অসামান্য সম্পর্কের গল্প
ছবি: আদর
পরিচালনা: দেবদূত ঘোষ
অভিনয়ে: জয়মালা (হাতি), রজতাভ দত্ত, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দোপাধ্যায়, তুলিকা বসু, প্রদীপ চক্রবর্তী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, মানসী সিংহ, তমাল রায়চৌধুরী, বাসন্তী চট্টোপাধ্যায়, খগেন্দ্রনাথ দাস, মনোজ ওঝা
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
বড়পর্দায় সাহিত্য নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই গোয়েন্দা গল্প বা রহস্য কাহিনির প্রতি নির্মাতাদের ঝোঁক দেখা যায়। দর্শক নাকি এসব ছবি ভালো ‘খায়’। সেই অর্থে বাংলার নিজস্ব চারিত্রিক গুণাবলী দিয়ে ভরা, যে প্রকৃতিনির্ভর গল্প পড়ে আমাদের বড় হয়ে ওঠা, তার চলচ্চিত্রায়ন করার প্রয়াস খুব একটা দেখা যায় না। সেটার একটা প্রধান কারণ যেমন দর্শক বিমুখতা, তেমনই প্রাচীন বাংলার কাহিনিকে পর্দায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে থাকে নানা প্রতিবন্ধকতা। তবে এই দুই ক্ষেত্রকে মাথায় রেখেই দেবদূত এমন এক কাহিনি বেছেছেন যেখানে সময়কে পুনঃনির্মাণ করতে বিশাল বাজেটের প্রয়োজন হয়নি। তার অন্যতম কারণ প্রকৃতি এখনও অনেকক্ষেত্রেই তার আদি অকৃত্রিম রূপ নিয়ে স্বমহিমায় বিরাজমান। আমরাই হয়তো তাকে খুঁজতে ভুলে যাই। অন্যদিকে ছবিতে জীবজন্তুর উপস্থিতি আজও দর্শকের মন ভিজিয়ে দিতে সক্ষম, অন্তত এই ছবি দেখতে বসে সেরকম অভিজ্ঞতাই হলো। তবে এই কাজটা শুনতে যতটা সহজ, সত্যিই কি ততটা সহজ ছিল?
স্কুলজীবনে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আদরিণী’ গল্পটি প্রায় সকলেরই পড়া। পীরগঞ্জের জমিদারের মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তাদেরই এস্টেটের বিশ বছরের মোক্তার জয়রাম মুকুজ্যে (রজতাভ)। এতটা পথ হেঁটে যাওয়া সমস্যা বলেই একটি হাতি চেয়ে জমিদারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জমিদার গিন্নির প্ররোচনায় সে আবেদন না-মঞ্জুর হয়ে যায়। চাকরের মুখে সে কথা শুনে প্রতিবেশীদের সামনে অপমানিত বোধ করেন জয়রাম। পরের দিনই চাকরকে মেলায় পাঠিয়ে দেন হাতি কিনতে। অনেক টাকা খরচ করে সত্যিই হাতি এসে উপস্থিত হয় বাড়িতে। জয়রাম ভালোবেসে তার নাম রাখেন আদরিণী। তারপর কয়েক বছর আনন্দে কেটে গেলেও একসময় নাতনির বিয়ে উপলক্ষে অনেকগুলো টাকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অগত্যা আদরিণীকে বিক্রি করে সেই টাকার ব্যবস্থা করা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। নিজের কন্যাসম আদরিণীকে কি জয়রাম বিক্রি করে দিতে পারবেন?
আরও পড়ুন: “আর ভালো লাগছে না”
ছবির দৈর্ঘ্যের কারণেই গল্পে সামান্য কিছু বদল আনতে হয়েছে দেবদূতকে। স্বাধীনতার অনেক আগে লেখা গল্পকে ছবির প্রয়োজনে কিছুটা এগিয়ে ১৯৬৭ সালে আনা হয়েছে। তবে সে কারণে গল্পের বিশেষ কোনও হেরফের হয়নি। আদালতের দৃশ্যের বিবরণ গল্পে না থাকায় সেটুকু ছবিতে যোগ করতে হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই। সেটাও বলা বাহুল্য জয়রাম চরিত্রে আলাদা এক মাত্রা যোগ করেছে। গল্পের পরিণতি ট্র্যাজিক হবে জেনেও বিরতির পর থেকে করুণ রস ক্রমশ দর্শককে অনুভূতির এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে চোখে জল এলেও মুগ্ধতায় মুখের হাসিটুকুও থেকে যাবে একইসঙ্গে।
আরও পড়ুন: “প্রতিটি আঞ্চলিক সিনেমার শিকড় কোথায় আমি জানি”
