‘অবাঙালি নামে একটা বিশাল জাতি আমরাই তৈরী করেছি’

নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে এই ২০১৯-এও ভরপুর উদ্যমে বাংলা থিয়েটার ও ছবিতে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন তিনি। ধারাবাহিকেও নিয়মিত কাজ করেছেন একটা সময়। এছাড়াও রিয়ালিটি শো’তে বিচারকের ভূমিকায় তাঁকে দেখতে ভালোবাসেন দর্শক। দীর্ঘদিন ছবির জগতে থাকার দরুন দেখেছেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রির চড়াই উৎরাই। কিছুদিন আগে তাঁকে পাওয়া গেল অর্ঘ্যদীপ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘মুখোশ’এর সেটে। শটের মাঝে সময় বার করে বাংলা ছবির হাল হকিকত নিয়ে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বললেন রজতাভ দত্ত।

এত বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন আপনি। বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করার অফার আসে নিশ্চয়ই। কিভাবে চরিত্র নির্বাচন করেন? 

সব সময় যে খুব ভালো চরিত্র পাই তেমন তো নয়। এইটুকু একটা ইন্ডাস্ট্রি, রোজ রোজ কে আর আমাকে চ্যালেঞ্জিং রোল দেবে। তবে এটা দেখি যে গল্পে আমার চরিত্রটার একটা জোরের জায়গা রয়েছে কি না। এছাড়া আর একটা জিনিস মাথায় রাখি,পরপর দুটো কাজ যেন একরকম না হয়ে যায়। যেমন দুটো ওয়েব সিরিজ় করলাম ‘ওয়াটার বটল’ আর ‘স্টোনম্যান’। দুটোতেই কিলারের চরিত্র। কিন্তু দুটো একরকম নয়। একেবারেই আলাদা দুটো গল্প। তাই পরপর এই কাজ দুটো করতে আমার আপত্তি ছিল না। দুটোই ভালো লেগেছে। আসলে একরকম কাজ করলে একটা ব্র্যান্ডিং হয়ে যায়। যেমন আমি যেই পরপর তিনটে ছবিতে কমেডি করলাম এবং ছবিগুলো ভালো চললো, অমনি সবাই ধরে নিল এই লোকটা কমেডিটাই করতে পারে। আবার একসময় যেমন অনেকগুলো ছবি করেছি মিঠুনদার সঙ্গে। সবই ছিল নায়িকার বাবা বা দাদা, ভিলেন টাইপের চরিত্র। তখন একটা অন্যরকম ব্র্যান্ডিং হয়ে গিয়েছিল। আমার করা ৬০ শতাংশ চরিত্রই নেগেটিভ। সেগুলো আমাকে ব্যানারের কারণেই করতে হয়েছে। কেন না তখন ওই ছবিগুলো ভালো ব্যবসা করেছিল। আমাকে তো দর্শকের কাছে পৌঁছতে হবে।




আর বাকি ৪০ শতাংশ?

সেই চরিত্রগুলো যা আমি করেছি, তা খুব কম অভিনেতা পান। আবার এটাও ঠিক যে ‘ওপেনটি বায়স্কোপ’, ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর মতো শক্তিশালী চরিত্র তো রোজ পাব না। তাই ওগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। 

অভিনেতা হিসেবে বাণিজ্যিক না কি সমান্তরাল ছবি, কোনটাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন? আপনি নিজে তো প্রচুর বাণিজ্যিক ছবিতে কাজ করেছেন

বাণিজ্যিক ছবি বলতে যেটা একসময় হতো সেগুলো বেশিরভাগই কপি-পেস্ট ছবি। কিন্তু ছবিগুলোর মার্কেটিং ভাল হতো, সেগুলো চলতোও। কিন্তু সেক্ষেত্রে যেটা হতে শুরু করলো, দক্ষিণের যে ছবিগুলো থেকে কপি করা হতো সেগুলো ছিল অনেক বড় বাজেটের। এবার সেটা যখন এখানে বানানো হচ্ছে সেটার বাজেট স্বাভাবিক কারণেই কমে যাচ্ছে। একটা আশি কোটির ছবি তো দু’ কোটিতে বানানো সম্ভব নয়। আর যাই হোক আপনি কম খরচে ‘বাহুবলী’ বানাতে পারবেন না। তাছাড়া মানুষের বৃত্ত বাড়ছে এখন। ওই বিদেশে গান শ্যুট করে তার জোরে ছবি বিক্রি করা আর সম্ভব নয়। কেন না মানুষ আগে যে জায়গাগুলো ছবি পর্দায় দেখত, এখন সেখানে নিজেরা বেড়াতে যাচ্ছে।

ছবি বানানোর ধারাটাও তো পাল্টে গেল এই দশকের শুরুতে

হ্যাঁ, সেটা হলো ২০১১-এর পর থেকে। এখন সৃজিত (মুখোপাধ্যায়) বা অন্যান্য পরিচালকরা নিয়মিত যে ধরণের ছবি করেন, তাঁরা যে ধারাতে কাজ করছেন, সেগুলোকেও কিন্তু আমি মূলধারার ছবিই বলব। কেন না এখন সাধারণ দর্শক ওই ছবিগুলোই দেখছেন। তাই সময়ের নিরিখে এখন এগুলোই বাণিজ্যিক ছবি। আমার কাছে দুটোই পছন্দের। 

আরও পড়ুন: আবারও মুক্তি পেতে পারে ফেলুদাকে নিয়ে তথ্যচিত্র

ছবির ধারা বদলানোর কথায় মনে পড়লো, ইদানিং বাংলায় থ্রিলার ছবি একটু বেশি হচ্ছে। এখন দশটার মধ্যে সাতটাই থ্রিলার গোত্রের ছবি হয়। এটা কেন হচ্ছে? বাঙালির কি অন্য গল্পে রুচি নেই?

বাঙালি কিন্তু চিরকালই গোয়েন্দা গল্প পড়তে বেশি ভালোবাসে। ট্রেনে করে বেড়াতে যাওয়ার সময়ও বাঙালি গোয়েন্দা গল্প পড়ে, আবার সারাদিন পরে বাড়ি ফিরেও পড়ে। এটা কিন্তু ভারতের অন্যান্য জায়গায় কম দেখা যায়। বাঙালির এই পছন্দের কারণ হিসেবে একটা আঞ্চলিক রুচি কাজ করে। প্রথম ব্রিটিশ রাজধানী হিসেবে যে বাবু কালচার গড়ে উঠেছিল, সেখান থেকে এটা এসেছে বলে মনে হয় আমার। মানে এমন নয় যে বাঙালি এটাকে খুব সিরিয়াস পেশা হিসেবে নিয়েছে। অর্থাৎ কেস না এলে ব্যোমকেশ বা ফেলুদা কিন্তু না খেতে পেয়ে মরে যাবে না। সে শখের গোয়েন্দাগিরি করে বিখ্যাত হবে। সবসময় পারিশ্রমিকও নেবে না, আবার অপরাধীকে ছেড়েও দেবে, মানে সবটাই তার মর্জিমাফিক। এই ফিউডাল মানসিকতাটা লালন করে বাঙালি খুব তৃপ্তি পায়। আবার বাঙালির একটা ধারণা আছে তারা শ্রেষ্ঠ জাতি। কোথাও কখনও শুনবেন না নন-গুজরাটি বা নন-পাঞ্জাবি বলে কোনও কথা আছে। কিন্তু ননবেঙ্গলি বা ‘অবাঙালি’ নাম দিয়ে একটা বিশাল জাতিকে আমরা তৈরী করেছি আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখে। আমরা সকলের থেকে উৎকৃষ্ট, এটা বাঙালির সবচেয়ে শান্তির ভাবনা। যদিও এই ভাবনার কারণে আমাদের সবই গেছে, তবু এখনও এই চিন্তাটা রয়ে গেছে। যেমন হিন্দি বা অন্য ভাষার ছবিতে দেখবেন ছেলেরা মেয়ে সেজে স্ল্যাপস্টিক কমেডি করছে, বা হিজড়াদের নিয়ে ছবিতে লোকে খুব মজা পাচ্ছে, হাসছে। বাঙালি কিন্তু এই মজাগুলোকে কখনওই রুচির পরিচয় বলে মনে করেনি। তার কমেডি মানে কিছুটা বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস থাকতে হবে। সারকাজ়ম কিংবা উইটকে সে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখে। স্থূল হাস্যরসকে বাঙালি খুব একটা পছন্দ করে না। আসলে সে চিরকাল নিজেকে বুদ্ধিমান ভেবে এসেছে। এদিকে সারা বিশ্বে এখন শক্তিমানদের কদর বেশি। এই দুটো আইডিয়ার মেলবন্ধনটা হয়তো কোনওভাবে তারা থ্রিলারে পাচ্ছে। আমার তো মনে হয় এটাও একটা কারণ। 

আরও পড়ুন: সিনেমার মতোই ছিল যে জীবন

ইদানিং প্রচুর ছবি হচ্ছে বাংলায়। প্রতি সপ্তাহে একাধিক ছবি মুক্তি পাচ্ছে। অথচ কম ছবিই সেভাবে চলছে। এটার কারণ কি?

ছবি না চলার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। আমার মতে মূল দুটো কারণ হলো এফএম এবং মাল্টিপ্লেক্স। বাঙালি কিন্তু বরাবরই মিউজি়ক্যাল ছবি ভালবাসতো। তার কাছে মারদাঙ্গাওয়ালা ছবির থেকে সফট রোমান্টিক ছবি বেশী পছন্দের ছিল। মেলোডিয়াস গান অনেক বেশি প্রাধান্য পেত। কিন্তু এফএম এর দৌলতে এত বেশি হিন্দি গানের চল এসে গেছে যে বাংলা ছবি সেই ব্যালান্সটা রাখতে পারলো না। বেসিক অ্যালবামগুলোও বন্ধ হয়ে গেল। একটার পর একটা গান হতে থাকলে সেটা কে লিখছেন বা সুর করেছেন, এই ব্যাপারগুলো কেউ আর মাথায় রাখে না। আমাদের ছোটবেলায় ওই মানুষগুলোও খুব কাছের ছিলেন। হয়তো তাঁদের দেখিনি। কিন্তু বেতারের মধ্যে দিয়ে একটা আলাদা আত্মীয়তা গড়ে উঠত কোনও সুরকার বা গীতিকারের সঙ্গে। মাল্টিপ্লেক্সেও হিন্দি ছবির প্রাদুর্ভাব এমনভাবে বেড়ে গেল যে একটা বাংলা ছবি খুব ভালো হলেও শো পাচ্ছে হয়তো তিনটে। এবার ধরুন আপনি অনেক দূর থেকে সকলকে নিয়ে একটা ছবি দেখতে এলেন। আপনার দেরি হয়ে গেল, একটা শো মিস করে গেলেন। যেহেতু বাংলা ছবির শো কম, সেক্ষেত্রে আপনাকে হয়তো পরের শো’তে ওই ছবিটি দেখার জন্য সন্ধ্যে অবধি কিংবা পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেখানে একঘন্টা কাটিয়ে একটু কফি খেয়ে এলেই কিন্তু আপনি পরের হিন্দি ছবির একটা শো পেয়ে যাবেন। তার মানে মাল্টিপ্লেক্স আপনাকে সেই সুযোগটা দিচ্ছে যে আপনি যখন খুশি এসে হিন্দি ছবিটা  দেখতে পারেন। তারা সেটা করছে তাদের ব্যবসার কারণে। তারা হিন্দি বা দক্ষিণী ছবির বাজারটা ধরবে, যেহেতু সেখানে লাভ বেশী। কিংবা একটা নামী ইংরেজি ছবি আনলেও তাদের লাভ। এবার যেহেতু দেখার সুযোগ বেশী তাই যারা হয়তো বাংলা ছবি দেখতে পারত, তারাও একদিন হিন্দি ছবির দর্শক হয়ে যাচ্ছেন বা আগামীদিনে পছন্দের শো টাইম না পাওয়ায় তিনি বাংলা ছবি আর দেখবেন না।

আরও পড়ুন: ফাগুন লেগেছে বনে বনে

হল বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও তো একটা কারণ

অবশ্যই। দেখুন, হল মালিককে দিনের শেষে ব্যবসা করেই খেতে হয়। তিনি সমাজসেবা করতে আসেননি। ছবি যদি না চলে, তিনি হল খুলে রাখবেন কেন? আর ছবি চলছে না বলে ব্যবসাটাও মার খাচ্ছে, বাজেটও বাড়ানো যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটা একটা সাইক্লিক অর্ডারে চলছে। তাই অনেকেই ইদানিং সিনেমা থেকে ওয়েব সিরিজ়ে সরে আসছেন। কেন না যিনি ছবি বানাচ্ছেন, তাকে তো ছবির ব্যবসাটা নিয়ে ভাবতে হবে। এখনই যদি বাংলা ছবিকে চালানোর জন্য সরকারের তরফে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। চিরকাল রাজা বা সরকার বা যিনি ক্ষমতায় আছেন তাঁরাই শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হয়েছেন, এক্ষেত্রেও তাঁদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। 

আপনি নিজে তো পরপর ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করছেন। একটা কথা অনেকেই বলছেন যে ওয়েব সিরিজ় মানেই ডার্ক এন্টারটেইনমেন্ট। যেহেতু কোনওরকম সেন্সরশিপ নেই তাই এখানে যৌনতা বা হিংসা দেখানো হচ্ছে অনেক বেশী উন্মুক্তভাবে। এটা বাংলা সংস্কৃতির জন্য কতটা উপযুক্ত বলে মনে হয় আপনার?

এটা কে ঠিক করে দেবে যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল? শিল্পের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে যদি বলা হয় এইসব দেখানো হচ্ছে বলে এই অসামাজিক কাজগুলো হচ্ছে, তাহলে বলতে হবে ঘটনার মূল কারণটা আমরা খতিয়ে দেখছি না। ওয়েব সিরিজ় আসার আগে কি খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ হতো না? আমি নিজে খুব ছোট বয়সে ‘বিবর’ বা ‘প্রজাপতি’র মতো বই পড়েছি। আমার বাড়িতে পৃথিবীর কোনও বই পড়া নিয়ে কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমি ওইসব পড়ে খুব অসামাজিক জীবন যাপন করেছি। আবার প্রত্যন্ত গ্রামে গঞ্জে যখন একটা জঘন্য অপরাধ ঘটছে, তখনও এমন নয় যে সেই মানুষটা একটা ভয়ঙ্কর ছবি দেখে বা বই পড়ে সেটা করছেন। আসলে তো শিক্ষার অভাব। অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল শেখাবার সময় আমরা এটা শেখাতে পারছি না যে অন্যের ব্যক্তিগত পরিসরে তুমি ঢুকতে পারো না, কিংবা কে কোন পোশাক পরবেন সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই শিক্ষাগুলো দেওয়া দরকার ওই অপরাধগুলো আটকাবার জন্য। একটি মেয়ে ধর্ষিতা হলে সেটা তার জামাকাপড়ের দোষ নয়, বরং ওই অপরাধ থেকে নজরটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এই কথাগুলো বলা হয়। ঠিক তেমনই সমাজের অবক্ষয়ের জন্য ওয়েব সিরিজ়কে দায়ী করাটা ভুল। আর এই সেন্সরশিপটা করবে কে? সেন্সর যে মুহূর্তে ঢুকবে তার হাত ধরে আরও সাংঘাতিক জিনিস ঢুকবে এর মধ্যে। যিনি ওই ক্ষমতায় থাকবেন, তিনি ঠিক কি না সেটা কে বলবে? একজন বলবে এটা দেখানো অনুচিত, আর একজন বলবে না এটা নয়, ওইটা দেখানো ঠিক হচ্ছে না। প্ৰত্যেক মানুষের বোঝা বা না বোঝাগুলো অন্যের থেকে আলাদা। তাহলে বাইরে থেকে কিভাবে বোঝা যাবে একজন মানুষের কতটুকু ঠিক আর কতটাই বা ভুল? এর কোনও স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। 

ছবি: সবুজ দাস

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *