জলপাই থেকে জলপাইগুড়ি
পড়েই ভালোবেসে ছিলাম, সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’, সেই ছোটতেI ‘জলপাই’ শব্দটির সঙ্গে আলাপও তখনই। ক্লাস সিক্স-সেভেনেই জেনেছিলাম পশ্চিমবঙ্গে জেলার সংখ্যা সতেরোI এখনকার মতো তখন অবশ্য ছ-মাস ন-মাসে জেলার সংখ্যা বাড়ত না নিরন্তরI তাই সতেরোর মেয়াদ ছিল বেশ কিছুদিনI তবে জলপাই থেকে আসা ‘জলপাইগুড়ি’ তখনকার সতেরোতেও ছিল, এখনকার তেইশেও আছে। আছে ১৮৬৯ সালের ১ জানুয়ারী থেকেইI
এর আগে ডুয়ার্স গেলেও শহর জলপাইগুড়ি দেখার সুযোগ ঘটেনিI এবার ঘটে গেল এক অদ্ভূত ভূগোল ভ্রান্তিতেI আমার জেলা মুর্শিদাবাদ থেকে নাকি খুব কাছেই জলপাইগুড়ির অবস্থানI এটা ভেবে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও এক দায়িত্ববান আধিকারিক, সহধর্মিনীর গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ করলেন জলপাইগুড়িI সেটা গতবছরের ঘটনা। তখনও সুধানি ব্রিজ জলের তোড়ে ভাঙেনি আর উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলিও বিশ্রামে যায়নিI ফলে ভদ্রলোকের ভ্রান্ত ভূগোলে আমার বখাটে মন বড্ড মজা পেয়েছিল সেই সময়। তবে বন্যা পরবর্তী সময়ে সে মজা বেশ হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেলI
তিস্তা-তোর্সা বাতিল হলো। বাতিল হলো আমাদের টিকিটওI রেলের কাউন্টার হাসিমুখে পুরো টাকা ফিরিয়ে দিল মহানুভবতার পরিচয় দিয়েI আমি ভাবলাম অন্য কথা। নিজেদের প্রয়োজনে বা কোনও বাধ্যবাধকতায় আমরা যদি টিকিট বাতিল করি, তাহলে বর্তমানে রেল গুচ্ছের টাকা কেটে নেয় অবলীলায়, যদিও বাতিল হওয়া সেই টিকিট রেল পুনরায় বিক্রী করতে পারে পুরোদামেI তাহলে নিজেরা ট্রেন চালাতে অসমর্থ হলে, টিকিট মূল্যের সঙ্গে বর্ধিত জরিমানা কেন ফেরত দেবে না রেল? জানি, এধরণের প্রশ্ন আমার মতো মাথাখারাপ লোকেদের মাথাতেই আসে। তবে তা কাকস্য পরিবেদনা, উত্তর দেওয়ার দায় কারও নেই। যাইহোক, ভোর তিনটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বহু লড়াই করে, চলতি সিস্টেমের আদ্যপান্ত পিন্ডি উদ্ধার করে, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে যখন নামলাম, তখন পরদিন ভোর চারটেI মুর্শিদাবাদ থেকে জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম ২৫ ঘন্টায়I আধিকারিকের কথা মনে পড়েছিল, মনে মনে তাকে কি বলেছিলাম তা আপনাদের বলবো নাI
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
এর আগেও জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন পার হয়েছি, কিন্তু তখন এমন মুষলধারে বৃষ্টি হয়নি এখনকার মতোI ষ্টেশনের বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। আর স্টেশনের চায়ের দোকান তখনও খোলেনিI এ যে কি জ্বালা, জ্বলেছে যারা, তারাই বোঝেI চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে বসে পড়লাম স্টেশনেইI
সকাল হলো, বৃষ্টি ধৌত জলপাইগুড়ি একটু একটু করে উদ্ভাসিত হতে থাকল চোখের সামনে, আর অদ্ভূতভাবে অন্তরের আগুন ধীরে ধীরে নিভে গিয়ে শেষমেষ মনে হলো, এরই জন্য তো আসাI সকাল হলেও শহর জাগেনি তখনও অথবা বৃষ্টির গানে অ্যালারামের আওয়াজ চাপা পড়ে গেছেI
যারা এখনও জলপাইগুড়ি যাননি তাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করিI আচ্ছা, জলপাইগুড়ির কথা উঠলেই আপনাদের মাথায় কি গাছগাছালি ঘেরা কোনও শহরের ছবি মনের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে? ভেবে বলুন। আমার কিন্তু আসত এবং শহরটি ওই ক্যানভাসের মতোই সবুজI শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ড, কদমতলা মোড় ঘুরে আমাদের টুকটুক থামলো দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রোডের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের দুয়ারে। এখানেই আমাদের ডেরা বাঁধার কথাI
আজ একটা পরীক্ষা রয়েছে দুপুর দেড়টায়I আলোচনায় ঠিক হলো, আনন্দচন্দ্র কলেজে সহধর্মিনী ও সঙ্গে আসা আরও দুই ছাত্র আলতাফ ও পরাধীনকে রেখে এসে আমরা দুই বাপ বেটি স্রেফ ঘুমাবোI
সত্যজিৎ ও রেলভূত
বিরাট কলেজ আনন্দচন্দ্র। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তিরও আগে এর স্থাপনা, ১৯৪২ সালে, দেশ যখন গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তালI কলেজের ক্যান্টিনে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারা হলো। ক্যান্টিনের সঙ্গে আমাদের ছাত্রজীবনের চাওয়া পাওয়ার স্মৃতিগুলো গেঁথে থাকে। সেই সোনালী দিনগুলি আর প্রায় ঝাপসা হয়ে আসা বেশকিছু মুখ মনে এসেই মিলিয়ে গেলI কলেজে কোনও একটা চাকুরির পরীক্ষা চলছে এখন, তাই খাওয়া শেষ করে ক্যাম্পাসের বাইরে আমরা অপেক্ষা করতে থাকলামI জলপাইগুড়ি সংক্রান্ত একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে জানা গেল, আনন্দ চন্দ্র রাহুত ছিলেন শহরের বনেদী ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তানI জলপাইগুড়ির শিক্ষাপ্রসারে রাহুত পরিবারের দান অনস্বীকার্যI ওই পরিবারের উদ্যোগ ও জমিদানে, শহরবাসীর উচ্চশিক্ষার উদ্দশ্যেই এই কলেজের প্রতিষ্ঠাI
দুপুর থেকে সন্ধ্যে, রাত্রি থেকে ভোর, দুটো শিফটে ঘুমের জের কাটিয়ে একাই শহর দেখতে বেরোলাম সকাল সকালI তিস্তা ছাড়াও শহরের মধ্যদিয়ে করলা নদী প্রবাহিতI যে রাস্তা দিয়ে এখন বাস চলাচল করে, সে রাস্তায় একটি ব্রিজ রয়েছে, করলা ব্রিজI ১৯৬৮ সালের এক রাত্রে হঠাৎই তিস্তা ফুলেফেঁপে উঠে আসে শহরে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় অসংখ্য মানুযকে। ব্রিজটি তাদের প্রতি উৎসর্গীকৃতI ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে আপনার সুন্দরবনের কথা মনে পড়বে। দুপাশে সবুজ নিয়ে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে করলা, মিলে গেছে দূরে গিয়ে তিস্তারই সাথেI
করলা নদীর সমান্তরাল চলে গেছে কালেক্টরেট অ্যাভেনিউ। জেলাশাসকের আবাস সহ নানান সরকারি অফিস এই চত্বরেইI অফিস বিল্ডিংগুলি সম্ভবত ব্রিটিশ আমলের নির্মাণ, তার সৌন্দর্য ও শৈলী চোখ টানেI এ রাস্তার একপাশে করলা, অন্যপাশে তিস্তাI সেবকের করোনেশন ব্রিজ থেকে যে তিস্তাকে আপনি দেখেছেন সে এখন সমতলেI বাঁধে দাঁড়িয়ে, বা জুবিলী পার্ককে ডানহাতে রেখে একেবার চলে যেতে পারেন তিস্তার কাছে, তাকে আবাহন করতেI দূরে তাকালে আবছা হয়ে তিস্তা ব্রিজ ও তার ওপর চলাচলকারী গাড়ি নজরে আসবেI কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও ডুয়ার্সের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সংযোগকারী এই তিস্তা ব্রিজI পথমধ্যে প্রাতঃভ্রমণকারী শহরবাসীর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারেন, অথবা চুপচাপ বসে থেকে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত করতে পারেন রোমন্থনI
বেলা হলে, যা কিছু সকালে আমি দেখেছি, বাকিদের দেখানো হলোI তিস্তা উদ্যানে আমার কন্যা রায়া বেশ কিছুক্ষণ লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করে নিলI
সন্ধ্যে ঘনাল শহরে, ডেরায় ফেরার পথে সুভাষচন্দ্র সংগ্রহশালা নজরে পড়ল করলা ব্রিজের ঠিক ওপারেI নেতাজী সুভাষ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জলপাইগুড়িতে দেওয়া সুভাষচন্দ্রর ভাষণের ৭৫ বৎসর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি দুষ্প্রাপ্য স্থিরচিত্রের প্রদর্শনীও রয়েছে জলপাইগুড়ি স্টেশনেI
রয়েছে আধুনিক জীবনের নানান পসরা, শপিং মল, দোকান বাজারI শহরবাসীর সাজ পোশাক আধুনিক ও রুচিশীলI বাজার ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির সিংহদুয়ার ও সংলগ্ন দীঘিটি দেখে নিতে পারেন অথবা ৪নং গুমটির কাছে গোমস্তা পাড়ায় কালু সাহেবের দরগাI সংলগ্ন মসজিদটিও সুসজ্জিতI এ পথেই চোখে পড়বে আজাদ হিন্দ পাঠাগারI শহর থেকে এদিক সেদিক যাওয়ার সমস্ত বাস কদমতলা মোড়ে দাঁড়ালেই পেয়ে যাবেনI
দেবতার গ্রাস
আর যদি সবুজের সঙ্গে মাখামাখি করতে চান, তাহলে শহর লাগোয়া ডেঙ্গুয়াঝার চা বাগান যেতে হবে, গোশালা মোড় পেরিয়ে। গুডরিক কোম্পানীর চায়ের বাগান এটিI চায়ের পাতায় হাত বুলিয়ে, বুক ভরে তাজা অক্সিজেন নিয়ে, সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাড়িতে যার সঙ্গে মাখামাখি করেন, তার কথা ভুলে যানI
তবে মনে রাখবেন, প্রতিক্রিয়ার জন্য লেখক দায়ী নয়।
কিভাবে যাবেন: শিয়ালদহ থেকে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস ও দার্জিলিং মেল সরাসরি যায় জলপাইগুড়ি। এছাড়া অন্যান্য ট্রেনও রয়েছেI কলকাতা থেকে বিমান সংযোগে ১.১০ মিনিটে বাগডোগরা পৌঁছে যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন: তিস্তা পর্যটক আবাস, কদমতলায় নানান বাজেটের হোটেল রয়েছে। অথবা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ।
ছবি: লেখক