দর্শকের অস্বস্তিই মূলধন
ছবি: মনপতঙ্গ
পরিচালনা: রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি
অভিনয়ে: শুভঙ্কর মোহন্ত, বৈশাখী রায়, সীমা বিশ্বাস, অমিত সাহা, জয় সেনগুপ্ত, তন্নিষ্ঠা বিশ্বাস, জনার্দন ঘোষ, ত্রিবিক্রম ঘোষ, অনিন্দিতা ঘোষ, অনিন্দ্য রায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘন্টা ২৯ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
লোভ শব্দটা সাধারণত নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কারণ মানুষের ষড়রিপুর মধ্যে অন্যতম হলো লোভ। কিন্তু লোভ কি সত্যিই সর্ব ক্ষেত্রে নিন্দনীয়? নিশ্চিতভাবেই না। লোভ ছাড়া নিজেকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রাণী হিসেবে মানুষ তুলে ধরতে পারত না। লোভ না থাকলে হতো না কোনও বিপ্লব। লোভ ছাড়া নিজেকে ক্রমশ উন্নততর প্রজাতিতে পরিণত করা কিংবা সংকীর্ণ অর্থে যে কোনও পরিসরে উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করাও যেত না। এই লোভই যেমন ক্রমশ ওপরে টেনে তোলে, তেমনই আবার কখনও নিচে নামিয়েও দেয়। সেই লোভের প্রতিচ্ছবি অদ্ভুত নিষ্ঠুরভাবে ফুটে উঠেছে রাজদীপ-শর্মিষ্ঠার সাম্প্রতিক ‘মনপতঙ্গ’ (Mon Potongo) ছবিতে।
গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে সাম্প্রদায়িক অশান্তির ভয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা হাসান (শুভঙ্কর) ও লক্ষ্মীর (বৈশাখী) ভালোবাসা। একসঙ্গে থাকার আশায় দুজনে শহরে আসে। শহরের ফুটপাথে সংসার পেতে বসা বাপন (অমিত) তাদের সহায় হয়। ওই ফুটপাথেই নতুন সংসার বাঁধে হাসান ও লক্ষ্মী। গ্রামের দারিদ্র্য করুণ হতে পারে, কিন্তু শহরে দারিদ্র্য বড় কুৎসিত। ফুটপাথে খাওয়া, শোওয়া, প্রাতঃকৃত্য, যৌনতা যাপন করতে গিয়ে এ কথা পদে-পদে বুঝতে পারে নবদম্পতি। এখানে কোনও আড়াল নেই, কোনও সম্ভ্রম নেই। সর্বত্র বেহায়া অভাব বিরাজমান।
এই কঠিন দিন গুজরানের মাঝেই হাসান-লক্ষ্মীর দাম্পত্যে ছাপ রেখে যায় চায়ের দোকানি জ্যোৎস্না (সীমা), বড়লোক চিত্রকর অমিতাভ (জয়), পুলিশকর্মী রাঘব (ত্রিবিক্রম), সিকিউরিটি গার্ড চরণদাস (জনার্দন) এবং আরও অনেকে। হাসানদের মাথা গোঁজার জায়গার পাশেই ফার্নিচারের ঝাঁ চকচকে দোকানে রাখা বিরাট সিংহাসন যেমন তাদের হাতছানি দেয়, জেদ ধরিয়ে দেয় আরও ওপরে ওঠার, তেমনই আশেপাশের হিংস্র জন্তু জানোয়ারের মতো কিছু মানুষ ক্রমশ থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসে সহজ, সরল দাম্পত্যকে গ্রাস করতে। কোন ফাঁদে পা দেবে হাসান আর লক্ষ্মী? তারা শেষ পর্যন্ত আপোষ করবে নাকি অবহেলা তা প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখে আসতে হবে।
আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান
রাজদীপ-শর্মিষ্ঠার আগের ছবি ‘কালকক্ষ’ ছিল কোভিড সময়ের অবসাদকে ঘিরে। সে এক অন্য মনোজগতের কথা বলেছিল। ‘মনপতঙ্গ’ও এক অন্য দুনিয়ার কথা বলে, যে দুনিয়া চোখের সামনে থাকলেও আমরা সযত্নে তাকে এড়িয়ে যাই। বাংলা ছবিতে এই জগৎ আগে কখনও এত নির্মমভাবে উঠে এসেছে কিনা জানা নেই। সত্য মানেই তো নির্মম, কখনও নির্লজ্জও। সেই নির্লজ্জ কাজটি পর্দায় করে দেখাবার জন্য সাহস লাগে। সেই সাহস দেখিয়েছেন পরিচালকদ্বয়। এই আধুনিক, স্মার্ট, ডিজিটাল শহরের এক কোণে আজও অনেক অন্ধকার জমে থাকে। আমরা জানি, কিন্তু কতকটা ইচ্ছে করেই তাকাই না। বর্তমান বিশ্বের গর্বিত ও অসভ্য দম্ভের সামনে দাঁড়াতেই পারে না বাপন, পিঙ্কিদের প্রতিদিনের লড়াই। তার সঙ্গে রয়েছে শহরের রাস্তায় উড়ে বেড়ানো টাকার রঙিন লোভ। রয়েছে ভয়ও। একটা গোটা সম্প্রদায়কে যখন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় তাদের অস্তিত্ব নিয়ে, যেখানে মানুষের উপস্থিতির চেয়ে এক টুকরো কাগজের দাম বেশি সে অবস্থা বড় করুণ। শিক্ষিত মানুষ আন্দোলন করে, প্রতিবাদ জানায়। অশিক্ষিত, গরীব মানুষ আতঙ্কে একটুকরো দাঁড়াবার জায়গাও ধরে রাখার সাহস পায় না। প্রতিনিয়ত তাদের ভয় দেখিয়ে শোষণ করা হয়, নিংড়ে নেওয়া হয় সহ্যশক্তির সবটুকু। নোংরাভাবে শেষ আব্রুটুকুও ছিনিয়ে নিতে বাধে না কারও। অনায়াসে কেড়ে নেওয়া হয় শেষ সম্বলটুকু।
বর্তমান সমাজের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে সিনেমার পর্দায়। দেখতে গিয়ে অস্বস্তি হবেই। সেই ভদ্রজনোচিত অস্বস্তিই এই ছবির মূলধন। উচ্চবিত্ত থ্রিল আর মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্টের ছবির ভিড়ে বহুদিন বাদে একটা অপরিষ্কার, নোংরা শহরের কাহিনি উঠে এল বাংলা ছবিতে। যে ছবি কাঁপিয়ে দিতে পারে যে কোনও সংবেদনশীল মানুষকে। পরিচালকদের টুপি নামিয়ে কুর্নিশ দৈনন্দিন ছদ্ম-আধুনিকতার গালে সশব্দে চাবুক মারার জন্য।
আরও পড়ুন: বাস্তুচ্যুত প্রান্তজন, নর্মদা ‘পরিক্রমা’য় দেখালেন গৌতম
নবাগত হয়েও পর্দায় ছাপ রেখে যেতে পেরেছেন শুভঙ্কর ও বৈশাখী। দুজনে তাঁদের চরিত্রে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন যে মনেই হয় না তাঁরা ওই ফুটপাথের বাসিন্দা নন। একই সঙ্গে অমিত ও অনিন্দিতার নামও করতে হয়। চরিত্রের ঘামরক্তে মিশে গেছেন তাঁরা। তবে ফুটপাথবাসী মানুষের ভাষায় কিছুটা প্রান্তিক ছোঁয়া থাকতে পারত। প্রত্যেক অভিনেতাই নিজের চরিত্রে অদ্ভুতভাবে মানিয়ে গিয়েছেন। সীমা বিশ্বাস থেকে শুরু করে ত্রিবিক্রম, তন্নিষ্ঠা, জনার্দন প্রত্যেকের সাধুবাদ প্রাপ্য। সাধারণত সদর্থক চরিত্রে দেখা যায় জয়কে। এখানে এক দ্বিস্তরীয় চরিত্রে বেশ অবাক করলেন তিনি।
আরও পড়ুন: পরনে ‘ভালো থেকো’র শাড়ি, প্রথম ছবির স্মৃতিচারণে বিদ্যা বালন
ছবির অধিকাংশ দৃশ্যে স্ট্রিট লাইটের ব্যবহার এক আলাদা মাত্রা যোগ করে। ‘কে সেরা সেরা’ গানটি শুনতে ও দেখতে ভালো লাগে। ছবিতে বেহালা শিল্পী সৌরজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় শ্রুতিনন্দন আবেশ রেখে যান।
গতবছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা প্যানোরামার সেরা পুরস্কার জিতে নিয়েছিল এই ছবি। ছবির আনকাট সংস্করণ দেখানো হয়েছিল সেখানে। প্রেক্ষাগৃহে সেই ছবি দেখাতে গেলে কিছু অংশে কাঁচি চলবে এমনটাই ভাবা হয়েছিল। তবে আশার কথা খুব বেশি কিছু বাদ পড়েনি বড়পর্দার রিলিজ়ে। বর্তমান সমাজের নির্মম বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখাই ভালো।