দেশে বিদেশে ৩৬টি পুরস্কার, ‘অন্দরকাহিনী’র আড্ডায় অর্ণব-প্রিয়াঙ্কা
বর্ষার আশায় হা পিত্যেস করে বসে থাকার পরে অবশেষে বাঙালির কপালে জুটেছে বৃষ্টি। এ হেন এক দিনভর বৃষ্টির বিকেলেই পরিচালক অর্ণব মিদ্যার ফোন, “চলে এসো।”
মানে? যাবটা কোথায়? প্রিয়াঙ্কা সরকার, সায়নী ঘোষ, রাজেশ শর্মাদের নিয়ে অর্ণবের পরবর্তী ছবি ‘অন্দরকাহিনী’ মুক্তি পাচ্ছে ৬ সেপ্টেম্বর, সেটা জানি। ট্রেলারও বেরিয়ে গেছে কিছুদিন আগে। তাহলে ছবি সংক্রান্তই কিছু হবে বোধহয়।
“কি ব্যাপার? হঠৎ এসওএস কেন?”
“আরে, দ্য বিউন ক্যাফেতে চলে এসো এক্ষুণি,” অর্ণবের গলায় তাড়া। “তোমার অফিস থেকে বেশি দূর নয়। আড্ডা হবে। প্রিয়াঙ্কাও আসছে।”
অলস বিকেল। ডেস্কে বসে হাই তোলার ফাঁকে ল্যাপটপে টরেটক্কা চলছে। আড্ডার প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কপি লেখার মশলার গন্ধে আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখন সজাগ। অতএব স্মার্টফোনে আঙুল চালিয়ে ক্যাব ডাকা, গন্তব্য লেক টেরেস।
আমার কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছিল দুজন। আরেক রাউন্ড বৃষ্টির সঙ্গে শুরু হল ‘অন্দরকাহিনী’র একেবারে অন্দরের কথা।
গল্পটা কি সেটা আগে বলো। কিছুটা আন্দাজ পেয়েছি
প্রিয়াঙ্কা: আমি বলছি। দেখো, প্রতিটি নারীর জীবনে অনেকগুলো পর্যায় থাকে। কখনও সে মেয়ে, কখনও বা বন্ধু কিংবা বোন, আবার কখনও সে প্রেমিকা অথবা স্ত্রী। আরও অজস্র ভূমিকা থাকে। তার মধ্যে থেকে অর্ণব এই চারটি ভূমিকাকেই বেছে নিয়েছে ওর ছবির জন্য। একজন নারী কেমন করে এই চারটি ভূমিকাতে অবতীর্ণ হচ্ছে, সেটাই দেখা যাবে এই ছবিতে।
অর্ণব: বলতে পারো চারটি আলাদা গল্পের কোলাজ থাকছে এই ‘অন্দরকাহিনী’তে ।
কাস্টিং-এও তো বেশ অভিনবত্ব রয়েছে। চারটি পৃথক গল্পের মূল চার নারী চরিত্রেই রয়েছ তুমি। সেটা কেন? আলাদাও তো হতে পারতো
প্রিয়াঙ্কা: এটা ঠিকই যে অর্ণব যদি চারজন আলাদা শিল্পীকে নিয়ে ছবিটা করতো তাহলে ওর কাজটা হয়তো অনেক সহজ হতো। কিন্তু ও কঠিন পথটাই বেছে নিয়েছে।
অর্ণব: একজন নারীকে যেহেতু বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়, তাই একজন অভিনেত্রীকেই সবকটি চরিত্রে দেখা যাবে। এতে দর্শকরা আরও ভালো করে সেই ভূমিকাগুলোর সঙ্গে রিলেট করতে পারবেন।
প্রিয়াঙ্কা: আরও একটা কথা। এই ছবির চারটি মূল নারী চরিত্র চার রকমের সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে এসেছে। যেমন একটি গল্পের মূল চরিত্রের নাম প্রিয়াঙ্কা। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের এই গল্পে উঠে আসবে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে তার বাবা এবং এক বন্ধুর সম্পর্ক। প্রিয়াঙ্কার বাবার চরিত্রটি করছেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বন্ধুর চরিত্রে আছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। আর একটি গল্পে মূল চরিত্রের নাম বুল্টি। সে আর তার দাদা (সুমিত সমাদ্দার) পাড়ায় একটি চায়ের দোকান চালায়। তার শরীরী ভাষা বা কথা বলা বাকী চরিত্রদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মিলবে না। এই গল্পে একটি বিশেষ ভূমিকায় আছেন রাজেশ শর্মা। আর একটি গল্পের মূল চরিত্র গ্রামের এক কোণে থাকা লক্ষ্মী নামের একটি অসবর্ণ মেয়ে। তার সঙ্গে একটি শহুরে মেয়ের বন্ধুত্ব হয়। বান্ধবীর চরিত্রটি করছে সায়নি (ঘোষ)। সামাজিক দিক থেকে প্রায় বিপরীত মেরুতে বাস করা দুটি মেয়ের অসম বন্ধুত্বের কাহিনী দেখা যাবে এই পর্যায়ে। চতুর্থ গল্পটিতে থাকছে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথা। এখানে আমার স্বামীর চরিত্রে থাকছে প্রসূন গায়েন। এছাড়া একটি বিশেষ চরিত্রে রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: বিশ্বনাথের বারাণসী, বারাণসীর বিসমিল্লাহ
তাহলে এই চারটি ভিন্ন গল্পের যোগসূত্রটা কোথায়? যে কোনও অ্যান্থলজি ছবিতে হয় প্রত্যেকটা গল্প আলাদা থাকে, নয় তো প্রতিটি গল্পের মধ্যে কোনও একটা যোগসূত্র থাকে। এখানে সেরকমই কিছু থাকছে তাহলে?
