পরের দিন মিছিল বেরোলো, হাতে ‘পথের পাঁচালী দেখুন’ প্ল্যাকার্ড: তরুণ মজুমদার

কলকাতা: সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখে এসে পরের দিন এই ছবি দেখার জন্য মিছিল বার করেছিলেন তাঁরা কয়েকজন, এমনটাই জানালেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। ১৯৫৫ সালে মুক্তির পর রাতের শো-এ এই ছবি দেখেছিলেন তাঁরা।

সম্প্রতি শহরে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তরুণবাবু জানালেন, “আমরা জনা পাঁচেক তখন শ্যামবাজারে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতাম। আমাদের এক বন্ধু সুব্রত দাশগুপ্ত ‘পথের পাঁচালী’ দেখে এসে বলেছিল, ‘ছবিটা নেহাত খারাপ না, বেশ ভালোই। আরেকবার দেখতে হবে।’ সুব্রত কোনওদিনই কোনওকিছুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করত না। তাই ওর মুখে ‘বেশ ভালো’ শোনা অবাক করল আমাদের।”

প্রথমবার টেলিভিশনে অন্য ধরণের চরিত্রে ঋ

সেদিনই গভীর রাতের শেষ শো দেখে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তাঁরা। কারও মুখে কোনও কথা নেই। মনের মধ্যে অনেক ভাবনা, কিন্তু একটা শব্দও বেরোচ্ছে না কারও মুখ থেকে। সবকিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে। এমন ছবিও হয়? এমনও হতে পারে? রাস্তায় শুধু তাঁদের পাঁচ-সাতজনের লম্বা-লম্বা ছায়া আর জুতো ঘষটানোর আওয়াজ। দেশবন্ধু পার্কের রেলিং টপকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে বসলেন তরুণবাবু ও তাঁর বন্ধুরা। শহর তখন ঘুমোতে যাবে। কিছু দূরে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট থেকে মাঝেমধ্যে দু-একটা গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ কানে আসছে।

যে জন থাকে মাঝখানে

“অনেকক্ষণ পরে কেউ একজন বলে উঠল, ‘এই ছবিটা চলবে না একেবারেই।’ একমত হলাম সবাই। আমি বললাম, ‘চলা না চলা সেটা পাবলিকের ব্যাপার। এ যা ছবি, নাচ নেই গান নেই, চেনা কোনও আর্টিস্ট নেই। কী হয় দেখ।’ কিন্তু একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত হলাম। প্রেক্ষআগৃহ থেকে উঠে যাওয়ার আগেই এই ছবিটার জন্য কিছু একটা করা দরকার,” বললেন তরুণবাবু।

কাছেই ছিল তাঁদের আরেক বন্ধু নীলমণির বাড়ি। মাঝরাতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হইহল্লা জুড়লেন তাঁরা—পুরোনো খবরের কাগজ চাই, আলতার শিশি চাই, বাঁশের বাটামও লাগবে বেশ কয়েকটা, সঙ্গে গদের আঠাও—দাবির শেষ নেই।

কেশব কাশ্মীরি হয়ে আসছেন নীল মুখোপাধ্যায়

“পরের দিন,” স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন তরুণবাবু, “দেশবন্ধু পার্ক থেকে বেরোলো আমাদের ১২ জনের একটা ছোট্ট মিছিল। কোনও স্লোগান নেই, চিৎকার নেই। সবার হাতে একটা করে প্ল্যাকার্ড, ‘পথের পাঁচালী দেখুন, পথের পাঁচালী দেখান।’ আমরা হাঁটছি, সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। বলতে বাধা নেই, লজ্জাও করছে একটু-একটু। এমন দর্শন নিয়ে দর্শনীয় পথচলার অভিজ্ঞতা তো আগে কখনও হয়নি। মিছিল যখন সার্কুলার রোড পেরিয়ে ফড়িয়াপুকুরে ঢুকল, হঠাৎ আশপাশ থেকে আরও দু-তিনজন আমাদের লাইনে ঢুকে পড়ল। বোঝা গেল, এরাও ইতিমধ্যেই ছবিটা দেখে ফেলেছেন। কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ও তারপর শিকদার বাগান মোড় থেকে আরও কয়েকজন যোগ দিল। সংখ্যাটা বাড়তেই থাকল। হাতিবাগান মোড়ে এসে দেখা গেল প্রায় পঞ্চাশজনের বেশি লোক হয়ে গেছে। আমাদেরই আরেক বন্ধু সুনীল মৈত্র সেই ১২ জনকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘ব্যাস, মিশন সাকসেসফুল। এবার প্ল্যাকার্ডগুলো ওদের হাতে ধরিয়ে দাও, আমরা বরং একটু চা খাই।’

কাছেই একটা ছোট রেস্তোঁরায় বসে চা খাচ্ছিলেন তরুণবাবুরা। খানিক্ষণ পর দেখলেন, মিছিলটা আবার সেইখানেই ফিরে আসছে। মাথার সংখ্যা ততক্ষণে ৭০ ছাড়িয়ে গেছে।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *