যে টনিক বোধহয় সবার অন্তত একবার প্রয়োজন
ছবি: টনিক
পরিচালনা: অভিজিৎ সেন
অভিনয়ে: দেব, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শকুন্তলা বড়ুয়া, তনুশ্রী চক্রবর্তী, সুজন নীল মুখোপাধ্যায়, কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বসু, পিঙ্কি বন্দ্যোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৪ মিনিট
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
জীবন সায়াহ্নে এসে নতুন করে বাঁচতে চাওয়া কি অপরাধ? কর্মজীবন থেকে অবসরের পর ছেলেমেয়ের অধীনে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াটা নিশ্চয়ই একমাত্র উপায় নয়। সারাজীবন ‘বাড়িতে বউয়ের ছ্যাঁকা, ছেলের বকা, পেটের অম্বল, আর রাতের কম্বল’ নিয়ে বেঁচে থাকা সত্যিই কষ্টের। ছোটবেলায় বড়দিনে স্যান্টাক্লজ় বা আলাদিনের প্রদীপের জিন যদি থাকত, তাহলে এক ঝটকায় হয়ত সবটা বদলে যেত। অসুখ সারানোর জন্য অনেক সময় টনিক খেতে হয়। তেমনই যদি জীবনের ইচ্ছেগুলো পূরণের টনিক পাওয়া যেত, তাহলে কেমন হতো? বর্ষীয়ান বাবা-মায়ের জীবনেও যে অনেক স্বপ্ন থাকতে পারে, সেটাই শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে দিল ‘টনিক’।
পঁচাত্তর বছর বয়সী জলধর (পরাণ) তার ছেলে পার্থর (নীল) নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। স্ত্রী উমা (শকুন্তলা) ঘরকন্না ও পুজোআচ্চা নিয়ে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় বাবা-মায়ের ৪৬তম বিবাহবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ছেলে। বাড়ির ছাদে সমস্ত আয়োজন করতে থাকে সে। কিন্তু বাবার কী ইচ্ছে সেটা পার্থ কোনওদিন জানতে চায়নি। অভিমানে, রাগে, দুঃখে ছেলের ওপর একপ্রকার প্রতিশোধ নিতেই জলধর ঠিক করে তাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করতে সে সস্ত্রীক প্যারিস যাবে। আর সেই সূত্রেই তাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে টনিক। ঘোষ নয়, বোস নয়, শুধুই টনিক। কাকা আর মাসিমার হনিমুনের দায়িত্ব নিয়ে কাজে লেগে পড়ে টনিক। শেষ পর্যন্ত প্যারিস যাওয়া আর হয় না। আইনি জটিলতায় উমার পাসপোর্টের দরখাস্ত বাতিল হয়ে যায়। পাশাপাশি চলতে থাকে একের পর এক মজার ঘটনা। বাঙালির অন্যতম প্রিয় ছুটির ঠিকানা, ‘দীপুদা’র ‘দা’, অর্থাৎ দার্জিলিং হয় গন্তব্য। ছেলে, বৌমা, নাতনিকে না জানিয়ে ভোররাতে বাড়ি ছেড়ে পালায় জলধর-উমা। এরপরই শুরু হয় গল্পের আসল মজা।
আরও পড়ুন: রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের
সাদাসিধে, নিপাট একটা ভালো গল্প রয়েছে গোটা ‘টনিক’ জুড়ে। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে দুজন মানুষের মধ্যে পিতা ও সন্তানের যোগসূত্র গড়ে উঠতে পারে, এমন কাহিনী নতুন নয়। আর ঠিক সেখানেই ‘টনিক’ যেন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। শারীরিক অসুস্থতার কথা ভেবে আমরা অনেকেই আমাদের বাবা-মাকে যেন একটু বেশিই আগলে রাখি। নিজেরা ভালোমন্দ খেলেও বাবা-মায়ের জন্যে বরাদ্দ থাকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। নিজেরা ছুটিতে ঘোরাঘুরি করলেও বাবা-মায়ের ঠান্ডা লাগবে ভেবে তাঁদের ঘরের ভিতরে আটকে রাখি। ভুলে যাই, বয়স হয়ে গেলেও তাঁদের ইচ্ছেগুলোয় মরচে ধরে না। হয়ত তাঁদেরও ইচ্ছে করে পাহাড়ের চড়াই ভাঙতে, র্যাফটিং করতে, বা প্যারাগ্লাইডিংয়ের অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হতে। মনের বয়স কারোরই বাড়তে চায় না। তাই অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে অন্তত একবার, ভীষণভাবে একজন ‘টনিক’-এর প্রয়োজন হয়। চাইলে আমরা সবাই সেই টনিক হয়ে উঠতে পারি।
এই ছবি শুধু পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এই বয়সে এসেও এরকম কঠিন স্টান্ট করার কথা ভাবার জন্য তিনি কী টনিক খেয়েছেন কে জানে! দুর্দান্ত কমিক টাইমিং তাঁর। একদম অন্যভাবে ধরা দিলেন দেব। নিজেকে ক্রমাগত ভাঙার চেষ্টা দেবের চোখেমুখে স্পষ্ট। তাঁর বাংলা উচ্চারণে অনেক উন্নতি লক্ষ্য করা গেল। নীল, কনীনিকা, পিঙ্কি, বিশ্বনাথরা যথাযথ। ট্রাভেল এজেন্টের ভূমিকায় ভালো লাগে তনুশ্রীকে। থানার বড়বাবু হিসেবে রজতাভ দত্তের উপস্থিতি বেশ উপভোগ্য। তবে অল্প সময়ের জন্য অম্বরীশ ভট্টাচার্য অভিনীত চরিত্রটার তেমন কোনও প্রয়োজন ছিল না। কিছু দৃশ্যের নাটকীয়তা একটু চড়া মনে হলেও, গল্পের খাতিরে তা মেনে নেওয়াই যায়।
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
বহুদিন পর বাংলা ছবির জন্য সঙ্গীত পরিচালনা করলেন জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। গানগুলি শুনতে বেশ ভালো লাগে।
যে কোনও ছবিতে গল্পই যে প্রধান নায়ক, সেটা আবারও প্রমাণ করল ‘টনিক’। পরিচালনায় এসেই সফল হলেন অভিজিৎ। ক্যামেরার কাজ মনোমুগ্ধকর। দার্জিলিংয়ের আনাচ-কানাচ দারুণভাবে ফুটে উঠল গোটা ছবিতে। বড়দিন এবং নতুন বছরের এই সময়টায় শরীর ও মন গরম করার জন্য এমন ‘টনিক’ই তো প্রয়োজন।