হালকা আঁচে, পরিমিত উপাদান সহযোগে
সিরিজ়: রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি
পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: আজমেরি হক বাঁধন, রাহুল বোস, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অঞ্জন দত্ত, অনির্বাণ চক্রবর্তী, রজত গঙ্গোপাধ্যায়, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ৪ ঘন্টা ৩১ মিনিট ( ৯ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
‘আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী’। সে চঞ্চলা, সে অপরূপা, সে মুশকান জুবেরি। সুন্দরপুরের এক রহস্যময় রেস্তোরাঁ ও তার একমাত্র রহস্যময়ী মালকিন মুশকান জুবেরিকে নিয়ে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন লিখেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’। দুই বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এই থ্রিলার। সেই উপন্যাসকে ভিত্তি করেই সৃজিত পরিচালনা করেছেন একই নামের সিরিজ়।
উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র নুরে ছফা সৃজিতের সৃষ্টিতে নাম পাল্টে হয়েছে নিরুপম চন্দ। একটি অন্তর্ধানের মামলার তদন্ত করতে সিবিআই-এর পোড় খাওয়া অফিসার নিরুপম কলকাতা থেকে সুন্দরপুর হাজির হয়। বেশ কয়েকমাস ধরে একই বয়সের কয়েকটি ছেলে হঠাৎ করেই সুন্দরপুর থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে শেষ দেখা গেছে মুশকানের রেস্তোরাঁয়। নিরুপমের ধারণা, এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে মুশকানের কোনও যোগাযোগ আছে। নিরুপমকে তার অনুসন্ধানে সাহায্য করে স্থানীয় পুলিশ ইনফর্মার আতর আলি। কিন্তু কে এই মুশকান? কোথা থেকে এসেছে সে? একাধিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায় নিরুপম। একজন আধুনিক, সুশিক্ষিত, একাকী মহিলার সঙ্গে স্থানীয় গোরখোদক ফালুর কী সম্পর্ক? ফালুর ওপর নজরদারি শুরু করে আতর। তার ঘরে তল্লাশি করে খাটের নীচ থেকে বেরোয় লুকিয়ে রাখা নরকঙ্কাল। কী হয় এরপর?
আরও পড়ুন: নব্বইয়ের ‘সত্যান্বেষী’, বাদ পড়লেন ব্যোমকেশ
নাজিম উদ্দিনের রচনার সঙ্গে সিরিজ়টির তুলনা করলে কিছু জায়গায় এগিয়ে থাকবে সৃজিতের পরিচালনা। হালকা আঁচে, সময় নিয়ে, পরিমাণমতো মশলা সহযোগে কষিয়ে রান্না করেছেন সৃজিত। মূল উপন্যাসের বেশ কিছু অংশের গতি এতটাই স্লথ যে পড়তে গেলে কিছুটা হলেও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। সিরিজ়ে সেই খামতি রাখেননি সৃজিত।
সাহিত্যনির্ভর ছবি পরিচালনা করার সময় অনেক ক্ষেত্রেই পরিচালক নিজস্ব কিছু উপাদান যোগ করে দেন। সেই পথে হাঁটেননি সৃজিত। এই সিরিজ়ে মূল উপন্যাসকে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তাই গল্পে কোনও ফাঁক থাকলেও তার দায় লেখকের, পরিচালকের নয়। ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমান ঘটনার মেলবন্ধন মজবুত হওয়ায় সিরিজ়ে সুন্দর কন্টিনিউটি বজায় রয়েছে। যেমন, উপন্যাসের একদম শেষে ১৯৭২ সালের একটি বিমান দুর্ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সিরিজ়ের ক্ষেত্রে সেই দৃশ্যকে একদম শুরুতে এনে সৃজিত রহস্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
মনের এমন কোনও ভাব নেই যার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখে যাননি। সিরিজ়ের শুরু থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার যেন মুশকান জুবেরির রহস্যময় চরিত্রের চিত্রপট। মূল উপন্যাসেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। গানগুলি এক না হলেও উপন্যাসের বেশ কয়েকটি পর্বে রবীন্দ্রনাথের গানের দু’কলির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সিরিজ়েও প্রতিটি মুহূর্তে মুশকানের মনের ভাব ফুটে উঠেছে ভিন্ন-ভিন্ন পর্যায়ের রবি ঠাকুরের গানে। জয়তী চক্রবর্তীর কণ্ঠ এক অদ্ভুত স্থিরতা প্রদান করেছে যা মুশকানের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। রশিদ খানের কণ্ঠে সিরিজ়ের শীর্ষসঙ্গীত ‘কার মিলন চাও বিরহী’ গল্পের জন্য আদর্শ। সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকারকে কুর্নিশ।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথাযথ। চরিত্রের নাম বদল হলেও তা কোনওভাবেই সিরিজ়ে প্রভাব ফেলেনি। সাহসী, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, অসম্ভব সুন্দরী মুশকানের চরিত্রে বাঁধনের অভিনয় নজরকাড়া। মুশকানকে জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি। নিরুপমের ভূমিকায় রাহুলকে ভালো লাগে। তাঁর কন্ঠস্বরই যে কোনও চরিত্রে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে। আতর আলির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য এই ছবির রত্ন। তাঁর পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে বলা সংলাপে কোনও ত্রুটি নেই। লোকাল থানার অফিসার তপন শিকদারের চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং প্রাক্তন সিবিআই অফিসার খরাজ খাসনবিশের ভূমিকায় অঞ্জন যথাযত। ফালুর ভূমিকায় দেবপ্রিয়র অভিনয় প্রশংসাযোগ্য। বিশিষ্ট অভিনেতা মৃণাল মুখোপাধ্যায়ের ছেলে দেবপ্রিয়। একজন গোরখোদকের শারীরী ভঙ্গিমা, চাহনী সবকিছুতেই দক্ষ অভিনয়ের দ্বারা দেবপ্রিয় প্রমাণ করলেন তিনি পিতার সুযোগ্য পুত্র।
এই সিরিজ়ে একটি দৃশ্যের জন্য মেকআপের ব্যবহার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মূল কাহিনীতে যেভাবে মেকআপের উল্লেখ ছিল তা বাস্তবসম্মত না হলেও, সিরিজ়ে সোমনাথ কুণ্ডুর কাজ সেই দৃশ্যের জন্য মানানসই।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
সিরিজ়ের চিত্রনাট্য ও সংলাপও সৃজিতের। ‘My name is Nirupam Chanda and I am not a journalist’ বা ‘আপনি একটু জল খান’ জাতীয় সংলাপে সৃজিতীয় ছাপ স্পষ্ট। একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি।
মূল উপন্যাস শেষ হয় এমন কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে যার মীমাংসা এই সিরিজ়ে খোঁজা নিরর্থক। ছবির অন্তিমলগ্নে একদম নিজস্ব একটি ট্যুইস্ট গুঁজে দিয়েছেন পরিচালক। যাঁরা মূল উপন্যাসটি পড়েছেন এবং যারা পড়েননি, উভয়পক্ষেরই ভালোলাগার তালিকায় জায়গা করে নেবে এই সিরিজ়। রহস্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বর্তমান। তবু কোথাও যেন মূল উপন্যাসকে একধাপ হলেও ছাপিয়ে গেছে সৃজিতের পরিচালনা।