মন নিয়ে (পর্ব ১): মধ্যবিত্তের লাইফস্টাইল সমস্যার সমাধানের খোঁজে অনুত্তমা

নাগরিক সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সাধারণ মানুষের মানসিক সমস্যাও। কেবল সমাজের উঁচুতলার মানুষই মানসিক সমস্যার শিকার, এই ধরণাটা এখন আর চলে না। লাইফস্টাইল সংক্রান্ত সমস্যায় সবথেকে বেশি আক্রান্ত মধ্যবিত্তরাই। প্রতিনিয়ত নানান প্রলোভনের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে সুস্থভাবে সন্তানকে বড় করে তোলার চিন্তায় বাবা মায়েরা অনেক সময়েই দিশাহারা হয়ে যান। প্রথম পর্বে সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভরতা থেকে ছাত্রছাত্রীদের হতাশা ও অবসাদ নিয়ে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে কথা বললেন বিশিষ্ট মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বর্তমান সময়ের একটা বিরাট সমস্যা সোশ্যাল মিডিয়ার নেশা। এটা এমন একটা জিনিস যা ছাড়া আমাদের চলেও না আবার যেটা থাকার কারণে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। কিভাবে এর ভারসাম্য রেখে চলবে সাধারণ মানুষ? 

দেখো, যখন প্রথম টেলিভিশন এসেছিল তখনও অনেকে বলেছিলেন সব বন্ধ করে মানুষ শুধু টিভি দেখছে, সমাজ রসাতলে যাচ্ছে, অপসংস্কৃতি হচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু তেমন কিছু তো হয়নি। যে কোনও নতুন বৈজ্ঞানিক জিনিসের ক্ষেত্রেই প্রথমে একটা গেল গেল রব ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। সত্যি বলতে কি সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের প্রচুর সাহায্যও করে। অনেক তথ্য ও খবর আমরা তাড়াতাড়ি পাচ্ছি এর দৌলতে। পরের দিনের খবরের কাগজের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না এখন আর। সেগুলো তো ভালো দিক। তাছাড়া কত সমাজসেবামূলক কাজ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। বহু মানুষ পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পাচ্ছেন। সেগুলোকে তো খারাপ বলতে পারি না। কাজেই এর ভারসাম্যটা আমাদের নিজেদেরই বজায় রাখতে হবে। যদি মনে হয় ওটার জন্য আমাকে কাজের ক্ষতি হচ্ছে, তাহলে কাজ শেষ হওয়া অবধি ওটাকে বন্ধ রাখতে হবে। সব কাজ সেরে নিয়ে সেখানে ঢুকলাম, বা কোনও পোস্ট করার হলে করলাম। এটা নিজেকেই বুঝতে হবে। এটা করতে পারলে সোশ্যাল মিডিয়া কখনওই আমাদের জীবনে নেশার মতো হয়ে দাঁড়াবে না।




এ ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হলো যে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পাওয়া বন্ধুবান্ধব, যাদের কোনওদিন চোখেই দেখেননি, তাঁদের নিয়েও মানসিকভাবে নানান জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছেন মানুষ, তার থেকে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো ছেলে, মেয়ে বা বয়স নির্বিশেষে হচ্ছে। এটা যেমন খারাপ তেমনই আবার সমমনস্ক বন্ধু বা পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এটা একটা ভালো দিক। এই খারাপ অভিজ্ঞতাগুলোকে কিভাবে এড়ানো সম্ভব? 

একটা জিনিস আমাদের মনে রাখা দরকার। আমরা যখন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছি তখন উল্টোদিকের মানুষটা, যার সঙ্গে কোনও পোস্ট বা চ্যাটে কথা হচ্ছে, তাকে আমি ততটাই জানাবো যতটা তিনি আমাকে জানাবেন। এর বাইরে গিয়ে তাকে চেনা জানার জায়গা কিন্তু কমই থাকে। সেখানে একজন মানুষকে সামনাসামনি দেখলে, তাঁর অনেক দোষ গুণই চোখে পড়তে পারে। সেটা সে দেখাতে চাক বা না চাক। সোশ্যাল মিডিয়াতে কিন্তু সেই সুযোগটা নেই। তাই উল্টোদিকের লোকটা যা বলছে, তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। এবারে যাকে কখনও দেখিনি, তাঁকে চোখ বুজে বিশ্বাস করলে তার ভালোমন্দের দায়টাও আমার ওপরেই বর্তায়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা সবই ভালো। কিন্তু মানুষটাকে সামনাসামনি চেনার আগে তাকে নিয়ে কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা উচিত নয়। আর কোনওভাবেই কোনও ব্যক্তিগত তথ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করা উচিত নয়। সে যত প্রিয় মানুষই হন না কেন। আমি তো সেই মানুষটিকে দেখিনি। প্রোফাইলে যে ছবিটা রয়েছে সেটাও তাঁরই কি না, তাও জানার কোনও উপায় নেই। তাই কোনওভাবেই কোনও তথ্য বা ছবি পাঠানো উচিত নয়। কেন না একবার জিনিসটা পাঠিয়ে দিলে তিনি যে সেটা নিয়ে কি করবেন তার ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তাই এমন কিছুই পাঠানো বা শেয়ার করা উচিত নয় যেটা চাউর হয়ে গেলে আমার অসুবিধা হতে পারে। 

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

ইদানিং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হতাশা, ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যার প্রবণতা যেন বেড়েই চলেছে। এর কারণ কি শুধুই অণুপরিবার ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি? 

একেবারেই না। আমি এটাও মানি না যে হতাশায় শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীরাই ভোগে। তবে এখানে প্রশ্নটা যখন ছাত্রছাত্রী নিয়েই তখন বলি, বড় পরিবার, যাকে একান্নবর্তী পরিবার বলা হতো সেখানে কিন্তু হতাশা অনেক বেশি ছিল। যেহেতু অনেকগুলো মানুষ সেখানে থাকতো, তাই কে কেমন রেজ়াল্ট করল বা কার বাবা কত বড় চাকরি করে, এসব কথা অনেক বেশি তুলনা টেনে আনা হতো। আর অণুপরিবার বলেই সেখানে ছেলেমেয়েরা অবহেলিত, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। এটা আসলে খুব প্রচলিত ধারণা, কিন্তু ঠিক নয়। বড় পরিবারে পারস্পরিক তিক্ততা  অনেক বেশি হয়। অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকেন বলেই সেখানে সকলের প্রচুর সময় থাকে আর তারা বাচ্চাদের খুব যত্ন নেন, এটাও মোটেই ঠিক নয়। আমি নিজে কাজ করতে গিয়েই দেখেছি। আসল কথা হলো সেই পরিবারের বাতাবরণ কেমন। সেখানে কিভাবে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা হচ্ছে, সেটাই আসল কথা। ব্যস্ততার জন্য সন্তানকে মানুষ করা যায় না এটা ভুল ধারণা। ব্যস্ততা তো থাকবেই। বাবা মা তাদের সব কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বাচ্চার সামনে বসে থাকবেন কেন? তেমন হলে তো না খেয়ে মরতে হবে। 

এই সময়ের একটা প্রচলিত ধারণা হলো মোবাইল ফোন এসে আমাদের অনেক দৈনন্দিন অভ্যাসকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমরা ফোন নম্বর আর মনে রাখি না। কোন জিনিস মনে করতে না পারলে, মাথার ওপর জোর না দিয়ে সেটা ইন্টারনেটে খুঁজে নিই। এগুলো কি সত্যিই আমাদের মস্তিষ্ককে পঙ্গু করে দিতে পারে? 

কিছুটা হয়তো পারে। আমরা চট করে কোনও কিছু মনে করতে চাইছি না, হাতে ফোনটা রয়েছে ওটা খুলে দেখে নিলেই তো হয়। এতে করে আমাদের স্মৃতিশক্তির যে চর্চা, সেটার অনুশীলন কমে যাচ্ছে। তবে ইন্টারনেট ব্যবহার করেই আবার এর থেকে মুক্তিও সম্ভব। অনেক মেমরি গেম বা মাথা খাটানোর অ্যাপ পাওয়া যায় এখন। সেগুলো অনুশীলন করা যেতে পারে। 

আরও পড়ুন: যে জন থাকে মাঝখানে

এমন অনেকেই আছেন যাঁরা নিজেদের ব্যস্ততার ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে বাচ্চা যা চাইছে তাই তার হাতে তুলে দিচ্ছেন। এটা কতটা ঠিক?

এটা করতে গিয়ে হয়তো সেই বাচ্চাটির ছোট চাহিদাগুলা মেটানো সম্ভব। কিন্তু একটা পর্যায়ে যখন তার চাহিদাগুলো এমন হয়ে যায় যা বাবা মায়ের পক্ষে আর পূরণ করা সম্ভব নয়, তখন সেটাই সন্তানের হতাশা ও অবসাদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বাবা মায়েদের উচিত ছোট থেকেই তাকে এটা বোঝানো যে চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না। না পাওয়াটাও জীবনের একটা দিক, এবং সেটার সঙ্গেও তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে। এই অভ্যাসটা করতে পারলে সে নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে নিতে পারবে। এখানে আরও একটা কথা বলার, আপনি যতই ব্যস্ত থাকুন, যদি আপনার সন্তান তার কোনও প্রয়োজনে আপনাকে চায় বা ফোন করে, সে যেমন প্রয়োজনেই হোক, তার স্কুল বা কলেজে হাজিরা দেওয়া হোক কিংবা তার কোনও মানসিক সমস্যায় আপনাকে পাশে চাওয়া হোক, তাকে সেই সময়টা দিন, তার কথা শুনুন। খুব ব্যস্ত থাকলে তাকে এই আশ্বাস দিন যে আপনি আপনার হাতের কাজটা শেষ করেই তার কথা শুনবেন। তাকে ধমকে বা বিরক্ত হয়ে সরিয়ে দেবেন না। সাধারণত কিন্তু বাচ্চারা একজনকে পাশে চায়। যখন কাউকে পায় না, তখনই সে কোনও ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নেয়। কাজেই তাকে কোনও অবস্থাতেই একা করে দেবেন না।

এই সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *