সবই বৃথা তোমায় ছাড়া

এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন সবটা মিথ্যে। এখনই হয়তো তিনি ফিরে এসে বলবেন, ‘আছে, আছে তোমাদের সবার টেলিপ্যাথির জোর আছে।’ মৃত্যু যেমন অনিবার্য তেমনই বেদনাদায়ক। এ যেন এক যুগের অবসান। সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। লিভিং লিজেন্ড থেকে আজ লিজেন্ড হয়ে গেলেন তিনি।

বিনোদন সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করার পর স্বপ্ন ছিল একদিন তাঁকে দেখব। কাজের সূত্রে দেখা হলো বারকয়েক। কিন্তু সেভাবে তার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ এলো না। সেট হলো গত ডিসেম্বরে, পরিচালক অনীক দত্তর বাড়িতে। তখন অনীকদার ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ মুক্তির অপেক্ষায়। ঘরোয়া সেই আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন বিদীপ্তা চক্রবর্তী, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র নিজে। চুরাশি পেরিয়েও যাঁকে দেখলে আপনা থেকেই ‘ফেলুদা’ বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। অনায়াসে যিনি দাপিয়ে বেড়াতেন বাংলা নাটক ও ছবির জগত। বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যিনি অহরহ নিজের সঙ্গে লড়াই করে যেতেন।

আরও পড়ুন: যন্তর মন্তর কক্ষের নেপথ্যে

তখন সবেমাত্র নিউমোনিয়া সারিয়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরেছেন সৌমিত্র। হাতে স্যালাইনের চ্যানেলের দাগ স্পষ্ট। স্বপ্নপূরণ হলো। কথার ফাঁকে বলেছিলেন তাঁর ছোটবেলার কথা। কীভাবে বাবা-কাকাদের ভয়ে ‘বড়দের ছবি’ দেখতে পেতেন না। সেইসময় নায়ক-নায়িকার প্রেমের দৃশ্য থাকা সিনেমা মানেই তার সঙ্গে জুড়ে যেত ‘বড়দের ছবি’র তকমা। এরপর কেটে প্রায় একটা বছর। তবু আজ সকাল থেকেই ডিসেম্বরের সেই দিনটার কথা বড় বেশি মনে পড়ছে।

অম্লান হাসি, মায়াভরা চোখের চাহনি আর ছিপছিপে চেহারার ছেলেটাকে দেখেই সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘অপু’কে চিনতে পেরেছিলেন। ‘অপুর সংসার’-এর নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে রুপোলি জগতে পা রাখলেন আপামর বাঙালি দর্শকের প্রিয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর তাঁকে দেখা গেল ‘ঝিন্দের বন্দী’র খলনায়ক ময়ূরবাহনের চরিত্রে। খলনায়ক হওয়া সত্ত্বেও ময়ূরবাহন বাংলা ছবির একটি কাল্ট চরিত্র।




চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাংলা থিয়েটারে, কবি এবং আবৃত্তিকার হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সৌমিত্র। কখনও রোম্যান্টিক নায়ক কিংবা মগজাস্ত্র প্রয়োগকারী গোয়েন্দা, কখনও বা অত্যাচারী শাসককে উচিত শিক্ষা প্রদানকারী শিক্ষক উদয়ন পণ্ডিত। আবার বয়সকালে বিভিন্ন ছবিতে নায়িকার বড়লোক দাম্ভিক বাবার চরিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি। 

সৌমিত্র অভিনীত ফেলুদা যেন সত্যজিৎ রায়ের অলটারইগো। একবার এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ফেলুদার সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কতটা একাত্মবোধ ঘটেছে? উত্তরে সৌমিত্র জানান, “আমি ফেলুদার সঙ্গে ততটা একাত্ম হতে পারি না যতটা অপু বা গঙ্গাচরণের সঙ্গে পারি।”

অনীকদার বাড়ির সেই আড্ডার মাঝে সাহস করে সৌমিত্রকে একটা প্রশ্ন করেই ফেলেছিলাম, “আচ্ছা, আপনি তো এখনও ফেলুদা হতে পারেন। হোক না বয়স্ক, আমাদের কাছে তো ফেলুদা রক্তমাংসের মানুষ, পাশের বাড়ির ছেলে। ফেলুদার বয়স বেড়ে গেছে মেনে নেব আমরা।” উত্তরে তাঁর সেই সিগনেচার হাসি হেসে সৌমিত্র বলেছিলেন, “হতে তো পারি, কিন্তু বয়স্ক ফেলুদার গল্প লিখবে কে? কেউ সেরকম গল্প লিখুক, নিশ্চয়ই ফেলুদা করব।” সত্যিই এরপর হয়তো এরকম গল্প লেখা হবে, কিন্তু প্রথম ফেলুদা তখন আমাদের থেকে আলোকবর্ষ দূরে।

আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ

ভারতবর্ষের বিপুল জনসমষ্টির জীবনের কত গল্পই যে বাংলা ছবিতে দেখানো হয় না, এ নিয়ে এককালে আক্ষেপ ছিল সৌমিত্রর। সেইসময় গোয়েন্দা বা ছোটোদের জন্য ছবির সংখ্যা যেমন কম হতো, তেমনই বাংলা ছবিতে জীবনের সত্যিকারের পরিচয় অনেক বেশি দুর্লভ ছিল বলে মনে করতেন তিনি।  বলতেন, কত আগ্নেয় বিষয় পড়ে আছে ছবিতে সমর্পিত হওয়ার জন্য, সত্যজিতের মতো সেইসব বিষয়বস্তুকে বারবার স্পর্শ করা হোক বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, এতে সত্যিকারের দেশবাসীর জীবনকে ব্যক্ত করবে। পরবর্তীকালে হয়তো বাংলা চলচ্চিত্রের ধারা উন্নত হয়েছে। তাঁর সেই আশা কিছুটা হয়তো কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে অনেকক্ষেত্রে তাঁরই হাত ধরে। ভবিষ্যতে আরও পথ চলা বাকি, কিন্তু তিনি আর নেই।

উৎসবের মাঝে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের বিশাল গুরুদায়িত্ব তাঁরই অসংখ্য অনুজদের কাঁধে চাপিয়ে চলে গেলেন সৌমিত্র। ২০২০ কেড়ে নিল অনেক স্বজনকে। আজ যেন সত্যিই বলতে ইচ্ছে করছে, ‘এত আনন্দ আয়োজন, সবই বৃথা তোমায় ছাড়া।’

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *