বিশিষ্টজনের স্মৃতিচারণে জেগে রইলেন নবনীতা
কলকাতা: তিনি চলে গেছেন গতবছর। রেখে গেছেন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধ ভক্তদের। একাধারে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও শিক্ষাবিদ নবনীতা দেবসেন তাঁর অগাধ পান্ডিত্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যকে। তাঁর স্মরণে সম্প্রতি এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল কলকাতা বইমেলা লিটারেচর ফেস্টিভ্যালে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন লেখক কন্যা নন্দনা সেন, সাহিত্যিক বাণী বসু ও অনিতা অগ্নিহোত্রী, কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও অধ্যাপক সংযুক্তা দাশগুপ্ত।
স্মৃতিচারণে নন্দনা তাঁর মা’কে লেখা একটি চিঠি পড়ে শোনান। দীর্ঘ এই চিঠি তিনি লেখা শুরু করেছিলেন বহু বছর আগে। এই চিঠির অনেকটাই নবনীতা পড়ে যেতে পেরেছিলেন। সেই চিঠিতে উঠে এল হাভার্ডের দিনগুলোর কথা যখন নবনীতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে দেওয়া সমস্ত সুবিধা পাওয়া সত্বেও মেয়ে ও তার বন্ধুদের জন্য বরাদ্দ দেড়খানা ঘরে এক সপ্তাহ কাটিয়েছিলেন আনন্দ করে। কীভাবে জীবনের নানা মোড়ে মা’কে পাশে পেয়েছেন সে কথাও চিঠিতে লিখেছেন নন্দনা। মৃত্যুর দশ দিন আগে যখন নিউ ইয়র্কের নামী প্রকাশকের তরফ থেকে নন্দনার অনুবাদ করা নবনীতার কবিতার বই ছাপা হয়ে আসে তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রথম আমার বই এত ভালো একটা আন্তর্জাতিক প্রকাশনী থেকে বেরোচ্ছে। এটা তো আমি নিশ্চয়ই দেখে যাব।’
না, দেখে যেতে পারেননি তিনি।
নন্দনার স্মৃতিচারণে উঠে এল নবনীতার ভ্রমণপ্রীতি নিয়ে নানা কথাও। এমনকি হুইল চেয়ার নিয়েও মেয়ের সঙ্গে নানা দেশ দেখে এসেছেন তিনি। কাজের সূত্রে এমনিও তিনি অসংখ্য দেশ ঘুরেছেন। চিরকালই ভালোবাসতেন বেড়াতে। সেই ভালোবাসাই উঠে আসত তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে।
আরও পড়ুন: অপু-দুর্গার রেলগাড়ির স্মৃতি উস্কে প্রকাশিত হলো ‘অভিযাত্রিক’-এর টিজ়ার
সংযুক্তার কথায় উঠে এল সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নবনীতার অবাধ বিচরণের বিষয়। নবনীতা নিজে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন কবিতা লিখতে। তিনি মনে করতেন কবিতা হলো দর্শনীয় (ভিস্যুয়াল) আর গদ্য হলো মৌখিক (ভার্বাল)। ‘নবনীতা দেবসেন রচনাসমগ্র থেকে সংযুক্তা পাঠ করে শোনালেন ‘যাওয়া’ কবিতাটি। উঠে এল তাঁর সামাজিক প্রতিবাদী দিকটিও। চিন্তাভাবনায় আদ্যন্ত নারীবাদী ছিলেন নবনীতা। ‘আমি নারীকে কর্মের জায়গা থেকে তুলে এনে কর্তার জায়গায় স্থান দিতে চাই,’ বলেছিলেন তিনি। তবে পুরুষবিদ্বেষকে তিনি প্রশ্রয় দেননি কখনওই, জানালেন সংযুক্তা।
কবি নবনীতাকে নিয়ে নানা কথা শোনা গেল অনিতার স্মৃতিচারণে। নবনীতার ধারণা ছিল তাঁর লেখা কবিতার সঠিক মূল্যায়ন কখনওই হয়নি। তবে সত্তর বছর বয়সেও তিনি যেভাবে প্রেমের কবিতা লিখেছেন তাতে তাঁর জীবনবোধ আরও মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে বলে মনে করেন অনিতা।
আরও পড়ুন: স্মার্টফোনেই পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি, মুক্তির অপেক্ষায় ‘চরৈবেতি’
বাণী বসু আলোচনা করলেন নবনীতার গদ্যসাহিত্য নিয়ে। নবনীতার মধ্যে তিনি বরাবর এক পরিব্রাজক সত্বাকে দেখেছেন বলে জানালেন তিনি। শুধু ভ্রমণের ক্ষেত্রেই নয়, তাঁর অন্যান্য লেখার মধ্যেও এই স্বত্বা উঠে এসেছে বারবার। তাঁর কাছে বেড়ানো মানে নিছক ঘুরতে যাওয়া ছিল না। কোথাও গেলে সেখানকার জীবনছন্দকে বোঝার চেষ্টা করতেন তিনি। তবে বিশ্বভ্রমণের শেষেও চিরকাল মনেপ্রাণে বাঙালি রয়ে গেছেন নবনীতা।
ছবি: মানিক মণ্ডল