পপকর্ন হাতে আরামে বসে দেখার ছবি নয়

ছবি: মহিষাসুরমর্দ্দিনী

পরিচালনা: রঞ্জন ঘোষ 

অভিনয়ে: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সাহেব ভট্টাচার্য, শ্রীতমা দে, অর্জুন ঘোষ, অরুণিমা হালদার, অভ্যুদয় দে, পূর্বাশা মাল, কৌশিক কর, পৌলমী দাস, পবন কানোরিয়া

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট

RBN রেটিং: ৩.৫/৫

ভাষা শুরুর আদিতে বেশ কিছু শব্দ সৃষ্টির সময়ে মানুষ হয়তো ভেবেই দেখেনি প্রতিটি লিঙ্গের জন্য আলাদা শব্দ প্রয়োজন। সময় ও পরিশ্রম বাঁচাতে গিয়ে একই শব্দের এদিক ওদিক করে অর্থ নির্দেশ করার ছুতোয় আজীবন নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গের মূল্য দিয়ে যেতে হয়। অভিনেতা-অভিনেত্রী, লেখক-লেখিকা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, এসবের মাঝে কেমন যেন পুরুষের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল নারী। প্রগতিশীল সমাজ বর্তমানে একই পেশায় থাকা দুই লিঙ্গকে এক নামেই সম্বোধন করে আসছে যদিও, তবু এই নিয়ে অজ্ঞতা ছিল, থাকবে। 



‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ ছবিটিকে পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন নারীজাতির প্রতি পুরুষের ক্ষমা প্রার্থনার এক উড়োচিঠি হিসেবে। সেই অজস্র, অসংখ্য অপরাধের জন্য যার প্রকৃতই কোনও ক্ষমা হয় না। ছবিতে দুর্গাপুজোর আগের রাতে স্থানীয় এক বাড়িতে ঠাকুর সাজানোর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির মধ্যেই এলাকায় ঘটে যায় এক নৃশংস ঘটনা। চালচুলোবিহীন মূক ও বধির একটি ছোট্ট মেয়ে, যে রাতে কখনও শ্মশানে কখনও বা কবরস্থানে ঘুমোত, সেই মেয়েটিকে কারা যেন ধর্ষণ করে জ্বালিয়ে দেয়। পুজোবাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকা চারটি ছেলেমেয়ে ও তাদের আশ্রয় দেওয়া ম্যাডাম (ঋতুপর্ণা) সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্রমশ সেই রাতে বাড়িতে আসতে শুরু করে একের পর এক অতিথি। তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিকোণ আলাদা, প্রত্যেকের যুক্তি আলাদা। এতগুলো আলাদা অস্তিত্ব মিলে খুব সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলে, কিন্তু মেলে না। হয়তো উত্তর নেই তাই। 

আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার

রঞ্জনের এই ছবি সমসাময়িক অন্যান্য ছবির থেকে বেশ স্বতন্ত্র। ভাবনা বা বক্তব্য সবটাই এখানে এসেছে মেটাফর বা রূপকের মাধ্যমে। রূপক নারীশক্তির, রূপক পুরাণের যুগ থেকে হয়ে আসা নারীর ওপর অবিচারের, রূপক নারীকে ঢেকে পুরুষকে এগিয়ে দেবার প্রচেষ্টার। যুগ-যুগ ধরে ঘটে চলা এক অদ্ভুত অসম অথচ প্রত্যাশিত ইতিহাস, যা নারীকে নির্যাতিতা হয়েও বারবার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। অন্যদিকে অদৃশ্য বিচারালয়ের কারসাজিতে কাল্পনিক সওয়াল জবাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায় পুরুষ তথা শক্তিশালী লিঙ্গ। তবু প্রতিবছর ঢাক বাজে, উমা আসেন বাপের বাড়ি। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী, লক্ষ্মী, সরস্বতী এমন অজস্র দেবীর আরাধনায় বুঁদ হয়ে থাকে নারীপুরুষের দল। অথচ নিজের অজান্তেই কোথাও না কোথাও দুর্বলের ওপর হয়ে চলা অন্যায়কে মদত দেয় তারা প্রত্যেকে। তবু পুরুষ মানে তো শুধু রমণীকে তাচ্ছিল্য করা মহিষাসুর নয়, বা রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে পাতালে পাঠানো রামও নয়। কখনও-কখনও সে দ্রৌপদীর বন্ধু কৃষ্ণও হয়ে ওঠে। কালোর মাঝে কিছু আলোও জ্বলে ওঠে সময় বিশেষে। তবে সবাই সুবিচার পায় ন। সবার কথা হয়তো মুখ ফুটে বলাই হয় না। 



ছবি শুরুর দৃশ্য দর্শককে বড়সড় ধাক্কা দিয়ে যায়। দাঁড় করিয়ে দেয় এমন কিছু সত্যের মুখোমুখি যেখানে পপকর্নের ঠোঙা হাতে আরামে বসে ছবি দেখার অবসর নেই। সাম্প্রতিক অতীতের একাধিক শিশু নির্যাতনের ঘটনা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। দর্শকাসনে বসে থাকা প্রতিটি বিবেকবান মানুষের চোয়াল শক্ত হবে। প্রথমে ঘটনা পরম্পরা বুঝতে একটু সময় লাগলেও, কিছুক্ষণ পরেই চমক লাগে, এ কাদের দেখছি! পুরাণের সেই সব চরিত্র যাদের কথা আশৈশব জেনে এসেছি, তাহলে কি এই অবিচার, এই তাচ্ছিল্য কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়? পুরুষ চেতনায় আগাগোড়াই এই সর্বশক্তিমান হওয়ার ভুল ধারণা প্রোথিত হয়ে রয়েছে, হয়তো তার নিজের অজান্তেই। পৌরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে এমনকি ব্যক্তিগত সুখ শান্তির ক্ষতিও তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়!

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

প্রতিটি দৃশ্যের উপস্থাপনা ও আঙ্গিক, দুই-ই মঞ্চাভিনয়কে মনে করাবে। এক রাতের ঘটনাক্রমকে পরপর সাজিয়ে তোলার মধ্যে অভিনবত্ব আছে। এও মঞ্চকে মনে পড়িয়ে দেবে। আলোর ব্যবহার থেকে সংলাপ চয়ন, সবেতেই সেই প্রচেষ্টা নজর কাড়ে। ছবির প্রায় পুরোটাই তোলা হয়েছে এক ঠাকুর দালানে। ছবির শুটিংয়ের ক্ষেত্রে এ এক অন্যরকম প্রচেষ্টা বলাই বাহুল্য। ছবি দেখতে বসে শুধু নয়, শেষের পরেও ভাবতে বাধ্য করবে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। শুধু যে জ্বলন্ত সমস্যা, যা নিয়ে এই ছবি শুরু হয়েছিল, তার কিছু বাস্তব সমাধানসূত্র পেলে ছবির সার্থকতা নিঃসন্দেহে আরও বাড়ত।

অভিনয় নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ঋতুপর্ণা, শাশ্বত, পরমব্রত প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। নতুন অভিনেতারাও সকলেই যথাযথভাবে চরিত্রের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। 

অভিজিৎ কুণ্ডুর আবহ প্রশংসার দাবি রাখে। শুভদীপ দে’র চিত্রগ্রহণ ছবিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

শুধু কাহিনী বা চিত্রনাট্যই নয়, পরিবেশনের ক্ষেত্রেও বাংলা ছবিতে ইদানীংকালে বেশ কিছু নতুন চিন্তাভাবনার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ সেই তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে বলে আশা করা যায়। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *