ফিরিয়ে দেয় এক টুকরো নিখাদ ছোটবেলা
ছবি: আবার বছর কুড়ি পরে
পরিচালনা: শ্রীমন্ত সেনগুপ্ত
অভিনয়ে: তনুশ্রী চক্রবর্তী, আবির চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, আর্য দাশগুপ্ত, পুষণ দাশগুপ্ত, তনিকা বসু, দিব্যাশা দাস, রাজর্ষি নাগ, অরিত্র দত্ত বণিক
দৈর্ঘ্য: ২ঘন্টা ৪০ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
‘আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!/আবার বছর কুড়ি পরে—/হয়তো ধানের ছড়ার পাশে/কার্তিকের মাসে—/তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—/তখন হলুদ নদী/নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে।/’
কুড়ি বছর পর আবার দেখা! ছোটবেলায় একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা চার বন্ধুর ফের একসঙ্গে হওয়া। অনেকটা জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার মতোই দেখা হয় তাদের। জীবন সত্যিই বড় বিচিত্র, বড় আনপ্রেডিক্টেবল। কখন, কোথায়, কার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠবে কেউ জানে না। আবার সেই সম্পর্কই এক তুড়িতে ভেঙে যেতেও সময় লাগে না। তবু সবকিছু কি সত্যিই এত সহজে ভেঙে ফেলা যায়? ভাঙা কাচের মধ্যে ধূসর হয়ে যাওয়া ছবিগুলো কি সত্যিই পুরোনো হয়ে যায়? নাকি দিনের পর দিন স্মৃতির উসকানিতে আরও তরতাজা হয়ে ওঠে। কেউই তার অতীত সম্পূর্ণ ভুলে এগিয়ে যেতে পারে না। ভোলা যায় না ছোটবেলায় স্কুলের দিনগুলো, টিফিন খাওয়া, দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া। তাই মনের মধ্যে এক টুকরো কৈশোরকে বাঁচিয়ে রেখে চিরাচরিত ব্যস্ততার ভিড়ে ডুবে যেতে হয়, এগিয়ে যাওয়ার নামে। শ্রীমন্তর ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ এরকমই পাঁচ বন্ধুর গল্প। তাদের বড় হওয়া, ভালোবাসা, বিরহ এবং পুনর্মিলন দেখতে-দেখতে কেটে যায় গোটা সময়টা।
অরুণ (আবির), বনি (অর্পিতা), নীলা (তনুশ্রী), দত্ত (রুদ্রনীল) এবং জয়ন্ত ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠে। কখনও গ্রুপ স্টাডির নাম করে বনির বাড়িতে মদ খাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার, কখনও বা গরমের ছুটিতে বনিদের তাকদার বাংলোয় ঘুরতে যাওয়া, সবেতেই এই পঞ্চপাণ্ডব একসঙ্গে। বন্ধুত্ব থেকে ধীরে-ধীরে প্রেম এবং অবশেষে সাত পাকে বাঁধা পড়ে বনি ও অরুণ।
এভাবে দিনগুলো ভালোই কাটছিল। তবু দুজন যখন বন্ধু থেকে স্বামী-স্ত্রী হয়, তখনই বোধহয় তাদের সম্পর্কের কোথাও দানা বাঁধে ইগো এবং ঈর্ষা। সম্পত্তি, প্রতিপত্তি সব বিষয়ে এগিয়ে থাকায় বনিকে কোথাও যেন মেনে নিতে পারে না মধ্যবিত্ত ছাপোষা অরুণ। ফলস্বরুপ বিবাহ বিচ্ছেদ। একটা সই করে না হয় বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, কিন্তু এতদিনের বন্ধুত্ব? সেও কি মাত্র একটা সইয়ের ওপর নির্ভরশীল?
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
অন্যদিকে বারো বছরেরও বেশি সময় ধরে জয়ন্ত নিখোঁজ। প্রাণচঞ্চল নীলাও এখন সংসারের চাপে বীতশ্রদ্ধ। সদা হাস্যময় দত্ত ছোটখাটো সেলস এক্সেকিউটিভের চাকরি নিয়ে দিন যাপন করলেও তার চেষ্টাতেই এই পাঁচ বন্ধুর রিইউনিয়ন সম্ভব হয়। শেষপর্যন্ত একদিন বেঙ্গালুরু থেকে অফিসের কাজে কলকাতা এসে দত্তর সঙ্গে দেখা করে অরুণ। নেশার ঘোরে দুই বন্ধু আবার পাঁচ মাথা এক করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই ১৯৯৯-তে শেষবার বনিদের তাকদার বাংলোয় একসঙ্গে গ্রুপ ছবি তুলেছিল তারা। বিশ বছর পর সেই মুহূর্তটাই ফিরে পেতে চায় অরুণ।
ছবির গতি সুন্দর। তবে দৈর্ঘ্য একটু কম হলেও ক্ষতি ছিল না। কয়েকটি দৃশ্যে দর্শকের ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর কথা মনে পড়তে পারে।
আরও পড়ুন: রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের
অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই যথাযথ। তবে অর্পিতাকে কয়েকটি ফ্রেমে চরিত্র অনুযায়ী একটু বয়স্ক লেগেছে। বেশ কিছু কৌতুক দৃশ্যে রুদ্রনীলের অভিনয় অতিরঞ্জিত। ভালো লাগে তনুশ্রী এবং আবিরকে। ভালো লাগে মূল চরিত্রগুলির কৈশোরবেলার ভূমিকায় শিল্পীদের। অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই সাবলীল।
ছবিতে ক্যামেরার কাজ সুন্দর। পরিচালক হিসেবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শ্রীমন্ত। তবে চলন্ত প্লেনের মাঝপথে মোবাইল বেজে ওঠা এবং ফোনে কথা বলা একটু চোখে লাগল। ছবির সঙ্গীত শ্রুতিমধুর। রণজয় ভট্টাচার্য তাঁর স্বকীয় স্টাইল বজায় রেখেছেন। তবে সব গানকে ছাপিয়ে গেছে রূপম ইসলামের কণ্ঠে ‘আলোর শহর’।
হালকা শীতের সন্ধ্যায় একবার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাই যায় ‘আবার বছর কুড়ি পরে’। আর কিছু না হোক, নিখাদ এক টুকরো ছোটবেলা ফিরিয়ে দেবে এই ছবি। ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কোনও বন্ধুর সঙ্গে ফের যোগাযোগ হলে, এ ছবি তার সঙ্গে দেখারও।