“শিল্পীর কাজ মুখের সামনে আয়না ধরা, সমাজ সংস্কার করা নয়”
রাতের অন্ধকারে, বাড়িতে বন্ধুর মৃতদেহ কেটে টুকরো করছে সত্য আর কাবেরী। সেই মাংসের টুকরো পড়ছে বাড়িওয়ালার কাঁধে। শহরজুড়ে শীতের আমেজ। তার মধ্যেই হাড়হিম করা ট্রেলার নিয়ে হাজির টিম ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ (Bhagyolokkhi)। রেডিওবাংলানেট-এর সামনে পরিচালক মৈনাক ভৌমিক ও অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন শোলাঙ্কি রায় (Solanki Roy)।
প্রশ্ন: সাদামাটা শাড়িপরা এক গৃহবধূ, স্বামীর সঙ্গে মিলে কেটে টুকরো করছে বন্ধুর মৃতদেহ! চিত্রনাট্য শুনে প্রথমে কী মনে হয়েছিল?
শোলাঙ্কি: এরকম একটা জিনিসের জন্য আমি অনেকদিন অপেক্ষা করছিলাম! কারণ আমি আজ পর্যন্ত যে সব চরিত্রে কাজ করেছি সেগুলো খুব সফ্ট। বাংলা ছবিতে এরকম একটা জিনিস যে ভাবা যেতে পারে, এই ব্যাপারটাই আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল।
প্রশ্ন: তুমি এত শান্ত, সৌম্য। কাবেরী চরিত্রের জন্য কি ওয়ার্কশপ করেছিলে কোনও?
শোলাঙ্কি: সে তো আমরা সবাই শান্ত। তবু তো আমরা ‘ও মাই গড’ পরিস্থিতিতে পড়ি। যাইহোক, ওয়ার্কশপের সময় তো সেভাবে পাওয়া যায় না বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে, জানোই তো। আমি নিজে ওই কাবেরী চরিত্রটাকে তৈরি করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর স্রেফ ওই চরিত্রের মতোই রিয়্যাক্ট করছিলাম। আর মৈনাকদা তো ছিলই।
প্রশ্ন: মৈনাকের সঙ্গে এটা প্রথম কাজ?
শোলাঙ্কি: হ্যাঁ। ঋত্বিকদা, লোকাদার (লোকনাথ দে) সঙ্গেও প্রথম।
প্রশ্ন: মৈনাক-ঋত্বিক জুটি এর আগেও বড়পর্দায় বাজিমাত করেছে। তাঁদের সঙ্গে তোমার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
শোলাঙ্কি: আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় ভারতবর্ষে যে কয়েকজন প্রথম সারির অভিনেতা আছেন, ঋত্বিকদা তাঁদের মধ্যে একজন। এবং বাংলায় সেরাদের মধ্যে অন্যতম তো বটেই। সেক্ষেত্রে, এরকম একজন অভিনেতার সঙ্গে কাজ পাওয়ার সুযোগটাই একটা বড় ব্যাপার। আমি আর কী বলব! ঋত্বিকদা একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। এবং মৈনাকদাও। কেউই এক্সট্রোভার্ট নয়। দুজনের অনেকদিনের বন্ধুত্ব। মানুষের সঙ্গে মিশে গেলে ওরা খুব সহজ। আর বেশিরভাগ আড্ডাটা ওরাই করতো। আমি শুনতাম বসে। দুজনেই খুব পড়াশোনা করে। ফলে আমাদের গল্পের বিষয় খুঁজতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আমার সঙ্গে স্বস্তিকা (দত্ত), লোকাদা, দেবপ্রিয় (মুখোপাধ্যায়), নীলদা (সুজন মুখোপাধ্যায়) সকলেই ছিল। আমরা হইহই করে কাজ করেছি। সিনেমাটা খুব ডার্ক। তবে পর্দার পেছনে তেমন একেবারেই ছিল না।
আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান
প্রশ্ন: খবরে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু নৃশংসতার ঘটনা শোনা ও দেখা যায় আজকাল । মানুষ ক্রমে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে বলে মনে হয়?
শোলাঙ্কি: আমার মনে হয়, মানুষ সুখী হতে পারছে না কিছুতেই। আমাদের বাবা-মা, তাঁদের আগের প্রজন্ম বা তারও আগে, তাঁরা কিন্তু আলগোছা আটপৌরে বাঙালি জীবনেই খুশি ছিলেন। ছোটখাটো আনন্দ জড়িয়েই বেঁচেছেন তাঁরা। কিন্তু এখন মানুষের জীবনে চাহিদা অনেক বেশি। এবং সেটা পূরণ করতে না পারার হতাশাটাও অনেক বেশি। পাল্লা দিয়ে যেভাবে চাহিদা বাড়ছে, একইভাবে তো আর মানুষের রোজগার বাড়ছে না। ফলে এসকেপ রুট খুঁজছে মানুষ। বিদেশি ওয়েব প্ল্যাটফর্মগুলোতে দেখো, রমরমিয়ে থ্রিলার চলছে। সবাই সেগুলো দেখছে, ভালোবাসছে। আসলে কোথাও না কোথাও ভায়োলেন্স মানুষকে আর সেইভাবে নাড়া দিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে নাড়া দেওয়ানোর জন্য পর্দায় ভায়োলেন্সের মাত্রা বাড়ানো হচ্ছে। সিনেমা কোথাও গিয়ে তো সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। আসলে সমাজেও ভায়োলেন্স বাড়ছে। একটা পর্যায় গিয়ে মানুষ খুব একা আর মরিয়া হয়ে যাচ্ছে বলেই এগুলো হচ্ছে বলে আমার ধারণা।
‘ভাগ্যলক্ষ্মী’ ছবিতে, ঋত্বিকের সঙ্গে
প্রশ্ন: এতটা ভায়োলেন্স না হয়ে যদি মানুষকে রুটেড হওয়ার কথা থাকত ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’র চিত্রনাট্যে, তুমি কি রাজি হতে না?
শোলাঙ্কি: দেখো, হলে অসুবিধা হতো না। তবে আমার কী মনে হয় জানো তো, শিল্পীর কাজ কিন্তু সমাজ সংস্কার করা নয়। সমাজ সংস্কারক মানুষ নিজেই। শিল্পীর কাজ হচ্ছে মুখের সামনে আয়নাটা ধরা। আর সেই কাজটাই খুব ভালোভাবে করেছে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’। আগের কথার সূত্র ধরেই বলছি, মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা কমছে তার কারণ কিন্তু এটা নয় যে তারা বিভিন্ন বিনোদন মাধ্যমে তা দেখছেন। কমছে, তার কারণ হলো এটা চারপাশে খুব ভীষণভাবে হচ্ছে। এখন ভায়োলেন্স খুব স্বাভাবিক। মানুষের মধ্যে এ নিয়ে কোনও অনুতাপ বা অনুশোচনা নেই। কিন্তু কী করা উচিত বা কোনটা করা যায় না, এটা সম্পূর্ণ মানুষের নিজস্ব বোধ।
প্রশ্ন: তুমি তো মুম্বই থাকছ, ওখানে কাজের কথা কিছু এগোলো?
শোলাঙ্কি: না, সেরকম কিছু এগোয়নি। আসলে ওখানে কাজের ধরনটা একেবারেই আলাদা। লম্বা প্রসেস। সময় লাগবে।
আরও পড়ুন: বাঙালিরা কোনও কিছুর আর্কাইভাল মূল্য বোঝে না, ক্ষোভ গৌতমের
প্রশ্ন: বাংলায় নতুন প্রোজেক্ট কী?
শোলাঙ্কি: সৃজিত রায়ের পরিচালনায় ‘বিষহরি’ সিরিজ় মুক্তি পাবে মার্চে। আমার অভিনীত চরিত্রটা একজন মহিলা গোয়েন্দার, যিনি প্যারানর্মাল কিছু রহস্যের সমাধান করবেন। বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল গল্পটা। সৃজিতদার এটা প্রথম ওয়েব শো।
প্রশ্ন: নতুন বছরে একেবারে নতুন করে আবিষ্কার করতে চাইছ নিজেকে?
শোলাঙ্কি: একদম তাই। ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’র ট্রেলার নিয়ে আমার খুব টেনশন ছিল। কারণ এই সাইকোলজিক্যাল ভায়োলেন্স মানুষ কীভাবে নেবে সেটা নিয়ে টেনশনে ছিলাম। তবে যা ভিউজ় এবং ফিডব্যাক পাচ্ছি, তাতে খুবই ভালো লাগছে। আমি খুবই আশাবাদী। আর মৈনাকদা খুব যত্ন করে ছবিটা বানিয়েছে। একটা সিনেমা মানে শুধু চিত্রনাট্য, পরিচালনা আর অভিনয় তো নয়। সেখানে সাউন্ড, আলো, সব টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্ট জড়িয়ে। সবকিছু নিপুণভাবে ডিজ়াইন করে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’র গল্পটা বলা হয়েছে। আশা করি সকলের ভালো লাগবে।