“আর কখনওই বিদেশে অনুষ্ঠান করতে যাব না”
সালটা ২০১৪। মুক্তি পেল ‘চতুষ্কোণ’। সেই ছবিতেই সাড়া ফেলে দিল একটা গান, ‘বসন্ত এসে গেছে’। ব্যতিক্রমী গায়কীতে মুগ্ধ হলো শ্রোতা। উঠে এলেন লগ্নজিতা চক্রবর্তী। বায়োটেকনোলজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি তখন বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তারই মাঝে এসে গেল গান গাওয়ার সুযোগ। এল ‘প্রেমে পড়া বারণ’, ‘এভাবে গল্প হোক’, ‘হৃদয়ের রং’-এর মতো গান। সাতটা বসন্ত পেরিয়ে স্বভাবশান্ত লগ্নজিতা মনের ঝুলি খুলে দিলেন রেডিওবাংলানেট-এর কাছে। শুনলেন মিলি বসু।
লকডাউনে কীভাবে সময় কাটাচ্ছ?
আমি ভীষণ ঘরকুনো প্রকৃতির মানুষ। সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ি। শরীরচর্চা, গানের রেওয়াজ, কিছুক্ষণ ধ্যান করা এগুলো আমার রোজনামচা। তাছাড়া আমি আর আমার স্বামী তামিলনাড়ুতে যেখানে থাকি, সেখানে আমাদের বাড়িতে যেহেতু সাহায্যের কোনও লোক নেই, তাই রোজকার রান্নাবান্না করাটাও আমার দায়িত্ব। এছাড়া প্রত্যেক দিন পড়াশোনা, কাজকর্মের বাইরেও আমার নিজের মতো করে কিছুটা সময় কাটাতে ভালো লাগে। এমনি আমি বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করি। আর এখন তো রাষ্ট্রই বাড়িতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে ।
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে গানের জগতে এলে কীভাবে?
আসলে আমি ছোট থেকে পড়াশোনা নিয়েই থাকতাম। অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার করার ইচ্ছে ছিল। কিছুদিন চাকরিও করেছি। ‘চতুষ্কোণ’-এ গান গাওয়ার পর আমি বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেইমতো পড়াশোনাও করছিলাম। কিন্তু হঠাৎই মনে হলো দেশেই থাকতে চাই। এখানেই কাজ করব। তারপর তো একের পর এক ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনাটা আর হলো না।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
‘বসন্ত এসে গেছে’ তোমাকে পরিচিতি দিয়েছিল। তোমার কন্ঠ, শব্দোচ্চারণ সবটাই অন্যরকম। এর জন্যই কি তোমার আজকের লগ্নজিতা হয়ে উঠতে সুবিধা হয়েছে?
এটা একদমই সত্যি কথা যে আমার গায়কী বা শব্দের উচ্চারণ ব্যতিক্রমী। তাই খুব সহজে লোকে আমাকে চিনতে পারছে। তেমনই এই গায়কী প্রচুর পরিমাণে কাজ পাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিতও করেছে। যেহেতু সব গান আমার গলায় মানায় না, তাই আমি খুব সিলেক্টেড কাজ পাই। আবার সেই কারণেই কখনও-কখনও আমাকে দিয়ে গাওয়ানোর পরেও সেই গান অন্য কাউকে দিয়ে রেকর্ড করানো হয়। যেমন ‘মেঘনাদবধ রহস্য’তে ‘তোমরা এখনও কি’ গানটি আমি গাওয়ার পর নিকিতা গান্ধীকে দিয়ে গাওয়ানো হয়। এবং এটা খুব সত্যি কথা যে গানটা নিকিতা আমার থেকে অনেক ভালো গেয়েছে। ওর গলায় এই গানটা অনেক বেশি ভালো লেগেছে। আবার আমার গানের জন্যই আমি প্রচুর পুরস্কার পেয়েছি। তাই এই ব্যতিক্রমী গায়কীর একদিকে যেমন সুবিধা আছে তেমনই অসুবিধাও রয়েছে।
শুনেছি বিদেশে অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে তোমার অনীহা রয়েছে
২০১৯-এর পুজোয় শেষবার বিদেশে অনুষ্ঠান করেছি। তারপর তো কোভিডের কারণে সব বন্ধ। তবে কোভিড না হলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাত না। আমি আর কখনওই বিদেশে কোনও অনুষ্ঠান করতে যাব না।
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
কেন? শ্রোতা নিয়ে কোনও সমস্যা?
না, তা নয়। ওখানকার যারা সংগঠক, তারা এতটাই অভদ্র ব্যবহার করেন যে মনে হয় আমাদের উপর দয়া দেখাচ্ছেন। তবে এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। এমন অনেক পুরুষশিল্পী বা আমার থেকে বড় শিল্পীরা আছেন যাঁরা বলেন ওনারা অনেক সম্মান পেয়ে থাকেন। তবে আমার চেহারার কারণেই কিনা জানি না, হয়ত আমাকে বয়সে ছোট মনে হওয়ায় তাঁরা আমাকে যা খুশি তাই বলতে পারেন বলে মনে করেন। আমি সংগঠকদের টাকায় বিদেশ ঘুরতে যাই না। সেটা আমি নিজেই করতে পারব বা পারি। আমরা কলকাতার শিল্পীরা ওখানে অনুষ্ঠানটা করতেই যাই। এমন তো নয় যে কলকাতায় অনুষ্ঠান করে আমরা যা উপার্জন করি, বিদেশে তার তিন-চারগুন বেশি রোজগার করতে পারব। আমরা এখানে যা পারিশ্রমিক পাই, ওখানেও তাই পাই। তাহলে কেন অভদ্র আচরণ সহ্য করব? তবে সবাই এমন নয়। বিদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এমন অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে যাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
গানের পাশাপাশি অভিনয় জগতে এলে কীভাবে?
(হেসে) আরে না-না। আমি অভিনয় জগতে আসিনি। আমি ওটা একদম পারি না। বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), রানাদা (অভিজিৎ গুহ) ও ঝুমুরদির (সুদেষ্ণা রায়) অনুরোধে ‘যদি বলো হ্যাঁ’ ছবিতে হৈম চরিত্রটা করেছিলাম। ওরা তিনজন আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ। তাই ওদের অনুরোধ আমি ফেলতে পারিনি। আমার মোট ছ’দিনের কাজ ছিল। খুব মজা করেছিলাম।
তাহলে এখন থেকে গান না অভিনয়, কোনটা এগিয়ে? পরে এরকম অভিনয়ের সুযোগ এলে আবার করবে?
অবশ্যই গান। আমি তো বললাম, আমি একদম অভিনয় পারি না। আমি গান পারি। ওটাকেই ভালো করে করার চেষ্টা করি সবসময়। আর আজকাল তো অভিনয় একপ্রকার মজার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কীরকম?
দেখতে সুন্দর হওয়া মানেই সে অভিনয় পারবে। সবকিছুই শিখতে হয়, অভিনয়টাও। তাই আমি অভিনয় নিয়ে ছেলেখেলা করতে চাই না। যদি কখনও আমার খুব কাছের মানুষদের থেকে অভিনয়ের প্রস্তাব পাই—যাদের আমি না বলতে পারি না—সেক্ষেত্রে ভেবে দেখা যাবে। আপাতত গানটাই মন দিয়ে করতে চাই।
অনুলিখন: গার্গী মজুমদার