সহজ ভাষায় ব্যক্তিস্বাধীনতার ছবি
ছবি: বৌদি ক্যান্টিন
পরিচালনা: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৫৭ মিনিট
অভিনয়ে: শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, সোহম চট্টোপাধ্যায়, পুষণ দাসগুপ্ত, অনসূয়া মজুমদার, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়
RBN রেটিং: ৩/৫
সংসারে কোন কাজটা মেয়েদের আর কোনটা পুরুষদের, এ বিচার করে কে? সত্যি কথা বলতে কী, এ বিচার করা যায় না। উচিতও নয়। রান্না করা যদি মেয়েদেরই কাজ হবে তাহলে তাবড় শেফ হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের নাম শোনা যায় কেন? আবার ঘরকন্না ব্যতীত বাইরের সমস্ত কাজ যদি পুরুষই করবে, তাহলে প্রতিদিন হাজারো নারী কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অফিস ছোটে কিসের তাগিদে? ঘরকন্না, সন্তানকে বড় করা, খেলাধুলা, সামরিক বাহিনী, আইনি নিরাপত্তা প্রদান, সবকিছুতেই আজ নারী ও পুরষ সমানভাবে এগোচ্ছে। এটাই নারী, থুড়ি মানব স্বাধীনতা। নারী স্বাধীনতা মানেই যে পুরুষের মতো হওয়া নয়, সেটা অনেকেই ভুলে যান। নারী হোক বা পুরুষ, তাকে নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতা দেওয়াই হলো আসল কথা। পরমব্রত তাঁর নতুন ছবিতে সেই কথাই ফের মনে করালেন। ছবির নাম যতটাই হালকা মেজাজের হোক না কেন, তার বক্তব্য বেশ কঠিন একটি বাস্তব।
আর পাঁচটা মেয়ের মতো চাকরি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদ অনুভব করে না পেশায় শিক্ষিকা পৌলমী (শুভশ্রী)। সাতসকালে নিজে হাতে বাজার করে বাড়ির সকলের জন্য বিভিন্ন পদের রান্না করার মধ্যেই সে খুঁজে পায় আনন্দ। তবু রোজগারের তাগিদে তাকে কর্মস্থলে যেতেই হয়। দৈনন্দিন এই রোজনামচায় খুশি নয় পৌলমী। বরং প্রতিদিন বরকে অফিসে বিভিন্ন পদ রেঁধে টিফিনে দিতে উৎসাহী সে। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখে পৌলমী।
এদিক পৌলমীর শাশুড়ি সুরভী (অনসূয়া) কিছুতেই চান না তার বৌমা সারাদিন রান্নাঘরে খুন্তি নেড়ে সময় নষ্ট করুক। মেয়েদের জীবনে রান্না করে সময় অপচয় করাকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখেন। পৌলমীর বর সৌরিশ (পরমব্রত) একটি বাংলা সংবাদপত্রের অফিসে চাকুরিরত। ছোট থেকে সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও পারিপার্শ্বিক চাপে সে চাকরি করতে বাধ্য হয়। পুরুষ, তাই রোজগার তো করতেই হবে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও, কাগজে মেয়েদের রোজনামচার পাতাটি সুন্দর করে সাজানোর কাজটি হাসিমুখে করে সৌরিশ। প্রতিদিন বউয়ের হাতে ভালোমন্দ টিফিন আনলেও সেই খাবারের সিকিভাগও তার কপালে জোটে না। পৌলমীর তৈরি করা খাবার প্রায় পুরোটাই চলে যায় সৌরিশের সহকর্মীদের পেটে।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
সৌরিশের অফিসে দুপুরের খাবার সরবরাহকারী বাবলু তাকে প্রস্তাব দেয়, পৌলমী যেন তার কেটারিং ব্যবসার অর্ধেক পার্টনার হয়। সৌরিশ জানে পৌলমীর ইচ্ছা এ ধরণের কোনও কাজে নিজেকে যুক্ত রাখা। এরকম একটি সুযোগকে সে কিছুতেই হাতছাড়া করে না। বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে সৌরিশ পৌলমীকে ব্যবসার কাজে উৎসাহ দেয়।
সহজ, সরল ভাষায় একটি কঠিন বিষয়কে তুলে ধরেছেন পরমব্রত। সমাজের চাপে অনেক মেয়ে বলতেই ভুলে গেছে যে তারা নিজের ইচ্ছাতেই গৃহকন্নার কাজ করতে চান। এমন অনেক উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে আছেন যারা নিজেদের ইচ্ছায় ব্যবসা শুরু করেছেন। নারী বা পুরুষ স্বাধীনতার চেয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েদের মতোই এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা হয়তো দশটা-পাঁচটা চাকরির পরিবর্তে ছবি তুলতে বা আঁকতে ভালোবাসেন। ছেলে মানেই যে চাকরি করে রোজগার করতেই হবে, এই ধারণা পাল্টানো আবশ্যক।
আরও পড়ুন: নেপথ্যে গাইলেন জলি, স্টেজে দাঁড়িয়ে ঠোঁট মেলালেন রাহুল দেব বর্মণ
পৌলমীর চরিত্রের মাধ্যমে পরমব্রত ব্যক্তিস্বাধীনতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে ছবিতে সবথেকে জোরালো চরিত্রটি সৌরিশের। প্রতিবাদ করতে না পারা, লুকিয়ে স্ত্রীকে সমর্থন করা, কখনও পুরুষালী ইগোর কারণে স্ত্রীর ওপর অভিমান করা এবং শেষ পর্যন্ত সুরভীকে জোর গলায় সত্যি কথা বলা, এরকম একটি চরিত্র খুব কম ছবিতেই এতটা সূক্ষভাবে দেখানো হয়েছে। বেশিরভাগ মেয়ে বিয়ের পর যেরকম শ্বশুরবাড়ি চায় পৌলমীর শ্বশুরবাড়ি ঠিক তা়ই। সুরভী চান পৌলমী কাজে বেরোক, চাকরি করুক। তিনি নিজেও একটি সমাজসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। সারাদিন সেই নিয়েই ব্যস্ত। সেখানে নিজের আধিপত্য এবং সুনাম বজায় রাখার জন্য তিনি সব কিছু করতে প্রস্তুত। তবু পৌলমীর ইচ্ছার সঙ্গে তার অতিআধুনিক চিন্তাভাবনা কিছুতেই মেলে না। তাই চাকরি ছেড়ে বাবলুর সঙ্গে পৌলমীর কেটারিং ব্যবসায় তার ঘোরতর আপত্তি।
অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথাযথ। তবে বিশেষভাবে বলতেই হয় শুভশ্রীর কথা। সাম্প্রতিককালে একাধিক ছবিতে তারকা নয়, অভিনেত্রী শুভশ্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ‘বৌদি ক্যান্টিন’ সেরকমই একটি ছবি। একইভাবে ভালো লাগে সোহমের অভিনয়। পরমব্রত তাঁর নিজের মতোই সাবলীল। জয় সরকারের সুরে ছবির গানগুলি ভালো। চিত্রনাট্যের অনুপাতে ছবির দৈর্ঘ্য একদম ঠিকঠাক। পরমব্রত যা বলতে চেয়েছেন শেষ পর্যন্ত সবটাই বলতে পেরেছেন।