যে জন থাকে মাঝখানে
মৃত্যুর পরেও যে একটা জগৎ আছে, সে বিশ্বাস মানুষের বহুদিনের। আর সেই জগৎ সম্পর্কে জানবার আগ্রহও মানুষের অপরিসীম। ইউএফও চেপে আসা ভিনগ্রহীদের মতোই ‘ওপারের’ মানুষেরা কেমন থাকেন, কি করেন, তা জানবার চেষ্টা বহুদিন ধরেই করে এসেছে মর্তলোকের অধিবাসীরা। প্রায় ষাট হাজার বছর আগেকার নিয়ানডরথাল মানুষের কবরে পাওয়া গেছে ওষুধ মাখানো ফুল। আয়ারল্যান্ডে পাওয়া গেছে প্রস্তরযুগের মানুষের পাথরনির্মিত সমাধি, যাতে আত্মাতত্ত্বের অস্তিত্বই সুস্পষ্ট হয়। সলোমন দ্বীপপূঞ্জের লোকেরা বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পর আত্মার এক অংশ স্বর্গে (বা নরকে) যায় আর এক অংশ ঘুরতে থাকে পৃথিবীর আশপাশে। চাইলেই সাক্ষাৎ মেলে ‘তেনা’দের। প্রাচীন মিশরীয়রাও বিশ্বাস করত মৃত্যু-পরবর্তী জগতে। ফারাওদের সমাধি তাই তারা ভরে দিত উপহার, বিলাসবাসন আর প্রাত্যহিক জীবনের নানা উপকরণে।
আমেরিকার প্রাচীন অধিবাসীদেরও ছিল অনুরূপ বিশ্বাস। তারা আয়োজন করত নানা আচার-অনুষ্ঠানের, যাতে মৃত্যুর পর আত্মার যাত্রাপথ সুগম হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনুষ্ঠানের পুরোভাগে থাকতেন পুরোহিত শ্রেণীর মানুষেরা। আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনেও এঁরাই ছিলেন মাধ্যম। সংস্কৃত সাহিত্যেও বৃহদারণ্যক উপনিষদে ভূতের উল্লেখ আছে।
পরে সভ্যতা যখন গুটিগুটি পা ফেলে বেশ কিছুটা এগিয়েছে, মানুষ উৎসাহী হয়েছে প্রেতচর্চায়। সংগঠিতভাবে বিশেষ কোনও পদ্ধতি মেনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রেতলোকের সঙ্গে। এই যে প্রচেষ্টা, তার পোশাকি নাম সিঁয়াস (seance) l ফরাসি এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ বসবার জায়গা। কিন্তু ইংরেজি ভাষায় যখন এর ব্যবহার হয়, তখন তার মানে দাঁড়ায়, কিছু মানুষকে এক জায়গায় মিলিত হয়ে সমবেত চেষ্টার মাধ্যমে আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা খোঁজা। আত্মা বা মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনের কাজে মধ্যস্থতা করে ‘মিডিয়াম’ বা মাধ্যম। আর সিয়াঁসের একটি অন্যতম পদ্ধতি হল প্ল্যানচেট বা পাঁশে।
এ ব্যাপারে পরে আসছি। তার আগে বরং একটু দেখে নেওয়া যাক সিয়াঁসের ইতিহাস।
সিয়াঁসে মেলায় তেনাদের
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ বলা আছে যে আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা, ডাকিনিবিদ্যার চর্চা, বা ভাগ্যগণনা খ্রিস্টান ধর্মের প্রথাবিরুদ্ধ। প্রভু এতে রুষ্ট হন। নিউ টেস্টামেন্ট-এ অবশ্য একটি জায়গাতে দেখা যায় যে রাজা সল একটি সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁর মৃত মন্ত্রী স্যামুয়েলের সাহায্য চাইছেন এবং এ কাজে এন্ডর নামের এক ওঝার সাহায্য নিচ্ছেন। মধ্যযুগের নানা গল্পেও খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য পৃথিবীতে শুভ আত্মাদের আবির্ভাবের কাহিনী পাওয়া যায়
তিনি বৃদ্ধ হলেন
আধুনিক যুগে প্রথম সিয়াঁসের রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে ১৬৫৯ সালে। কিন্তু এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য বিশেষ মেলেনি। এর বেশ কিছুদিন পর ইমানুয়েল সুইডেনবার্গ নামের এক সুইডিশ বিজ্ঞানী প্রেতচর্চার ব্যাপারে জোরদার সওয়াল করেন। ভদ্রলোক দাবি জানান যে তিনি চোখের সামনে নানা অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহ দেখতে পাচ্ছেন এবং অনেক মৃত ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তিনি আরও বলেন যে তাঁর শরীর ধরাধামে থাকলেও, তাঁর মন ব্রহ্মাণ্ডের নানা গ্রহে ঘুরে এসেছে এবং সেরকমই কোনও এক গ্রহে তিনি প্রভু যিশুর দেখাও পেয়েছেন।সুইডেনবার্গ জানান, তিনি প্রমাণ পেয়েছেন, ভগবান এবং জীবিত মানুষের মাঝে থাকে আত্মারা। নশ্বর মানুষদের সঙ্গে কথা বলবার জন্য ভগবান মাঝেমধ্যেই আত্মাদের সাহায্য নেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর অতিলৌকিক শক্তির প্রমাণ দেন সুইডেনবার্গ। গোথেনবার্গ শহরে বসে, প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে স্টকহোমে আগুন লাগার খবর আগাম জানিয়ে দেন তিনি। আত্মার সাহায্য নিয়ে অনেকের হারানো নানা জিনিস খুঁজে দেন। রাশিয়ার জ়ার তৃতীয় পিটারের হত্যার ভবিষ্যদ্বাণীও করেন বহু দূরে বসে।
এ ধরণের নস্ত্রাদামুসোচিত চটকদার কাজকর্মের ফলে সুইডেনবার্গের ভক্তকুল জুটে যেতে বিশেষ সময় লাগেনি। রাজপরিবারের সদস্যরাও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেন। সুইডেনবার্গের ভক্তরা দাবি করেন যে তিনি নিয়মিতভাবে মৃত বন্ধু, পরিবারের মৃত সদস্য এবং সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। সুইডেনবার্গের ফাঁক ও ফাঁকি নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে, কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
পরলোকচর্চায় এরপর যে নামটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল ফ্রান্স মেসমার। তাঁর নাম থেকেই ‘মেসমেরিজম’ শব্দটির উৎপত্তি। মেসমেরিজম বা সম্মোহনবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ১৮৩০-থেকে ১৮৮০-এর দশকে বহু মানুষ আত্মাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে সক্ষম হয়েছেন বলে দাবি করেন। মাধ্যমকে সম্মোহিত করে তাঁরা আত্মার সঙ্গে কথোপকথন চালাতেন। এরকম বেশ কিছু কথোপকথন ছাপানোও হয়েছিল সে সময়ের জার্নাল দু ম্যাগনেটিজম-এ।
রক্তবরণ মুগ্ধকরণ
প্রায় এই সময়েই আসরে নামতে দেখা যায় ফক্স বোনেদের। নিউ ইয়র্কের হাইডেসভিলের কাছে বাবা-মায়ের ফার্মহাউসে থাকতেন তিন বোন—লিয়া, মার্গারেট আর কেট। সেটা ১৮৪৮ সালের ঘটনা। এ বাড়িতে থাকার সময় তিন বোন অনুভব করেন যে তাঁরা পাঁচটি প্রাণী ছাড়াও বাড়িতে আরও একজন তাঁদের সঙ্গে বসবাস করেন। তবে তাঁকে চোখে দেখা যায় না। ক্রমে সেই অশরীরীর সঙ্গে আলাপ হয় বোনত্রয়ীর। নিজেরা কথাবার্তা চালাতেন বিভিন্ন আসবাবে টোকা মেরে আওয়াজ করে। এবং সে ভাষার অর্থ শুধুমাত্র তিন বোনই বুঝতেন। এঁদের খ্যাতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে অতলান্তিকের দু’পারেই। এঁদের দেখে বহু মানুষ আকৃষ্ট হন পরলোকচর্চার প্রতি। পরে অবশ্য কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছিলেন যে মার্গারেট তাঁর শরীরে দুই হাড়ের ঠোকাঠুকির মাধ্যমে টোকা দেওয়ার আওয়াজ করে সবাইকে ভাঁওতা দিতেন।
প্ল্যানচেটের কথা
ফরাসি শব্দ প্ল্যানচেট-এর অর্থ ছোট তক্তা। বিশেষভাবে তৈরি এই তক্তাকে মাঝখানে রেখে চারধারে গোল হয়ে বসে পরলোকের অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা বা সিয়াঁস করা হত। কালক্রমে এই প্রথাটিরই নাম হয়ে দাঁড়ায় প্ল্যানচেট। এ যেন অনেকটা সেই ফোটোকপি মেশিনের মতো। প্রথম জ়েরক্স কোম্পানি এই মেশিন তৈরি করেছিল, লোকমুখে তাই ফোটোকপিয়ারের নাম হয়ে দাঁড়াল জেরক্স। প্ল্যানচেটের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা তাই। এর মূল আঁকার ছিল হৃদয় বা পানপাতার মতো। তিন পা-ওয়ালা এই তক্তার একদিকে লাগানো থাকত দু’টি চাকা আর একদিকে থাকত কলম গোঁজার ছিদ্র। চাকা লাগানো থাকার ফলে আত্মা সহজেই এই তক্তাকে নড়িয়ে নিজের বক্তব্য জানাত এবং তক্তা নড়লে কলমের সাহায্যে লেখা পড়ত।
ভিক্টোরীয় যুগে পরলোকচর্চায় প্ল্যানচেট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে প্ল্যানচেটের আকৃতিতে নানা বদল আসে। সেই সঙ্গে বদলায় নির্মাণদ্রব্যও। কাঠ ছাড়াও শক্ত রবার, কাচ প্রভৃতি নানা জিনিস দিয়ে প্ল্যানচেট বানানো শুরু হয়।
প্রথম দিকে প্ল্যানচেটের ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল ফক্স বোন বা ডি ডি হোমসের মতো পেশাদারদের মধ্যেই। কিন্তু পরে সাধারণ মানুষরাও আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা হিসেবে প্ল্যানচেটকেই বেছে নেন। এতে বিপদ গোনেন পেশাদারেরা। তাঁরা ভয় দেখাতে শুরু করলেন যে এভাবে অভিজ্ঞ লোকেদের সাহায্য ছাড়া আত্মাদের ডাকাডাকি শুরু করলে তাতে বিপদ হতে পারে। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। প্রথমে কুটিরশিল্প হিসেবে শুরু হলেও এভাবে প্ল্যানচেটের চাহিদা বাড়তে থাকায় বড় বড় কারখানা তৈরি হয় শুধুমাত্র প্ল্যানচেট বানানোর জন্য। নড়েচড়ে বসেন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির লোকেরাও। ১৮৬৮ সালে সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকাতে প্ল্যানচেট নিয়ে একটি লেখা বেরোয়। তাতে বলা হয়; ‘…the phenomena of table-tipping, spirit-rapping so called, and the various manifestations which many have claimed to be the effect of other wills acting upon and through the medium of their persons, are exerting an immense influence, good or bad, throughout the civilized world.’ ঘটনাগুলির সত্যতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয় অনেক জায়গায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে আরও রমরমা বাড়তে থাকে প্ল্যানচেটের। যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারান। পরিবারের যাঁরা বেঁচে থাকলেন, তাঁরা মৃত প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলার উপায় হিসেবে সিয়াঁসের শরণাপন্ন হতে থাকেন।
তবে এ সময় বাজারে এসে গেছে উইজ়া বোর্ড। এই বোর্ডটিতে ইংরেজি বর্ণমালার সব অক্ষর; শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সব সংখ্যা; হ্যাঁ, না, হ্যালো, বিদায়-এর মতো শব্দ ও কিছু চিহ্ন আঁকা থাকত। এগুলির ওপর কলম বা ওই জাতীয় কিছু ধরে থাকলে আত্মা পরপর অক্ষর ছুঁয়ে শব্দ ও ক্রমশ বাক্য গঠন করে তার বক্তব্য জানাত। উইজ়ার জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আদিম ও আসল প্ল্যানচেটের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। ঊনবিংশ শতকে জনপ্রিয় হয় অটোমেটিক রাইটিং পদ্ধতির মাধ্যমে পরলোকের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। এই পদ্ধতিতে একজন মিডিয়াম বা মাধ্যম ঘোর লাগা অবস্থায় আলতো করে একটি কলম কাগজে ছুঁয়ে থাকেন। সেই কলম নিজে থেকেই—অর্থাৎ আত্মার দ্বারা—একসময় চলতে শুরু করে ও লিখে তার বক্তব্য জানায়।
শব্দ যখন ছবি আঁকে
