অভিনয়ই বাঁচিয়ে দিল

ছবি: এই আমি রেণু

পরিচালনা: সৌমেন সুর

অভিনয়ে: সোহিনী সরকার, গৌরব চক্রবর্তী, সোহম চক্রবর্তী, অলিভিয়া সরকার, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

দৈর্ঘ্য: ১১৬ মিনিট

RBN রেটিং: ৩/৫

‘নস্ট্যালজিয়া’ শব্দটা বাঙালির এতই প্রিয় যে কবে যেন অজান্তেই সেটা বাংলা শব্দভাণ্ডারে নিঃশব্দে জায়গা করে নিয়েছে। সত্তর বা আশির দশকে যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাঁদের মধ্যে আবার এই নস্ট্যালজিয়ার প্রকোপ অতিমাত্রায়। এর মাঝে বছর চল্লিশ সময়ে এত দ্রুতগতিতে চারপাশের সবকিছু পাল্টে গেছে যে সুযোগ পেলেই সবাই সেই অ-ডিজিট্যাল সময়টায় ঘুরে আসতে চায়, মনে মনেই। সেরকমই এক মোক্ষম নস্ট্যালজিয়ার হাতছানি ছিল সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস ‘এই আমি রেণু’র চিত্ররূপ। তবে উপন্যাসের আদলে গল্পে নব্বইয়ের দশককে তুলে ধরতে চাইলেও সর্বত্র সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। 




ছবির গল্প খুব সিনেম্যাটিক নয়, উপন্যাসটা যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানবেন। রেণু (সোহিনী) ও সুমিতের (গৌরব) আলাপ হয় ইউনিভার্সিটিতে। বলা যায় ঝুমা (অলিভিয়া) ও অশোকের (অনিন্দ্য) সাহায্য নিয়ে রেণুই সুমিতের সঙ্গে যেচে আলাপ করে। শান্তশিষ্ট, মুখচোরা সুমিত রেণুকে মনে-মনে ভালোবাসলেও তা বলার ক্ষমতা তার কোনদিন ছিল না। অশোক ও ঝুমার মধ্যস্থতায় দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আচমকাই রেণুর পরিবার থেকে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লাগে। সুমিতের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেও শেষে রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা রেণু নিজেই পিছিয়ে যায়। কোল ইন্ডিয়ার বড় চাকুরে বরেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। এই সমস্ত কিছু ঘটে ফ্ল্যাশব্যাকে, বলা যায় এর পরেই ছবির আসল ঘটনা শুরু। 

আরও পড়ুন: জটায়ুর সাহস

অন্যান্য বিষয়ে যাওয়ার আগে ছবির কাস্টিং নিয়ে বলা দরকার। পিরিয়ড ছবির ক্ষেত্রে তার সাজপোশাকের সঙ্গে অভিনেতাদের শরীরীভাষাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেন না আজকের ডিজিট্যাল যুগের কথাবার্তা বা হাবভাব সে যুগের সঙ্গে মেলে না। এ ক্ষেত্রে খুব সচেতনভাবেই চরিত্র অনুযায়ী মানিয়ে গেছেন সোহিনী ও গৌরব। দুজনেই তাঁদের শরীরীভাষায় হুবহু নব্বইয়ের দশকের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন। কোথাও তাঁদের দেখে মনে হয় না তাঁরা বাস্তবে সেই সময়ের নন। একই কথা সোহমের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চালচলন ও কথাবার্তায় একেবারে সন্দেহাতীতভাবে বরেন হয়ে উঠেছেন তিনি। তবে তাঁর পোশাক পরিকল্পনায় আর একটু আধুনিকতা দেখানো যেত। যে ধরণের পাঞ্জাবিতে তাঁকে গোটা ছবি জুড়ে দেখা গেছে, সেটা সত্তরের দশকে মানানসই ছিল।

আরও একজনের কথা উল্লেখ করা জরুরি। তিনি বিবিসি বা ব্রজবিলাস চন্দরূপে কৌশিক। তাঁর অনায়াসে চরিত্র হয়ে ওঠার ক্ষমতা প্রতিবারেই অবাক করে। এমন শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতা বর্তমান বাংলা ছবিতে খুব সামান্যই আছেন। 

আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র

এবার আসা যাক কিছু খামতির কথায়, যা সতর্ক দর্শকের চোখ এড়াবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম বা সেই সময়ের নিরিখে ছাত্রছাত্রীদের শরীরীভাষা বেমানান না হলেও, পোশাক সম্পর্কে আরও একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। নব্বইয়ের দশক এতটাও পুরোনো নয় যে ছাত্ররা ঢোলা প্যান্ট শার্ট বা পাঞ্জাবি আর সব ছাত্রী সালোয়ার কামিজ় পরবে। ইন্ডিয়ান কফিহাউসের ওপরের প্রবেশপথ পরিচালক না দেখালেই পারতেন। অতি সম্প্রতি কফিহাউসের সিঁড়ির দেওয়াল জুড়ে যে কাঠের ম্যুরাল হয়েছে তা দেখে চমকে উঠতে হয়। নব্বইয়ের দশকে যে এসব ছিল না তা যে কোনও কফিহাউসপ্রেমীই জানবেন। ডায়মন্ড হারবারে খোলা গঙ্গার ধার হয়ত বর্তমান সময়ে খুবই অপ্রতুল। সেক্ষেত্রে অন্য কোনও গঙ্গার ধার বেছে নেওয়া যেতে পারত। যে রিসর্টে ছবি শুট করা হলো, তা আধুনিক বাঙালিদের অধিকাংশেরই খুব চেনা। বলা বাহুল্য, তা বিগত তিন দশক আগেও ছিল না। তবে গঙ্গার ওপর নৌকায় তোলা দৃশ্য দেখতে সত্যিই ভালো লাগে। একইভাবে দিঘার দৃশ্যগুলি যদি সত্যিই সমুদ্রের ধরে তোলা হতো, তিন পাত্রপাত্রীর আবেগের মুহূর্ত অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠত। দৃশ্যটি স্পষ্টতই ক্রোমা পদ্ধতিতে তোলা, যা ছবির ওই মুহূর্তে খুব চোখে লাগে। 




উপন্যাস হিসেবে ‘এই আমি রেণু’ পড়তে গিয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যায় ঠিকই, তবে তাকে ছবির পর্দায় আনতে গেলে কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, যা করা হয়নি। ফলে ছবিটি দেখতে বসে সেই টান অনুভব করা যায় না। কোথাও গিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে না, এরপর কী হবে? রেণুর অতীত কোথাও স্পষ্ট করে বলা হয়নি, যা ছবির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। এই একটি তথ্য জানার জন্য দর্শক অপেক্ষা করে, কিন্তু শেষ অবধি তা কোথাও পরিষ্কার হয় না। অপরিণতমনস্কতাই যদি রেণুর জীবনের জটিলতার একমাত্র কারণ হয়ে থাকে, তবে সে তা কোথাও স্বীকার করে না কেন? তার চিঠিও পুরোটা পড়ে শোনানো হয় না কোথাও। যখন সে আত্মসমর্পণ করে তখনও তার কারণ স্পষ্ট হয় না। শুরু থেকে শেষ রেণু চরিত্রটি এক অদ্ভুত প্রহেলিকা হয়ে থেকে যায়। অথচ কাহিনীর মূল চরিত্র সে, তাকে জানা অসম্পূর্ণ থেকে গেলে গল্পের সার্থকতা থাকে না। গল্পের সময়কাল ও প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দিতে গিয়ে সম্ভবত গল্পের গভীরতার প্রতি কিছুটা অবহেলা করেছেন পরিচালক।

আরও পড়ুন: গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তবুও ঔজ্জ্বল্যে অম্লান

তবে অভিনেতারা প্রত্যেকে যে যাঁর জায়গায় যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন। বলতে গেলে, এই ছবিকে অভিনয়ই বাঁচিয়ে দিল। সোহিনী, গৌরব, সোহম ছাড়াও অনিন্দ্য ও অলিভিয়াকেও নব্বইয়ের কলেজ পড়ুয়া হিসেবে সুন্দর মানিয়েছে। গৌরব এবং সোহিনীর অভিনয়ের আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে যায়। তবে একটা কাল্ট উপন্যাসের দৃশ্যায়ন করতে গিয়ে আর একটু সতর্ক হতে পারতেন পরিচালক। রানা মজুমদারের সুরে ছবির গানগুলি শুনতে ভালো লাগে। 



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *