয়া সংক্রান্ত প্রমাণ এনে দিতে হবে, বিয়ের আগে পাত্র বা পাত্রী সম্পর্কে খোঁজখবর করতে হবে, এইসব কেস। তখন আমার মনে হলো, এরকম এজেন্সির গোয়েন্দা নিয়ে নতুন কিছু লিখি। সেই থেকেই সুব্রত শর্মা আর ড্যানির গল্পটা আমার মাথায় এল। সেই বই গতবছর বেরোল। আমার কোনও ধারণা ছিল না কেমন বিক্রি হবে বা আদৌ কেউ পড়বে কিনা। অথচ সেই বই এত বিক্রি হলো যে আমাকে আবার লিখতে বলা হলো। সেই বইয়ের পরবর্তী পর্ব বেরোচ্ছে এবার। এই নতুন বইটার শেষ গল্পটা নিয়ে এই ‘রিভলবার রহস্য’। 

আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি

সুপ্রভাত: গল্পটা বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডের শেষের হলেও সুব্রতর শুরুটা তো এই গল্পেই থাকছে।

অঞ্জন: সেটা তো রাখতেই হবে। নাহলে দর্শক বুঝবে না সুব্রত কীভাবে এই পেশায় এল। সে তো গোয়েন্দা হতেই চায়নি। পরিস্থিতির পাকে পড়ে গোয়েন্দাগিরি করছে। আমি ছবিটা হুডানইট-ই রেখেছি, যদিও সেখানে একটা বড় পরিবর্তন আছে। বই আর ছবির মধ্যে সেই ব্যাপারটা একরকম নয়। তবে সে তো আমরা গল্প জেনেই ফেলুদা বা ব্যোমকেশ দেখেছি। বরং সেখানে ফিল্ম তৈরি করতে একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। বৃষ্টির মধ্যে যেভাবে শুট করেছি আমরা, সেটা দার্জিলিংয়ের আবহাওয়ায় সত্যি কঠিন ছিল। এদিকে ওই বৃষ্টিটার দরকার ছিল। 

সুপ্রভাত: সুব্রতর একটা গল্প আছে শিলংয়ে। ওটা নিয়েও দারুণ ছবি হতে পারে।

অঞ্জন: শিলংয়ের গল্পটা নিয়ে অনেকেই বলেছে ছবি করতে। আসলে শিলং আমার তেমন চেনা জায়গা নয়। তাই দার্জিলিং বেছে নিয়েছি। আর এই সাধারণ দার্জিলিংটাই আমি দেখাতে চেয়েছি। বস্তি, বাজার, চার্চ, সব নিয়ে একদম সাধারণ দার্জিলিং। ট্যুরিস্টদের দার্জিলিং নয়। 



সুপ্রভাত: আপনার বইয়ের প্রচ্ছদেও আপনি আমাকে রেখেছেন, এটাও বোধহয় আগে হয়নি।

অঞ্জন: না হয়নি, তার কারণ আমি তোমাকে ভেবেই সুব্রতকে লিখেছি। তোমার ভেতর যে সাধারণ ছাপোষা একটা ব্যাপার আছে, এটাই আমি সুব্রতর মধ্যে চেয়েছি। তাই তুমি যেমন, তোমার ম্যানারিজ়ম যেমন, সুব্রতও সেরকমই। এখন থেকে ঠিক করেছি বছরে একটা সুব্রত শর্মা করব। এছাড়া মৃণাল সেনকে নিয়ে ছবিটাও করব। তবে থ্রিলার আর করব না। ‘মার্ডার’ ওয়েব সিরিজ়টাও আর করছি না। বড্ড বেশি গোয়েন্দা হয়ে যাচ্ছে চারপাশে। সুব্রত একেবারে আলাদা। কিন্তু এর বাইরে সব গোয়েন্দাই লার্জার দ্যান লাইফ। কারণ বাঙালি শার্লক হোমস আর এরক্যুল পয়রোর বাইরে খুব একটা ভাবতে পারে না। 

সুপ্রভাত: মোট কতগুলো গল্প লিখবেন সুব্রতকে নিয়ে? 

অঞ্জন: খুব বেশি হলে বারোটা। তার বেশি লেখার ইচ্ছে আমার নেই। সুব্রতর এজেন্সির একটা লাইসেন্স দরকার। এই লাইসেন্স আসবে সুব্রতর শেষ গল্পে। কারণ তার আগে অবধি সুব্রত পুরোদস্তুর গোয়েন্দা নয়। সে ভুল করে, রেগে যায়, মার খায়, নেশা করে। লাইসেন্স পাওয়ার পরেই সে একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা হয়ে ওঠে। সেখানেই আমার গল্প শেষ হবে। ছবি হয়ত আরও তিন-চারটে হবে। দেখা যাক সুব্রতকে দর্শক কীভাবে নেন। আমার ধারণা ড্যানি আর সুব্রতর জুটি দর্শকের ভালো লাগবে। 

ছবি: স্বাতী চট্টোপাধ্যায়

 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *