আলোকের ঝর্ণাধারায় আয়না দেখায় ‘মায়ানগর’

ছবি: মায়ানগর (Once Upon a Time in Calcutta)

পরিচালনা: আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত

অভিনয়ে: শ্রীলেখা মিত্র, ব্রাত্য বসু, সত্রাজিৎ সরকার, অরিন্দম ঘোষ, সায়ক রায়, অনির্বাণ চক্রবর্তী, ঋতিকা নন্দিনী শিমু, লোকনাথ দে

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆

ডাইনোসর বিলুপ্ত হলো কেন সে প্রশ্নে না গিয়েও এটুকু বলাই যায়, যা কিছু নিজেকে যোগ্যতম হিসেবে প্রমাণ করতে পারে না তাই-ই হারিয়ে যায়। ওই ডাইনোসরের মতোই। অনেকটা সেভাবেই এ শহরের বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছে পুরোনো দিনের কমার্শিয়াল থিয়েটার যেখানে ক্যাবারে নাচ ছিল নিত্যদিনের অঙ্গ। হারিয়ে গিয়েছে সেই পুরোনো মূল্যবোধ যাকে আঁকড়ে এখনও একটা বয়স্ক প্রজন্ম কষ্ট করে হলেও মানিয়ে নেয় সবকিছু। হারিয়ে গিয়েছে জীবনের সহজ সত্যগুলো, আমাদের মধ্যবিত্ত জীবন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। এসব নিয়েই বাঙালি একসময় তুমুলভাবে বেঁচেছে। এখনকার মতো ঝাঁ চকচকে ছিল না সেই দিনগুলো। শখ আর ঋণের বড়লোকির আড়ালে দীর্ঘশ্বাসকে লুকিয়ে ফেলতে আজ আমরা শিখে গিয়েছি, সেদিনও কিন্তু জানতাম না। আদিত্যর এই ছবি সেই গোড়ার দিনগুলোর গল্প বলে। যখন এই অতি আধুনিক কলকাতার ভিত গাঁথা হচ্ছিল। গল্প না বলে বরং কোলাজ বলা ভালো। যা গল্পের আকারে সামনে এলেও আসলে আমাদের আশেপাশের চেনা মানুষের মুখোশ বিশেষ। 



সদ্য কিশোরী পঙ্গু মেয়েকে হারিয়ে এলা (শ্রীলেখা) ক্রমশ নিজেকে দৈনন্দিনের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। কঠিন কঠোর বাস্তব তাকে শোক আঁকড়ে বেশিদিন থাকতে দেয় না। স্বামী শিশিরের (সত্রাজিৎ) সঙ্গে তার সম্পর্ক তলানিতে। কারণ শিশির আর যাই হোক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়। সুতরাং রং মেখে আবারও এলাকে গিয়ে বসতে হয় জ্যোতিষীর পাশে, ক্যামেরার সামনে। ওদিকে বিখ্যাত থিয়েটার পরিচালকের ছেলে বুবু (ব্রাত্য) মানসিকভাবে স্থিতিশীল না হলেও পুরোনো দিনের কথা ভুলতে পারে না। বংশের ও থিয়েটারের গৌরবকে বালির মতো মুঠোয় ধরে নিজের কাছে রেখে দিতে চায়। জেদের বশে পিতৃসম পুরোনো চাকরকে বিদায় দিয়ে ভূতের মতো একা একাই প্রাসাদের মতো বাড়ি আগলায় সে। শিক্ষিত রুচিশীল ইঞ্জিনিয়ার ও কন্ট্রাক্টর ভাস্কর (অরিন্দম) পুরোনো প্রেমিকাকে খুঁজে পেয়ে সমস্ত কিছু ভুলে প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় নিজেকে। রাজা (সায়ক) সৎভাবে চিটফান্ডের এজেন্টের কাজ করলেও কোম্পানি তাকে ডুবিয়ে দেয়। চোরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। ওদিকে চিটফান্ডের মালিক  প্রদীপ্ত (অনির্বাণ) জনতার টাকায় সাজাতে চায় নিজের স্বপ্নের রাজত্ব। এরা সকলেই স্বতন্ত্র চরিত্র, আবার সকলেই একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত। আসলে এরা সমাজের কিছু বিশেষ মুখ যাদের দিয়ে একটা গোটা সময়কে, একটা গোটা শহরকে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক। 

আরও পড়ুন: তাঁকে ছাড়া কাস্টিং অসম্পূর্ণ, বললেন তব্বু

স্বতন্ত্র চরিত্র এই কারণে বলা যায়, পরিচালকের গল্প বলার বা বৃত্ত সম্পূর্ণ করার কোনও দায় নেই। চরিত্রের প্রয়োজন মতোই গল্প এগিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং শূন্য দশকের পরবর্তী সময়ে ক্রমশ খুব দ্রুত পাল্টে যাওয়া এই শহরের রূপরেখা এই ছবির প্রধান উপজীব্য। যেখানে মানুষ ভালো থাকার জন্য ক্রমশ লোভী হয়ে উঠতে শুরু করে, আগাগোড়া এক ক্ষয়িষ্ণু সমাজ মাথার ভেতর মন্ত্র দিতে থাকে আরও চাই, একটু সুখের আশায় হায়নার মতো ওত পেতে বসে থাকে উদ্যত থাবা। সেই সমাজে নির্লিপ্ত, নির্বিবাদী শিশির কিংবা বুবুদাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। কারণ ওরা এগোতে চায় না। আপোষ করতে চায় না। 

Once Upon a Time in Calcutta

আদিত্য যে সময় এবং যে শ্রেণীকে ছবিতে এনে ফেলেছেন তাদের ইদানিং আর খুব একটা রুপোলি দুনিয়ায় দেখা যায় না। সমাজ মাধ্যম থেকে বিজ্ঞাপনী দুনিয়া সর্বত্রই আজ শুধু আলোর সমারোহ, অন্ধকার সেখানে অবহেলিত। এই যে সারাক্ষণ আমিত্বের বিজ্ঞাপন, সারাক্ষণ শুধু প্রচারের আলোয় নিজেকে মেলে ধরা সেই পৃথিবীটার শুরুর সময়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় এ ছবি। দেখায়, কিন্তু কোথাও বলে দেয় না এটা খারাপ বা এটা ভালো। শুধু ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’-এর রিমিক্সের মতো কান থেকে মাথা হয়ে মনের ভেতর হাতুড়ি পিটতে থাকে অজানা এক চেতনা। পাড়ায়-পাড়ায় রবীন্দ্রনাথের মূর্তি আর ভেজাল উপাদানে তৈরি হঠাৎ ভেঙে পড়া উড়ালপুল নিয়ে এ কোন সমাজ তৈরি করেছি আমরা? সংস্কৃতির নামে এ কীসের চর্চা চলছে! এর চেয়ে সেই সারকারিনার চলমান মঞ্চের ক্যাবারেও কি ভালো ছিল না? শিক্ষা, সংস্কৃতি থেকে মূল্যবোধ সবটাই তো আসলে সেই ডাইনোসরের সঙ্গে আজ একই লাইনে দাঁড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথের এই বিশেষ গানটিকে পরিচালক যেভাবে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন তার সমতুল্য কিছু এ সময়ের কোনও ছবিতে দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ে না। ভেঙে যাওয়া উড়ালপুল আর অজস্র রবীন্দ্রনাথের মূর্তির লুটোপুটি খাওয়ার দৃশ্যকল্পে প্রকৃত সুরে ‘মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও’ পংক্তি যেন মুহূর্তে মাথায় চাবুক মেরে যায়। একটা গোটা জাতের অধঃপতন কী মহাসমারোহে ঘটে গেল! 

আরও পড়ুন: কনসার্ট ইকোনমির পক্ষে সওয়াল নরেন্দ্র মোদির

এ ছবিতে অভিনয় একটা বড় জোরের জায়গা। এলার চরিত্রে শ্রীলেখা অতুলনীয়। একাই একটা ছবির ভার বহন করতে সক্ষম তিনি। বাংলা ছবিই সম্ভবত শ্রীলেখার যোগ্য চিত্রনাট্য লিখতে জানে না, নাহলে নিশ্চয়ই আরও বেশি ছবিতে দেখা যেত তাঁকে। প্রতিটি দৃশ্যে, প্রতিটি ফ্রেমে তিনি অনবদ্য। বুবুদা চরিত্রে ছোট পরিসরে ব্রাত্য যেন খাপখোলা তলোয়ার। যখন তিনি পর্দায় নেই তখনও কী ভীষণভাবে বারবার মনে হয় বুবুদা কোথায় গেলেন। ব্যক্তিসত্তার ওপর উঠে চরিত্র হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যেসব অভিনেতার আছে, ব্রাত্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শিশিরের চরিত্রে সত্রাজিৎ যতটা বিশ্বাসযোগ্য ততটাই সম্ভ্রম আদায় করে নেন। ভাস্করের চরিত্রে অরিন্দম, রাজার চরিত্রে সায়ক এবং সবশেষে যার কথা বলতেই হয় সেই প্রদীপ্তরূপী অনির্বাণ, প্রত্যেকে যে যার ভূমিকায় অপরিহার্য। অনির্বাণ অন্য ধরনের চরিত্রেও নিজেকে যেভাবে প্রমাণ করছেন, বাংলা ছবির জন্য আশার কথা নিঃসন্দেহে। 

‘মায়ানগর’-এ গল্প, চরিত্র এবং তাদের পরিণতি সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় ছবির ভাষা। সেই ভাষা এতটাই জোরালো যা ছবি শেষের পরে অনেকটা সময় ধরে ভাবতে বাধ্য করবে। চরিত্র ছাড়াও চিত্রনাট্য, আবহ, সম্পাদনা এবং চিত্রগ্রহণ সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েই ছবির সেই জোরালো ভাষা ফুটে ওঠে যা দর্শকের মগজে ঢুকে ধাক্কা মারার ক্ষমতা রাখে। সেই কারণেই এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে বসে দেখা জরুরি।




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *