“চুলের রং নিয়ে সৃজিতের মতো গুন্ডামি কেউ করেনি”
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের (Srijit Mukherji) পরিচালনায় সম্প্রতি ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ সিরিজ়ের নতুন সিজ়ন ‘ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর‘-এর স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে। এই সিরিজ়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্ধেশ্বর মল্লিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রজতাভ দত্ত (Rajatava Dutta)। সিদ্ধেশ্বরের চরিত্রে তিন বয়সের তিনরকম লুকের দরকার ছিল। সেই নিয়ে রেডিওবাংলানেট– এর সঙ্গে কথা বললেন অভিনেতা
প্রশ্ন: ঠিক কী-কী হয়েছিল মেকআপ নিয়ে?
রজতাভ: আজ পর্যন্ত আমার অভিনীত কোনও চরিত্রের লুকের জন্য কেউ এমন গুন্ডামি করেনি, যেটা সৃজিত করেছে! আমি নিজেই একটু মেকআপ নিয়ে খুঁতখুঁত করে থাকি। বিশেষ করে যখন স্পেশাল কোনও লুক দরকার পড়ে। এমনিতে বাংলায় ছোট চরিত্রের জন্য অত নিখুঁত মেকআপের বাজেট থাকে না। তবু এই চরিত্রে তিনটে লুক নিয়ে সৃজিত যেভাবে লেগে ছিল, আর আমার মাথার ওপর দিয়ে যা গেছে, তা শুধু আমিই জানি। এক একবার রং করা হয় আর সৃজিত বলে এটা হয়নি। আবার রং বদলাও। একটা সময়ের পর আমার চুলটা দেখে মনে হচ্ছিল যে এটা আসল চুল নয়। মানে এতবার ওটার ওপর ডাই করা হয়েছে আর তারপর আবার স্বাভাবিক করা হয়েছে।
প্রশ্ন: এ তো সাংঘাতিক কাণ্ড!
রজতাভ: (হেসে) ভয়ঙ্কর! সিরিজ়টা দেখলে সিদ্ধেশ্বরের তিনটে বয়সে তিনরকম চুলের কায়দা বোঝা যাচ্ছে। আর কোথাও কোনও উইগ ব্যবহার করা হয়নি। সবটাই আমার মাথার ওপর দিয়ে গেছে (হেসে)। প্রস্থেটিক মেকআপ অনেকটাই খরচ এবং সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার হওয়ার কারণে বাংলা ছবিতে খুব প্রয়োজন ছাড়া সেটা ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু এই যে একই চেহারায় এতগুলো লুক এটা নিয়ে সৃজিত কোথাও আপোষ করতে চায়নি।
প্রশ্ন: এগুলো কি সব কাশ্মীরে থাকতে করা হয়েছিল?
রজতাভ: না, কলকাতা থেকে করে গেছি। আবার ওখান থেকে ফিরে এখানেও হয়েছে। এগুলো এমন সব মেটিরিয়াল দিয়ে করতে হয় যে সব ওখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বারবার ওয়াশ করা, আবার ডাই করা, আবার যাতে চুলটা পুড়ে না যায় সেটাকে গার্ড করার জন্য আবারও কেমিক্যাল দেয়া হচ্ছে সে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড!
আরও পড়ুন: মুম্বইও কি “ঘটিয়া”? প্রথম ছবি মুক্তির আগেই পাততাড়ি গোটালেন অনুরাগ কশ্যপ
প্রশ্ন: এত কাণ্ড করে চুলগুলো আস্ত আছে নাকি গেছে?
রজতাভ: (হেসে) এখন মোটামুটি ঠিক হয়েছে। তখন যা অবস্থা হয়েছিল চুলে হাত দিলে মনে হতো ছোবড়ার গদির ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছি। পুরো অসুরের চুলের মতো অবস্থা। তাও যাদের কার্তিকের মতো মাথাভরা চুল আছে তাদের নাহয় ভয় নেই। আমার চুল নিয়ে বিরাট কোন ফ্যাসিনেশন নেই কিন্তু যতই হোক শো-বিজ়ে আছি, একেবারে সব চুল উঠে গেলে তো চলবে না!
প্রশ্ন: এর জন্য অন্য কোনও প্রজেক্টে সমস্যা হয়নি?
রজতাভ: সে আরেক কাণ্ড! কলকাতায় ফেরার পর আমাকে কে যেন বলল চুলে আর রং করার দরকার নেই, স্বাভাবিক হলেই চলবে। আমি আমার স্বাভাবিক চুলের রঙে ফিরে গেলাম। এবার সৃজিত এসে বলছে, আমি তো এরকম কিছু বলিনি, কে বলেছে তোমাকে? আমি এবার আমতা-আমতা করছি। নাম বলতে পারছি না। বুঝতে পারছিলাম আমি বয়সে কিছুটা বড় বলে সৃজিত আমাকে হয়তো কিছু বলছে না। কিন্তু যে বলেছে, তাকে সামনে পেলে পুরো চিবিয়ে খেয়ে নেবে আর আমাকে সেই ক্যানিবালিজ়মের কারণ হতে হবে। এদিকে সৃজিত খুঁজে বেড়াচ্ছে কে বলেছে কথাটা। সেই নিয়ে এক টেনশন ছিল ক’দিন। তবে সিরিজ়টা দেখার পরে বুঝেছি সৃজিতের ওই জেদের পিছনে কারণ ছিল।
আরও পড়ুন: মনে করিয়ে দেয়, আরও বেঁধে থাকা প্রয়োজন
প্রশ্ন: এখানে তুমি অনেকটা বেশি বয়সের চরিত্রে আছো। সাধারণত ফেলুদা গল্পের ক্ষেত্রে চরিত্রের বয়স অনুযায়ী অভিনেতা নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কারণটা কী?
