অভিনয়ে ফিরে নিজের ছেলের গ্র্যানির চরিত্রে জয়া
RBN Web Desk: দুপুরের প্রচণ্ড রোদে বড় গেটটা পেরিয়ে আলিপুর রোডের বিশাল বাড়িটায় ঢুকলে চারপাশে গাছের ছায়া দেখে চোখ জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। লম্বা রাস্তা ধরে শুনশান ফাঁকা বাড়িটার দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বোঝা গেল, বাইরে এই ভরদুপুরে একটাও লোক না থাকলেও বাগানঘেরা এই শান্তির নীড়ে তখন চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন জর্জি। যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। জর্জি ফার্নান্ডেজ়, ৬৪ বছর বয়সে এসে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। যে বাড়িতে ৩৫ বছর ধরে সংসার করেছেন, আজ একেবারে একা সেখানে তিনি কী করে থাকবেন? অগত্যা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জর্জি। সঙ্গে ছেলে সাইমন, তার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া ও নাতি শন। ছেলে-বৌমার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে, শেষ বাঁকে একবার ফিরে তাকালেন জর্জি। এত বছরের চেনাজানা বাড়িটা ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তে তার দু’চোখে কিছুটা যন্ত্রণা আর বিচ্ছেদব্যথা ফুটে উঠল। তবে তা মুহূর্তের জন্য। ‘কাট’ বললেন পরিচালক। একবারেই শট ওকে হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন শিল্পীরা।
শহরের অভিজাত পাড়ায় পরিচালক ইন্দিরা ধর মুখোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘দ্য গ্রিন উইন্ডো’র শুটিং চলছিল। ছবিতে অভিনয় করেছেন জয়া শীল ঘোষ, কিঞ্জল নন্দ, অপরাজিতা মজুমদার ও আরভ ঘোষ। ছবিতে সুরারোপ করেছেন বিক্রম ঘোষ। আরভ বিক্রম ও জয়ার ছোট ছেলে। একটি ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করবেন সাহেব চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিতে প্রথমবার ক্যামেরার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন পরিচালক অর্ণব রিঙ্গো বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: কলকাতার বুকে ক্যাফে থিয়েটারের অভিনব প্রয়াস
‘দ্য গ্রিন উইন্ডো’র কাহিনী কী নিয়ে?
কলকাতার এই বাড়িতে ৩৫ বছর ধরে সংসার করেছেন জর্জি। তার সঙ্গে এ বাড়িতেই থাকে ছেলে বৌমা ও নাতি। ছেলে হঠাৎই বিদেশে বদলি হয়ে যায়। সে চলে যাবে তার পরিবার নিয়ে। কিন্তু চিকিৎসা বিমার জটিলতা ও ভিসার সমস্যায় জর্জির বিদেশে যাওয়া আটকে যায়। আচমকাই যেন সব অবলম্বন হারিয়ে একা হয়ে যায় জর্জি। এ বাড়িতে একা কী করে থাকবেন তিনি? ছেলের উন্নতিতে জর্জি খুশি, তাই বাস্তবকে মেনে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে বৃদ্ধাশ্রম মানেই কি শেষের ঠিকানা? নাকি সেখানেও শুরু হতে পারে নতুন জীবন?
পরের দৃশ্যে দেখা গেল ছাদের গাছে জল দিচ্ছিলেন জর্জি। খেলতে-খেলতে সেখানে চলে আসে শন। ঠাকুমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে নেয়। শনকে কাছে ডেকে জর্জি বোঝান যে ফুল ও ফলের মতোই পাতাও গাছের অংশ। পাতা ছিঁড়লে গাছের ব্যথা লাগে। দুবারের চেষ্টায় দৃশ্যটি টেক করলেন রিঙ্গো।
তিন বছর পর অভিনয়ে ফিরলেন জয়া। মাঝে সংসার ও ছেলেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অভিনয় জগৎ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। এতদিন পর কাজে ফিরে এমন একটি চরিত্র বেছে নিলেন যেখানে তিনি নিজের ছেলের গ্র্যানি। কেমন লাগছে ব্যাপারটা? উত্তরে জয়া রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন, “এই চরিত্রটা খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। গল্পটাও খুব অন্যরকম। ইন্দিরা নতুন কাজ করছে, ওকে আমি চিনতাম। তাই বিশ্বাস আছে ও কাজটা ভালো করে করবে। আর ঠাকুমা করলাম নাকি মা সেটা এই সময়ে এসে খুব একটা বড় ব্যাপার না বলেই আমার মনে হয়। চরিত্র যদি ভালো হয় আমি যে কোনও বয়সের অভিনয় করতে রাজি। একটা বড় সময় আমি কাজের মধ্যে ছিলাম না ব্যক্তিগত কারণেই, তবে এই সময়েও আমি নাচটা চালিয়ে গেছি। তবে যখন আবার কাজে ফিরতে চাইছি তখন আর সেভাবে প্রস্তাব পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ইন্দিরা এমন একটা চরিত্র নিয়ে আমার কাছে এল যেটা শুনেই আমার খুব ভালো লেগেছিল।”
আরও পড়ুন: শেষ যাত্রায় ব্রাত্য, পথ হেঁটেছিলেন মাত্র কয়েকজন
নিজেকে একজন ৬৪ বছরের মহিলার চরিত্রে কীভাবে দেখছেন তিনি? “প্রথমে ভেবেছিলাম পারব না,” বললেন জয়া। “তারপর ভেবে দেখলাম আমি তো অভিনয় করি না, আমি কাজ করার সময় নিজেই চরিত্র হয়ে যাই, তাহলে পারব না কেন? জর্জি একেবারে বাস্তবের চরিত্র। তাঁর কথা বলার ধরণ, হাঁটাচলা, নানা অভ্যাস এসব আমি জেনেছি। সেইভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছি।। জর্জির নানা দিকগুলো জানাই আমার কাছে হোমওয়ার্ক ছিল। জর্জি সম্পর্কে যত জেনেছি ততই আমার চরিত্রটাকে ভালো লেগেছে। আর যেহেতু আমার কোনওদিন নায়িকার ইমেজ ছিল না তাই যে কোনও চরিত্রেই মানিয়ে নিতে আমার কোনও অসুবিধা হয় না।”
তাঁর প্রথম ছবি নিয়ে ইন্দিরা জানালেন, “বৃদ্ধাশ্রম বা বয়স্ক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেশ কিছু ছবি হয়েছে ঠিকই, তবে আমার এই ছবিটা ২১-২২ বছরের রিসার্চের ফসল। জর্জি কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়। জর্জিকে আমি নিজে দেখেছি সেন্ট ক্যাথরিনস হোম, সেন্ট পলস বোর্ডিং স্কুলে, যেখানে আমার নিজের ছোটবেলা জড়িয়ে রয়েছে। আমার মনে হয়েছিল জর্জির গল্পটা বলা দরকার। হয়ত অনেক বয়স্ক মানুষ নতুন করে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পাবেন। আসলে এটা তো বাস্তবই। সত্যিই কোনও ছেলে যখন বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যায়, বেশিরভাগ সময় সে তার নিজের পরিবার অর্থাৎ স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে যাওয়ার কথাই ভাবে। বয়স্ক মানুষদের স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে নানা জটিলতার কারণে তাঁদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে এখানে থাকা বাবা কিংবা মায়েরা একা হয়ে পড়েন।”
তবে বৃদ্ধাশ্রম মানেই কোনও চেনা, ক্লিশে দুঃখের কাহিনী নয়। বরং ‘দ্য গ্রিন উইন্ডো’ বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে জর্জিকে নতুন করে বেঁচে থাকতে শেখাবে বলে জানালেন ইন্দিরা। জর্জি নিজে একজন হিন্দিভাষী খ্রিস্টান ছিলেন। তাই ছবিটিও হিন্দিতে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইন্দিরা।
পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ শেষে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে ঘুরে তারপর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে ‘দ্য গ্রিন উইন্ডো’।
ছবি: প্রতিবেদক