১৯৭০–এর দশকে ম্যাথু ম্যানিং নামে এক ইংরেজ এই পদ্ধতির সাহায্যে আত্মাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বেশ বিখ্যাত হন। ম্যানিং-এর ডাকে সাড়া দেওয়া আত্মারা ইংরেজি ছাড়াও ফরাসি, জার্মান , গ্রিক, ল্যাটিন, রুশ, আরবি ও মধ্যযুগীয় অজানা সাঙ্কেতিক ভাষাতে তাদের বক্তব্য জানাতেন। এঁদের কেউ কেউ আবার লেখা ছেড়ে ছবি আঁকার রাস্তাও নিয়েছিলেন।
মিডিয়াম বা মাধ্যম
ফক্স বোনেদের মতো পেশাদার প্রেততাত্ত্বিকদের নামের সঙ্গে সঙ্গে যে শব্দটি অবধারিত ভাবে এসে পড়ে, সেটা হলো মিডিয়াম বা মাধ্যম। পরলোকের বাসিন্দারা আমার আপনার মতো মানুষের সঙ্গে কথা বার্তা চালানোর জন্য কোনও বিশেষ ব্যক্তি বেছে নেন। এই মাধ্যম সিয়াঁসের সময় ঘোরলাগা এক অবস্থায় চলে যান। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আত্মাদের কথা শুনতে পান এবং তা আমাদের শোনান। কারও কারও ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বা নির্দিষ্ট সময়ে আত্মারা শরীরের মধ্যে প্রবেশ করেন এবং তাদেরকে দিয়ে কথা বলিয়ে নেন বা অন্য কোনও কাজ করিয়ে নেন।
সত্যজিৎ ও রেলভূত
মাধ্যমদের অধিকাংশর মধ্যেই খুব ছোটবেলা থেকেই এ ধরনের ক্ষমতা প্রকাশ পায়। সাধারণ মানুষের চোখে যাঁদের উপস্থিতি ধরা পড়ে না , অবলীলায় তাঁরা সেইসব ছায়াশরীরের উপস্থিতি টের পান বা তাঁদের ফিসফিসানি শুনতে পান। অনেক সময় দেখা গেছে যে কোনও দুর্ঘটনা, বিশেষ করে মাথায় আঘাত, বা দীর্ঘ রোগভোগের পর বা প্রবল মানসিক আঘাতের পরেও কেউ কেউ এ ধরনের ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। অনেকেই নিজের মধ্যে এই বিশেষ ক্ষমতাকে অন্যের ভালো কাজে লাগান।
এবারে বিখ্যাত কয়েকজন মিডিয়ামের কথা জানা নেওয়া যাক।
Advertisement
নিউইয়র্ক শহরে প্যারাসাইকোলজি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এলিন গ্যারেট নামে এক আইরিশ মহিলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সিয়াঁসের রমরমা শুরু হয়, সে সময় উৎসাহী মহিলাদের একটি দলে যোগ দেন এলিন। আত্মাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সময় তিনি ঘোরে চলে যেতেন। বিশেষ করে ইউভানি নামে এক ভদ্রলোকের আত্মার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছিল। সেসময়ের অন্যতম জনপ্রিয় মিডিয়াম হয়ে উঠেছিলেন এলিন।
আরেক মিডিয়াম লিওনোরা পাইপারের মধ্যে মিডিয়াম হওয়ার লক্ষণ খুব ছোটবয়স থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৮৮৯-৯০ সাল নাগাদ ইংল্যান্ডের যুক্তিবাদীরা তাকে বুজরুক আখ্যা দেন। এঁদের সঙ্গে প্রায় তিরাশিটি সিঁয়াসে বসেছিলেন লিওনোরা। শেষমেশ তারা মেনে নিয়েছিলেন যে লিওনোরার মধ্যে ‘অন্যরকম’ প্রতিভা আছে। ১৯০৯ সাল নাগাদ হঠাৎ করে নিজের অলৌকিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন লিওনোরা। কিছুদিন পরে তিনি যখন ক্ষমতা ফিরে পান, তখন লেখার মাধ্যমে আত্মাদের সাথে কথা বলতেন। এলিন যেমন ইউভানি নামে এক আত্মার সাহায্য নিতেন, লিওনোরার ‘স্পিরিট গাইড’ ছিলেন ফিন উইট নামের এক ফরাসি ডাক্তার।
এক উপরি পাওনা, তারপর নিকষ কালো অন্ধকার
এইসব মাধ্যম মাঝেমাঝেই তাক লাগানো সব ঘটনার কথা বলে লোকজনকে চমকে দিতেন। শোনা যায়, এস্তেল রবার্টস নামে এক মাধ্যম ঔপন্যাসিক বারবারা কার্টল্যান্ডের মা মেরি কার্টল্যান্ডকে তাঁর দুই পুত্র রোনাল্ড ও টোনির আগাম মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলেন। সেসময় টোনি যুদ্ধবন্দী ছিলেন। প্রায় এক বছর বাদে মেরি জানতে পারেন যে সত্যিসত্যিই তিনি তাঁর দুই ছেলেকে একদিনের ব্যাবধানে হারিয়েছেন । এরকমই ডরিস স্টোকস নামে এক ব্রিটিশ মহিলা আত্মাদের মাধ্যমে পুলিশকে হত্যারহস্য সমাধানেও সাহায্য করেছিলেন।
সিয়াঁস পদ্ধতি
প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, অবিশ্বাসী মন নিয়ে সিয়াঁসে সাফল্য পাওয়া যায় না। পেশাদার প্রেততাত্ত্বিকরা বলেন, প্ল্যানচেট বা অন্য যে পদ্ধতিতেই সিয়াঁস করা হোক না কেন, কিছু জিনিস এই কাজে আবশ্যক। সাধারণভাবে রাত্রের দিকে সিয়াঁস আয়োজন করলে তাতে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একটি টেবিলের চারধারে চার বা ছয়জন লোক (যীশু পাঁচটি ক্ষতচিহ্ন নিয়ে মারা গিয়েছিলেন বলে পাঁচজন লোক বসতে নিষেধ করা হয় ) গোল হয়ে বসে টেবিলের ওপর দুইহাত পেতে রাখবেন। পরস্পরের হাতের কড়ে আঙুল যেন ছুঁয়ে থাকে। যদি প্ল্যানচেটের মাধ্যমে করা হয়, তাহলে মাধ্যম স্পর্শ করে থাকবে প্ল্যানচেটকে। টেবিলের মাঝখানে মোমবাতি, জলের পাত্র রাখা যেতে পারে। এরপর সকলে একমনে চিন্তা করবেন সেই মৃত ব্যক্তির কথা, যাঁকে তাঁরা আহ্বান করতে চান।
তিন মূর্তি ও পায়ের তলায় সরষে
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আত্মার উপস্থিতি অনুভব করা যায় নানাভাবে। কখনও গন্ধের মাধ্যমে, কখনও বা মাধ্যম তাঁর শরীরে শীতল স্পর্শ অনুভব করেন, আবার কখনও বা শোনা যায় হালকা শব্দ। মোমবাতির শিখা কাঁপতে কাঁপতে নীলবর্ণ ধারণ করে, এরকমও বলেছেন কেউ কেউ। বাড়িতে কুকুর থাকলে তারাও ষষ্ঠেন্দ্রিয়র সাহায্যে বুঝতে পারে আত্মার উপস্থিতি। করুণ সুরে ডেকে ওঠে তারা। আত্মার উপস্থিতি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে। সর্বশেষে আত্মাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইতি টানতে হয় সিয়াঁসে। কোনও মুহুর্তে কোনও বিপদের সম্ভাবনা বুঝলে তৎক্ষণাৎ সিয়াঁস শেষ করে দেওয়া উচিত।
মহারানি ভিক্টোরিয়া নিজে সিয়াঁসে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে পরলোকে তাঁর দেখা হবে সব প্রিয়জনের সঙ্গে। বিশেষ করে স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের সঙ্গে, যিনি ১৮৬১ সালে মারা যান। আব্রাহাম লিঙ্কনের স্ত্রী মেরি টড লিঙ্কনও বিশ্বাস করতেন পরলোকে। তাঁর দুই পুত্র এডি আর উইলির সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনি হোয়াইট হাউজ়ে সিয়াঁসের আয়োজন করেছিলেন। লিঙ্কনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন সাংবাদিক হোরেস গ্রিলে, ইংরেজ বিজ্ঞানী এ আর ওয়ালেস এবং উইলিয়াম ক্রক্সও বিশ্বাস করতেন প্রেতচর্চায়।
আমাদের দেশে দীনবন্ধু মিত্র, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও সিয়াঁসে বসতেন। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ খ্যাত প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন নামজাদা প্রেততত্ত্ববিদ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি এব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। স্ত্রীর উপস্থিতিও তিনি অনুভব করতে পারতেন বলে বেশ কিছু লেখা থেকে জানা যায়। আর রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটের কাহিনি তো সর্বজনবিদিত। ছেলেবেলায় একবার প্ল্যানচেটে বউঠানের আত্মাকে আনিয়েছিলেন রবি। বউঠান প্রথম যে শব্দটি লিখেছিলেন, তা ছিল, ‘খোকন, তুমি যে কি করো?’
সমসাময়িক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত