মনে রেখে দেওয়ার মতো ছবি

ছবি: কুরবান 

পরিচালনা: শৈবাল মুখোপাধ্যায়

অভিনয়ে: অঙ্কুশ হাজরা, প্রিয়াঙ্কা সরকার, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মৌ ভট্টাচার্য, কাঞ্চন মল্লিক, শৌভিক মজুমদার

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট

RBN রেটিং: ★★★★★★★☆☆☆

জীবন যখন সহজ স্বাভাবিক হয় তার ভার বোঝা যায় না। মনে হয় পালকের মতো হালকা, স্বপ্নের মতো সুন্দর, স্রোতের অনুকূলে পাল তুলে তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। কিন্তু তেমনটা সবসময় হয় না। চলার পথে হাজারো বাধা এসে জীবনের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। বাধ্য করে স্রোতের উল্টোদিকে সরে যেতে। বেঁচে থাকার কঠিনতম শর্ত দিয়ে জটিল থেকে জটিলতর করে তোলে দৈনন্দিন অভ্যাসের রোজনামচাকে।



এ গল্প যেমন হাসানের (অঙ্কুশ), তেমনই হিজল (প্রিয়াঙ্কা) কিংবা মাসিরও (মৌ)। কারণ এরা প্রত্যেকে নিজেদের অস্তিত্বে কোনও না কোনও গভীর ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়ায়। সংসারে বাঁচতে গেলে চাহিদা থাকবেই, সে চাহিদা বহু মানুষের নিতান্তই সাধারণও। তবু সেটুকু চাহিদাও যদি সমাজ, পারিপার্শ্বিক কিংবা আপনজন গলা টিপে মেরে ফেলে তাহলে জীবন বড় রুক্ষ শুষ্ক হয়ে যায়। হাসান খুঁজে বেড়ায় তার পরলোকগত বাবা-মাকে, হিজল খোঁজে প্রিয় মানুষটার ভালোবাসা, মাসি খোঁজে তার হারিয়ে যাওয়া সইকে, ফেলে আসা অতীতকে। 

হিন্দু-মুসলিম সমস্যা যতটা না আমাদের শহুরে জীবনকে প্রভাবিত করে তার চেয়ে অনেক বেশি দাগ রেখে যায় গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে। পাশের বাড়ির আজীবন চেনা মানুষও জাতপাত ভেদাভেদ, বা সামান্য কারণে ঘটে যাওয়া বিবাদ ভুলতে পারে না। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রীতিনীতি মানতে বাধ্য হয় প্রতিটি মানুষ। যে মানবে না তাকে কোণঠাসা করতে সকলে একজোট হয়ে যায়। জিহাদের কাহিনি নিয়ে আগেও অনেক ছবি হয়েছে। তবু ‘কুরবান’ এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জিহাদকে তুলে ধরে। যেখানে ধর্মবিশ্বাস নয় বরং কর্তব্যবোধ এবং অসহায়তা মানুষকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দেয়। 

আরও পড়ুন: থাকবেন সোনাক্ষী সিংহও

ছবির প্রথম স্বপ্নদৃশ্য মনে রাখার মতো। রূপাঞ্জন পালের চিত্রগ্রহণ চোখকে আরাম দেয়। কিছু অসাধারণ ফ্রেম তৈরি করেছেন তিনি নদী, পাখি এবং গ্রাম বাংলার ল্যান্ডস্কেপকে ব্যবহার করে। ছবির কাহিনি এতটাই নিচু তারে বাঁধা যে সব দর্শকের হয়ত ভালো লাগবে না। তবু গল্পের গভীরতা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। মূল চরিত্রে বাণিজ্যিক ছবির দুই অন্যতম সফল মুখকে ব্যবহার করা এ ছবির সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেদিক থেকে দুজনেই অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। পরিচালকের মুন্সিয়ানা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে গল্পের গতি আর একটু বাড়ানো গেলে ছবিটি অকারণ দীর্ঘায়িত হতো না। 

বরাবর বাণিজ্যিক ছবির নায়ক হয়েও হাসান চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন অঙ্কুশ। ‘শিকারপুর’ সিরিজ়ের পর থেকে তাঁর কাজের প্রতি দর্শকের প্রত্যাশা বেড়েছে। একেবারে অন্যধারার ছবিতে কাজ করে প্রমাণ করলেন তিনি, সুযোগ পেলে দেখিয়ে দিতে জানেন। এত কম সংলাপ বলে একটা চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলা সহজ নয়।

আরও পড়ুন: ‘সেনা উর্দি পরতে পারাই সবথেকে বড় পুরস্কার’

প্রিয়াঙ্কা অসম্ভব সাবলীল। হিজলের কষ্ট, অপমান, ভালোবাসাকে অনায়াস দক্ষতায় ফুটিয়েছেন তিনি। তেমনই সুন্দর লাগে তাঁর মুখে গ্রাম্য ভাষার প্রয়োগ। কোথাও এতটুকু জড়তা না রেখে গাঁয়ের মেয়ে হয়ে উঠেছেন তিনি। চরিত্র থেকে আলাদা করে ভাবা যাবে না প্রিয়াঙ্কাকে। বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁকে ভেবে বিশেষ চরিত্র লেখার দরকার আছে। 

বাকি অভিনেতারা প্রত্যেকে যে যার জায়গায় যথাযথ। মন ছুঁয়ে যায় মৌয়ের আবেগী অভিনয়। বরাবরের মতই তুখোড় শান্তিলাল, অসাধারণ বুদ্ধদেব। শৌভিকের চেহারায় অভিনীত চরিত্রটি মানিয়ে গেলেও উচ্চারণের ক্ষেত্রে আর একটু সজাগ থাকা প্রয়োজন ছিল। বড় কম সুযোগ পেয়েছেন কাঞ্চন। গুণী অভিনেতারা সামান্য সুযোগেই নিজেদের স্মরণীয় করে রাখেন। কাঞ্চনও তাই করলেন স্বল্প পরিসরে। 



রাজা নারায়ণ দেবের সুরে ছবির গানগুলি বেশ মিষ্টি। বিশেষ করে শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে ‘এক আঁজলা জ্যোৎস্না তোমার’ এক মায়াময় প্রেক্ষাপট রচনা করে। গানটি ছবি দেখে বেরিয়েও মনে থেকে যাবে। জাভেদ আলির কণ্ঠে ‘দূর দূর’ গানটি শ্রুতিমধুর, তবে উচ্চারণের দিকে আর একটু মনোযোগ দেওয়া যেতেই পারত। 

অন্যধারার গল্প নিয়ে একেবারে ভিন্ন স্বাদের ছবি হওয়ার কারণেই ‘কুরবান’ কতটা দর্শক আনুকূল্য পাবে সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে মনে রেখে দেওয়ার মতো একটি কাজ হয়ে রইল অঙ্কুশ-প্রিয়াঙ্কা জুটির প্রথম ছবিটি। 




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
1

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *