ছবির সংখ্যা বাড়ানোর ইঁদুর দৌড়ে বিশ্বাসী নই: রণদীপ
প্রথম ছবি নট এ ডার্টি ফিল্ম ভালোই সমাদর পেয়েছিল দর্শক মহলে। তিন বছর পর মুক্তি পেতে চলেছে দ্বিতীয় ছবি নূপুর। বিষয় ভাবনায় নূপুর আগের ছবি থেকে একেবারেই আলাদা। একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিচালক রণদীপ সরকার রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন তার ছবির গল্প এবং কেন এই দীর্ঘ বিরতি।
দর্শক তো রণদীপ সরকার-কে ভুলে গেছে
মানে?
২০১৫-তে নট এ ডার্টি ফিল্ম-এর তিন বছর পর নূপুর। দর্শক তোমাকে মনে রাখবে কেন?
বুঝিয়ে বলো।
টালিগঞ্জে যেখানে বছরে পিঠোপিঠি ছবি করাই দস্তুর, সেখানে তিন বছরে তোমার মাত্র দুটো ছবি
দেখো, একটা কথা পরিস্কার করে দিই। শুধুমাত্র সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ছবি করার ইঁদুর দৌড়ে আমি বিশ্বাসী নই। আমি তখনই একটা ছবিতে হাত দিই যখন দেখি তার বিষয়বস্তু আমার আগের ছবির থেকে আলাদা। আজকাল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই ধরণের ছবি তৈরি করছে সবাই। অধিকাংশ ছবিতেই একটা ভীষণ পালিশ করা, মেকি শহুরে ছাপ। আজ থেকে অনেক বছর পর, এই সব পরিচালকের কটা ছবি মনে রাখবে দর্শক? এরকম ছবি তৈরির কোনও সার্থকতা আছে বলে আমার মনে হয় না।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
কেন? লোকে এইসব ছবি দেখছে না?
কোথায় দেখছে (উত্তেজিত)? যদি দেখত, তাহলে দু’সপ্তাহ চলার পর সেই ছবি কখনও হল থেকে সরে যায়? আর সরে যাওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে কখনও তার টেলিভিশন প্রিমিয়র হয়? একটা হলে কোনওরকমে ছবিটা টিকিয়ে রেখে, ‘সাড়ম্বরে চতুর্থ সপ্তাহ’ ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। দেখো গিয়ে, এই হলটা হয়ত সুদূর মফঃস্বলে কোথাও। প্রচুর ছবি তৈরি হচ্ছে ইদানিং। কিন্তু মনে ছাপ রেখে যাওয়ার মত একটাও নয়।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
সেই জন্যই বিরতি?
অবশ্যই। নট এ ডার্টি ফিল্ম-এর পর বহু প্রযোজকই আমাকে বলেছিলেন ওইরকম শহর-কেন্দ্রিক ছবি বানাতে। অনেক প্রথম সারির প্রযোজকও ছিলেন তাদের মধ্যে। কিন্তু আমি যে ধরণের ছবি ইতিমধ্যেই বানিয়ে ফেলেছি, সেই একই জঁর-এর ছবি করে নিজেকে রিপিট করব কেন? শহর কলকাতার অন্ধকার দিকটা আমি তুলে ধরেছিলাম নট এ ডার্টি ফিল্ম-এ। তাই আমি সব প্রযোজককেই বলেছিলাম আমার পরের ছবির বিষয় আগেরটার থেকে ভিন্ন হবে, এবং সেটা একেবারেই নিজের মত করে করব। বলতে দ্বিধা নেই, নূপুর-এর গল্প শুনে অনেকেই পিছিয়ে যায়।
তাশি গাঁওয়ে একদিন
সে তো যাবেই। স্টার নেই, কোনও চেনা মুখ নেই
আমার অভিনেতা দরকার, স্টার নয়। ক্যামেরার সামনে আমি যেমনটা চাইছি, ঠিক তেমনটাই করে দেখাতে পারবে, এমন লোক দরকার আমার। সেই জন্যই আমি সবসময় অভিনেতা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছি। আর স্টারের কথাই যদি বলো, নট এ ডার্টি ফিল্ম-এ তো সব প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা নিয়েই কাজ করেছি। সাহেব ভট্টাচার্য, মুমতাজ় সরকার, রজতাভ দত্ত, খরাজ মুখোপাধ্যায়, এরা সবাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। গল্পের দাবী অনুযায়ী আমার অভিনেতা দরকার। জোর করে কোনও স্টারকে সই করানোতে আমি বিশ্বাসী নই। তবে নূপুর-এ চেনা মুখ নেই এই কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। অন্যতম প্রধান চরিত্রে শুভজিৎ কর অভিনয় করেছে। শুভজিৎ বাংলা টেলিভিশনের অতি পরিচিত মুখ। বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ধারাবাহিকে ভালো কাজ করেছে। এছাড়া বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, দেবিকা মুখোপাধ্যায়ের মত শিল্পীরা রয়েছেন।
Advertisement
ছবির নাম নূপুর কেন?
যে দুটি মানুষের ভালোবাসার গল্প নিয়ে এই ছবি, তাদের নাম বংশী ও নূপুর। ছোটবেলা থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। দুজনেই মুক ও বধির। জয়দেবের গীতগোবিন্দ থেকে অনুপ্রাণিত এই ছবি। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধা যখন ছুটে আসত, তখন তার নূপুর বেজে উঠত। ছুটে আসার জন্য পরিবর্তন হতো সেই নূপুরের ছন্দ, এবং আশ্চর্যভাবে পাল্টে যেতে থাকত কৃষ্ণের বাঁশির সুর। বংশী ও নূপুরকে যখন পর্দায় দেখা যায় তখন আবহে গীতগোবিন্দ বাজতে থাকে। নূপুরের চরিত্রে অভিনয় করেছে তনুশ্রী। এটাই বড় পর্দায় ওর প্রথম কাজ। একটা অত্যন্ত সহজ, সরল, গ্রাম্য প্রেমের ছবি বানিয়েছি আমরা। পটভূমি সাতের দশকের পুরুলিয়া।
গীতগোবিন্দ কি সংস্কৃততেই থাকছে?
না, বাংলায়। সংস্কৃততে দিলে দর্শকের বুঝতে অসুবিধা হতো। সাবটাইট্ল লাগত। তাতে ছবি দেখার সমস্যা হতো। তাই বাংলা ব্যবহার করেছি আমরা।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
গ্রাম তো অনেকই আছে বাংলায়। পুরুলিয়া কেন?
চিত্রনাট্য লেখার পর আমরা অনেক জায়গাতেই লোকেশন দেখতে যাই। প্রত্যেকটি জায়গাই নিজের মত করে সুন্দর। কোনওটার সঙ্গে কোনওটার তুলনা চলে না। কিন্তু পুরুলিয়াতে গিয়ে বুঝতে পারি ঠিক যেরকম চাইছিলাম, সেটাই বিছিয়ে দেওয়া আছে চোখের সামনে। পুরুলিয়ার প্রাকৃতিক বৈপরীত্য অসাধারণ। শস্য শ্যামলাও আছে, আবার রুক্ষ পাথুড়ে মালভূমিও আছে। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পুরুলিয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ছৌ নাচের দৃশ্যও আছে এই ছবিতে। তাই পুরুলিয়া ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে যায় নূপুর-এ।
পুরো ছবিটাই তো আসল লোকেশনে শ্যুট
একদম। কোনও সেট তৈরি করিনি আমরা। দর্শক পুরুলিয়া নিজে ঘুরতে গেলে যেভাবে দেখবেন, সেই একই অনুভূতি পাবেন আমাদের ছবি দেখলে।
দেবতার গ্রাস
প্রধান দুটি চরিত্র মুক ও বধির। এটার কারণ কি?
যারা কথা বলতে ও শুনতে পারে তারা তাদের প্রেমের প্রকাশ কথার মাধম্যেই করে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে এটা প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলেছিল, শ্রবণ ও বাকশক্তি রহিত যারা, তারা ভালোবাসার প্রকাশ কিভাবে করবে? না কি সেটা তারা একেবারেই করতে পারবে না? এরকম একটা চিন্তাভাবনা থেকেই এই ছবিটা করার কথা আমার মাথায় আসে। নূপুরের হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে জানতে পারলাম, একজন মুক ও বধির মানুষ যখন এরকম কারোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যে কথা বলতে ও শুনতে পারে, তখন সেই প্রথম মানুষটি দ্বিতীয়জনের কথা বলার সময় ঠোঁটের মুভমেন্ট লক্ষ্য করে। সেই থেকেই এরা বুঝতে পারে দ্বিতীয় মানুষটি কি বলতে চাইছে। এটা তাদের ছোট থেকেই শেখানো হয়। এই বিষয়টাও খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল আমার। এইসব মিলিয়েই ভিন্ন ধরণের একটা ছবি করার সিদ্ধান্ত নিই।
কবে দেখা যাবে ছবিটি?
২১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাচ্ছে নূপুর।