প্রিয়াঙ্কা: এখানে যোগসূত্র একটাই—একটা মেয়েকে সারা জীবনের বিভিন্ন ভূমিকা পালন। জীবনের নানান ওঠাপড়ার মধ্যে প্রত্যেকটি মেয়েরই অন্যরকম এক পরিচয় ও না বলা কথা থাকে যা অজানাই থেকে যায়। এগুলোকে একই সূত্রে বাঁধতে গিয়ে অর্ণবের মনে হয়েছে যে একটাই মুখের সাহায্যে ও এই যোগসূত্রটা তুলে ধরতে পারবে।”
অর্ণব: হ্যাঁ একদমই তাই। প্রতিটা গল্পে একটাই মুখ কমন থাকা, এই ব্যাপারটা খুব জরুরী ছিল।
আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে
বেশ অনেকদিন লাগলো ছবিটা মুক্তি পেতে। সাধারণত একটা ছবি ঘোষণা হওয়ার পর থেকে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত যতটা সময় লাগে, সেটা ‘অন্দরকাহিনী’র ক্ষেত্রে বেশ একটু দীর্ঘই বলা যায়
অর্ণব: আসলে ছবির পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজটা খুব যত্ন করে করেছি আমরা। ‘অন্দরকাহিনী’র ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি ছিলেন সুপ্রিয় দত্ত, সম্পাদনা করেছেন অর্ঘ্যকমল মিত্র, ছবির গান লিখেছেন শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বড় কোনও প্রযোজনা সংস্থার সাহায্য না পাওয়ায় অনেক সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। শেষ মুহূর্তে ক্রাউডফান্ডিং-এর দ্বারস্থ হতে হয়েছে।
প্রিয়াঙ্কা: আরও একটা ব্যাপার আছে। অর্ণব শুরু থেকেই ঠিক করে রেখেছিল ছবিটি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠাবে। তাই ও একবছর সময় রেখেছিল হাতে। সেই মতো ‘অন্দরকাহিনী’ ৪৯টি ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে ও এখনও পর্যন্ত ৩৬টি পুরস্কার পেয়েছে। হায়দরাবাদ ও দিল্লীতেও খুবই প্রশংসিত হয়েছে ছবিটা।
অর্ণব: প্রিয়াঙ্কা নিজে ১৩টি পুরস্কার পেয়েছে। নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ছাড়াও জার্মানি, ফ্রান্স ও আমেরিকায় ছবিটি দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ছবিটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এছাড়া বিদেশের জুরি মেম্বাররাও ছবি ও প্রিয়াঙ্কার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। দর্শকররা ওকে নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন এই ছবিতে। বিদেশের মানুষ প্রিয়াঙ্কা সম্বন্ধে কৌতুহলী হয়েছেন ছবিটা দেখে।
‘অন্দরকাহিনী’র প্রি-প্রোডাকশনও তো অনেক সময় নিয়ে করেছিলে তোমরা
অর্ণব: হ্যাঁ। প্রি-প্রোডাকশনের কাজটা আগে থেকেই সব প্ল্যান করা ছিল। তাই মাত্র দশদিনে ছবির শ্যুটিং শেষ করতে পেরেছি আমরা। রবীন্দ্র সরোবর, রানিকুঠি, বেহালার একটি অনাথ আশ্রম ও বারুইপুরে শ্যুট করেছি আমরা।
ছবির কথা শুনতে শুনতে খেয়ালই করিনি যে কফি ততক্ষণে আধঠাণ্ডা। বৃষ্টিটাও একটু ধরেছে মনে হয়। এবার আমার বেরোনোর পালা।