ঠিক বেঠিকের ঊর্ধ্বে উঠে অন্য তত্ত্ব
ছবি: হেমন্তের অপরাহ্ন
পরিচালনা: অশোক বিশ্বনাথন
অভিনয়ে: সত্যপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, অনুষা বিশ্বনাথন, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, মেঘলা দাশগুপ্ত, সোহিনী দাশগুপ্ত
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★☆☆☆☆
নাটকের মধ্যে সিনেমা আদৌ কতটা উঠে আসে জানা নেই। তবে সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু ছবির ভেতর দিয়ে উঠে আসছে নাটকের মঞ্চ। ‘হেমন্তের অপরাহ্ন’ও (Hemanter Aparanha) তেমনই একটি ছবি। ভারতীয় সভ্যতায় চাকরিজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর মানুষ ক্রমশ বিশ্রাম নেবে, সাত্বিক জীবন যাপন করবে, ঘরে বাইরে নিরাসক্ত হয়ে উঠবে, আধ্যাত্মিকতাকে আশ্রয় করবে এবং বুড়িয়ে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশিত, অথবা নির্ধারিত থাকে। কিন্তু যদি তেমনটা না হয়, কেমন হবে সেই জীবন? অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি নিজে কী চান? শরীরের সঙ্গে মনেও কি প্রৌঢ়ত্ব আসে?
‘হেমন্তের অপরাহ্ন’ ছবির কাহিনি সুধীনবাবুর (সত্যপ্রিয়) অবসর জীবন নিয়ে। ব্যস্ততাহীন জীবনে একা একাই দিন কাটছিল তার। স্ত্রী (বিদীপ্তা) মারা গেছেন, ছেলে বিদেশে। হঠাৎই পাড়ার কিছু ছেলেমেয়ের জোরাজুরিতে তাদের নাটকের দলে যোগ দিলেন তিনি। সেখানেই আলাপ বিশ্বজিৎদা (অশোক), রাজেশ (ঋতব্রত), ইন্দ্রাণী (মেঘলা) ও পাপিয়ার (অনুষা) সঙ্গে। একটি ইতালীয় নাটকের মহড়ায় ক্রমশ জড়িয়ে পড়তে থাকলেন তিনি। জড়ালেন নাটকের কুশীলবদের সঙ্গেও। এর মধ্যেই এলো করোনা অতিমারী ও লকডাউন। জীবন বদলে গেল সবার।
মতের অমিল এবং সেই কারণে সৃষ্টি হওয়া ভুল বোঝাবুঝি থেকে মানুষে-মানুষে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রবণতা থাকে। হয়ও প্রায় প্রতিদিন। দেশে-দেশে না লাগুক, বর্তমানে সর্বত্রই যেন পঞ্চম রিপু প্রতিষ্ঠার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলেছে। এই সময়ে দাঁড়িয়েই এর একেবারে বিপরীতে চলতে চেয়েছেন অশোক। নানাভাবে তাঁর ছবি এটাই বোঝাতে চায়, প্রেক্ষিত বা দর্শন যাই হোক না কেন, দু’রকমের মতামতে কোনও একজন নিজেকে সঠিক হিসেবে দাবি করলেও তাকে শুধুমাত্র আপেক্ষিক হিসেবেই দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ গেলাস অর্ধেক খালিও যেমন সত্যি তেমনই তা অর্ধেক ভর্তিও সত্যি। পার্থক্য দৃষ্টিকোণের হতে পারে, কিন্তু তার জন্য অন্যদিকের মতামতকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আরও পড়ুন: সিক্যুয়েলে নেই দীপিকা
একই ধরনের সংলাপ নাটকের দলের ক্ষেত্রেও বিশ্বজিতের চরিত্র প্রয়োগ করছে যেখানে নাটকটি ইতালীয় প্রেক্ষাপটে হবে নাকি তার বঙ্গীয়করণ হবে, সেখানে তিনি যেমন নিজের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তেমনই আর একজনের মতকেও ফেলে দিচ্ছেন না। অর্থাৎ ভুল কেউই নয়, শুধু দৃষ্টিভঙ্গিটুকু আলাদা। নাটকের চরিত্রগুলোও যেন সেই একই কথার প্রতিধ্বনি করতে থাকে। নাটকের নামটিও এখানে প্রাসঙ্গিক, ঠিক তো ঠিক! বস্তুত দেশে-দেশে যুদ্ধ লাগার ক্ষেত্রেও এই নিজের মতামতকেই প্রামাণ্য ধরে চলার সমস্যাই মূল কারণ।