বাঙালির জঙ্গল ভ্রমণ আর তার সঙ্গে হাতি খোঁজার মতো মজাদার দৃশ্য ছবির শুরুতে ভূমিকা গঠনে যতটা সাহায্য করে, ঠিক ততটাই সহায়ক হয়ে ওঠে বন্যপ্রাণ সম্পর্কে শহুরে মানুষের ধারণা অন্তত কিছুটা পাল্টাতে। এই ভ্রমণপিপাসু জাতের পক্ষে তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ডিএফও শুভঙ্কর মুখার্জি (সব্যসাচী) খুব অল্প কথায় বুঝিয়ে দেন জঙ্গল শুধু জন্তু জানোয়ারেরই জায়গা, মানুষের নয়। তাই জঙ্গলে গেলেই যে তাদের দেখা মিলবে এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। হাতির গল্প বলতে গিয়ে আসে জয়রামের কথা। আর সেখান থেকেই ক্যামেরা ক্রমশ দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝে নিয়ে গিয়ে ফেলে দর্শককে।
কিছু অসাধারণ টুকরো দৃশ্যের মাধ্যমে দর্শককে এক মুহুর্তে গ্রামের মাটিতে নিয়ে গিয়ে ফেলে ‘আদর’। গ্রামবাংলার প্রেক্ষাপটে খোলা আকাশের নিচে বয়ে চলা নদী, আবহে সেতারের ঝঙ্কার, ছোট ছেলেপুলেদের হইচই, সবমিলিয়ে পর্দায় এক মধুর চলমান ছবি এঁকেছেন দেবদূত। অভিনেতা হিসেবে তাঁকে সকলেই চেনেন, পরিচালক হিসেবে এবার নতুনভাবে চিনতে হবে।
সাহস, এই ছবির ক্ষেত্রে খুব প্রয়োজনীয় একটা শব্দ। কুকুর, বেড়াল বা ট্রেনিং দেওয়া বাঘের সঙ্গেও কয়েক মিনিট শ্যুটিং করে নেওয়া যায় হয়তো। তাই বলে হাতি! তাও আবার পুরো ছবি জুড়ে? এতটা ভাবতে পারাই একটা দুঃসাহসিক কাজ। সেই কাজটাই করে দেখালেন দেবদূত ও তাঁর সহকর্মীরা। পৌনে দু’ঘণ্টা ধরে এক অসামান্য সম্পর্কের গল্প বলে গেলেন তিনি।
আরও পড়ুন: আবার বছর দশেক পর লক্ষ্মীছাড়ার নতুন অ্যালবাম
ছবির সিংহভাগ জুড়ে জয়মালার কীর্তিকলাপ অবাক এবং মুগ্ধ করে। হয়তো কিছুটা অভিনয়ও সে করেছে অবিশ্বাস্যভাবেই। কীভাবে এই অসাধ্য সাধন হয়েছে সে জানেন অভিনেতারা, আর জানেন পরিচালক। অমন পাহাড় সমান হাতির সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন আবেগপ্রবণ দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য রজতাভর সাধুবাদ প্রাপ্য। যদিও তিনি প্রতি ছবিতেই অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শককে চমকে দেন, এমন একটা অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছেন। তবু জয়রামের মতো চরিত্রে এক অন্য রজতাভকে পাওয়া গেল। শুধু চমকে যাওয়া নয়, কিছু বিশেষ দৃশ্যে দর্শককে হতভম্ব ও বাকরুদ্ধ করে দেন তিনি। এই রজতাভকে বাংলা ছবির দর্শক আগে দেখেনি।
অন্যান্য অভিনেতারা প্রত্যেকেই যে যার জায়গায় মানানসই। বাসবদত্তাকে গ্রাম্য বধূর চরিত্রে খুব সুন্দর মানিয়েছে। যিনি জয়রামের ভৃত্য ও সবসময়ের সঙ্গীর ভূমিকায় ছিলেন তাঁর অভিনয়ের বিশেষভাবে প্রশংসা করতে হয়। ছোট্ট চরিত্রে তুলিকা ও মানসী বরাবরের মতোই অপ্রতিরোধ্য।
আরও পড়ুন: ‘মাসুম’-এর সিক্যুয়েল করবেন শেখর?
জমিদারের মেয়ের বিয়ের দিনের দৃশ্যে বাঈজির ভূমিকায় পিউ মুখোপাধ্যায়ের গান, সঙ্গে কুমার বসু ও আল্লারাখা কলাবন্তের মতো শিল্পীদের সঙ্গত মন কেড়ে নেয়। বন্দিশটি ভারী সুন্দর গেয়েছেন পিউ। অন্য একটি দৃশ্যে তীর্থ ভট্টাচার্যের গলায় লোকসঙ্গীত কানকে তৃপ্তি দেয়। তন্ময় বসুর আবহ এ ছবির অন্যতম সম্পদ। বাংলা ছবিতে তাঁর আরও বেশি কাজ করা উচিত। অর্ঘ্যকমল মিত্রের সম্পাদনা যথাযোগ্য। পদ্মনাভ দাশগুপ্তের চিত্রনাট্য ছবিকে অহেতুক মেলোড্রামা থেকে মুক্তি দিয়েছে। চিত্রগ্রহণ মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
সব শেষে বলতেই হয় এই ছবি বড়পর্দার জন্য তৈরি। ঘরে বসে এ ছবির আনন্দকে সেইভাবে অনুভব করা যাবে না। পাশাপাশি এ ছবির বিদেশে প্রদর্শন দরকার। চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে ছবিটিকে পাঠানোর কথা নির্মাতারা ভেবে দেখতে পারেন।