রজতাভ: হয়তো সৃজিতের মনে হয়েছে চরিত্রটা আমি ঠিকঠাক উতরে দিতে পারব। আমি ঠিক জানি না, তবে এটাই আমার ভাবতে ভালো লাগছে। তবে বেশি বয়সের চরিত্র আমি বহু আগে থেকেই করছি। যখন ২০০৪ সালে ‘বারুদ’ ছবিতে মিঠুনদার (চক্রবর্তী) সঙ্গে প্রথম কাজ করলাম, সেই সময়েই বয়সটা বাড়িয়ে নিতে হয়েছিল। মিঠুনদা আমার থেকে ১৭ বছরের বড়। কিন্তু বাংলা ছবির প্যাটার্ন অনুযায়ী ভিলেনকে সবসময় হিরোর চেয়ে বড় হতে হবে। তাই শুরু থেকেই মিঠুনদার থেকে বয়স বাড়িয়েই অভিনয় করেছি আমি। তাই এই ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন নয়। তবে এটাও ঠিক যে বয়স কম থাকলে তাকে শুধু উইগ পরিয়ে মেকআপ দিয়ে বেশি বয়সের চেহারা দিয়ে দেওয়া যায় না। বয়স বাড়লে মুখের রেখা থেকে শরীরী ভাষা সবই পাল্টে যায়। এখন আমি যে বয়সটায় রয়েছি সেখানে খুব সহজেই মেকআপ দিয়ে এই ৪০-৫০-৬০ এই ধরণের বয়সের চেহারায় আমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে। সেটা হয়তো একটা অ্যাডভান্টেজও। আমার ধারণা সৃজিত এগুলো ভেবেচিন্তেই করেছে। চিন্তাভাবনা না করে কাজ করার ছেলে ও নয়।
আরও পড়ুন: মশলা ছবি নিজ গৌরবে হাজির
প্রশ্ন: তুমি বোধহয় একমাত্র অভিনেতা যে সব্যসাচী চক্রবর্তী, আবির চট্টোপাধ্যায় ও টোটা রায়চৌধুরী অভিনীত ফেলুদায় কাজ করেছ। দুই পরিচালকের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে কতটা আলাদা অভিজ্ঞতা বা কতটা পার্থক্য বুঝেছ তুমি?
রজতাভ: বাবুদার (সন্দীপ রায়) সঙ্গে যখন প্রথম ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ করছি তখন তো ওটাই আমার কাছে অনেক। পরবর্তী সময়ে যখন কাজ করেছি তখন তো বাবুদার সঙ্গে অনেক বছরের আলাপ হয়ে গেছে। আর বাবুদার ইউনিটে কাজ করা মানে তো রাজার হালে থাকা। কোথা দিয়ে কাজ হয়ে যাচ্ছে বোঝাই যায় না। বুনিদি (ললিতা রায়) এমনভাবে খেয়াল রাখবেন যেন নিজের বাড়ির লোক। আমি কথার কথা বলছি, এরকম একটা চুলের দরকার হলে বাবুদা অন্যভাবে ভাবতেন। অভিনেতাকে এই দশবার ধরে চুলের রং নিয়ে কষ্ট করতে উনি বলবেনই না। আর সৃজিতকে আমি যখন বলছি, সৃজিত এটা কি করতেই হবে, ও বলছে হ্যাঁ রনিদা করতেই হবে। বলে আর দাঁড়ায় না। নিশ্চয়ই ওর ভেতরেও সেই খারাপ লাগাটা থাকে। কিন্তু ও যেটা চাইছে, সেটা না পাওয়া অবধি ও মেনে নেবে না। একজন পরিচালককে কী-কী টেনশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেটা তো একজন অভিনেতা হিসেবে আমি বুঝতে পারব না। আর সময়টাও তো বদলে গেছে। একদম শুরুর দিকে যখন তপন সিংহের সঙ্গে কাজ করেছি তখন সকাল দশটায় কাজ শুরু হয়ে বিকেল পাঁচটায় শেষ হচ্ছে এদিকে আমার ক্লোজ় আপ নেওয়া বাকি। উনি শান্ত স্বরে বলছেন, ছবি কি কালই রিলিজ় হবে নাকি! বলে চলে যাচ্ছেন। সেই ক্লোজ় আপ পরেরদিন নেওয়া হচ্ছে। এখন তো সেইভাবে কাজ হয় না। এমনও হয়েছে একদিন টানা ২১ ঘণ্টা শুট করেছি একটা ছবির জন্য। এখন তো এভাবেই কাজ হয়। আসলে পুরো পৃথিবীটা বদলে গেছে। দু’তিনটে যুগ কেটে গেছে। ছবির ধরণ বদলে গেছে। তাই আমরাও এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।