ছবির কাহিনিও কিছুটা সেই প্রেক্ষিত দেখিয়ে দিয়ে যায়, যেখানে সুধীনবাবু কোনও এক সম্পর্ককে যেভাবে দেখছেন সেটা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, উল্টোদিকে সেই ব্যক্তি তাঁকে যেভাবে দেখছে সেই দৃষ্টিভঙ্গিও সত্যি। দুজনের দর্শন নাই মিলতে পারে, কিন্তু মিথ্যে হয়ে যায় না কোনওটাই। কিংবা হয়তো সময় বলে দেয় কোনও একজন সঠিক ছিল। আবার শুটিং দেখতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন সুধীনবাবু, দর্শকের মনে হতেই পারে এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক এবং এর ফলে আঘাত পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এখানেও সেই দু’রকম দৃষ্টিকোণ এসেই যায়।
একইসঙ্গে আসে একজন একা মানুষের একাকীত্ব এবং অতিমারী পর্যায়ে সাধারণভাবে তৈরি হওয়া নাগরিক একাকীত্ব। ছবিতে খুব স্বাভাবিকভাবে এসেছে করোনা সময়ে সাধারণ মানুষের অবস্থা, যা এই ২০২৪-এও মানসিক চাপের সৃষ্টি করবে। সেই নিষ্ক্রিয় সময়ের ভেতর থেকেই ক্রমশ বেরিয়ে আসতে থাকে সৃষ্টিশীলতা। করোনার দোহাই দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে বেঁধে রাখতে চাইলেও একটা সময়ের পর বাঁধন ছিঁড়ে মানুষ নিজেই বেরিয়ে আসতে পেরেছিল, অনেকটা সুধীনবাবুর একাকীত্বের মতো। যদিও ছবির শেষ কোনও রাস্তার হদিশ দিতে চায়নি তবু এই নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়েই বয়ে চলে জীবন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ছবির কিছু অংশ বেশ দুর্বোধ্য। বিশেষ করে বিদীপ্তার যাওয়া-আসার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সোহিনীর আগমন হয়েছে। অথচ সোহিনী চরিত্রের কোনও রেফারেন্স কোথাও ছিল না। ঘরে টাঙানো ছবি থেকে আন্দাজ করা যায় বিদীপ্তা সুধীনের স্ত্রী, তবে কি সোহিনী নিছকই কল্পনা? কল্পনা হলেও আর একটু স্পষ্ট হতে পারত এই চরিত্রটি। এরকম দুর্বোধ্যতা আরও কিছু জায়গায় রয়েছে, যা বর্জন করা গেলে ভালো হতো।
আরও পড়ুন: জ়োরাম্বো হতে পারলেন না মোগাম্বো
সত্যপ্রিয়র অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর ভেতর দিয়ে বাংলা ছবি একজন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা পেতে পারে। তাঁর ঘোড়ায় চড়ার দৃশ্য ছবিটিকে অন্য মাত্রা দেয়। এমন বিরল গুণের অধিকারীও খুব একটা দেখা যায় না। ছবির অন্যান্য চরিত্রে ঋতব্রত, অনুষা, মেঘলা সকলেই যথাযথ। শরীরী ভাষার স্বতঃস্ফূর্ততায় ভালো লেগেছে ঋতব্রতকে। অনুষা এবং মেঘলা উভয়েই অভিনয়ের জোরে আগামীদিনের তুরুপের তাস হয়ে উঠতে পারেন। বিদীপ্তার চরিত্রের প্রায় কিছুই করার ছিল না। সোহিনীর মণিপুরী নৃত্যশৈলীতে প্রতি রাতের সিলিউট মুগ্ধ করবে দর্শককে।
ছবির বক্তব্য রীতিমতো প্রাসঙ্গিক এবং অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছনো জরুরি হলেও চিত্রনাট্যের দুর্বোধ্যতার কারণে হয়তো পৌঁছবে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য যে বার্তা ছবিতে নানাভাবে ঘুরেফিরে এসেছে তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য আরও কিছুটা সহজ হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল। তবে এ ছবি দর্শককে ভাবতে বাধ্য করবে, যদি সেই ভাবনার অবকাশ আদৌ উক্ত ব্যক্তির থেকে থাকে।