হিংসা ও দ্বেষের বিবমিষা
ছবি: অথৈ
পরিচালনা: অর্ণ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়ে: সোহিনী সরকার, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অর্পণ ঘোষাল, দিতিপ্রিয়া রায়, মিমি দত্ত, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্ণ
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটক একাধিকবার বিনির্মাণ হয়ে ফিরে-ফিরে এসেছে। বাংলা চলচ্চিত্র বা নাট্যজগতে উঁকি দিলেও তার ছাপ পাওয়া যায়। ‘ওথেলো দ্য মুর’ (Othello) নাটককে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এনে আগেই মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘অথৈ’ (Athhoi)। সেই একই নাটকের প্রধান শিল্পীদের নিয়েই এবার বড়পর্দায় এল একই নামের ছবি।
অর্ণর ছবিতে ভেনিস শহর হয়ে উঠেছে ভিনসুরা, ওথেলো হয়েছে অথৈ কুমার লোধা (অর্ণ), ডেসডিমনা হয়ে গিয়েছে দিয়ামনা (সোহনী), ইয়াগো এখানে ডঃ অনর্ঘ চ্যাটার্জি ওরফে গোগো (অনির্বাণ) এবং ক্যাসিও হয়েছে মুকুল (অর্পণ)। এছাড়াও এমিলিকে মিলি (মিমি), রডরিগোকে রাদু, বিয়াঙ্কাকে পিঙ্কি (দিতিপ্রিয়া) হিসেবে দেখবেন দর্শক।
‘অথৈ’-এর কাহিনি শুরু হয় গোগোকে দিয়ে। সে শহরে গিয়ে ডাক্তার হয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার পর আবার নিজের গ্রামে ফিরে এসেছে। তার মাথায় ঘুরছে এক নতুন খেলা। ছোটবেলা থেকেই গোগোর বাড়িতে আশ্রিত অথৈ ডাক্তার হলেও সে ডিগ্রি পেয়ে ভিনসুরাতেই ফিরে এসেছিল। দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও অথৈ বাবার সমর্থন এবং সাহায্যে ভিনসুরাকে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দিক থেকে উন্নত করে তুলতে বদ্ধপরিকর। ছোটবেলা থেকেই গোগো ও অথৈ বন্ধু হলেও গোগোর মনে চাপা হিংসা রয়েই গিয়েছে। কোনওকালেই সে মানুষ হিসেবে অথৈকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
আরও পড়ুন: হেমা মালিনীর চিকিৎসা করবেন ধর্মেন্দ্র, ছবি মানিকদার
এতবছর পর গ্রামে ফিরে স্বাগতবার্তার পাশাপাশি সকলের মুখেই গোগো শোনে অথৈয়ের নাম। তার মনে প্রশ্ন আসতে থাকে, সাফল্য থেকে শুরু করে ভালোবাসা, সবেতেই কি জিতে যাবে অথৈ? শুরু হয় গোগোর ষড়যন্ত্র রচনা। ইতিমধ্যে অথৈ বিয়ে করেছে শহর থেকে পালিয়ে তার কাছে চলে আসা প্রাণের মানুষ দিয়ামনাকে। গোগো জানে, দিয়ামনা অথৈয়ের অন্যতম দুর্বলতা। সেই দুর্বলতায় আঘাত করেই সে অথৈয়ের মনের পশুকে জাগাতে চায়। তার গুপ্ত ষড়যন্ত্রে নিছক বোড়ে হয়েই রয়ে যায় অথৈয়ের সহযোগী মুকুল, তার প্রেমিকা পিঙ্কি, বহুদিন ধরে গোগোকে ভালোবাসা মিলি এবং গোগোর অনুগত রাদু। গোগো কি সফল হবে এই ষড়যন্ত্রে?
ঘৃণা, স্বার্থ, হিংসা। এ ছবির এই তিন মূল উপজীব্য। বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে দিয়ে একাধিক স্তরে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন অর্ণ। টানটান চিত্রনাট্যে দর্শকের পলক ফেলার সময় থাকে না। প্রতিটি দৃশ্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিটি অংশের গতিও যথাযথ হয়ে রয়ে যায়। অথৈ মানুষকে ভালোবাসতে চায় কিন্তু তা যে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র এক অলীক কল্পনা, সে কথা বারংবার গোগো তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু শুধু অথৈই দেখে কি ? না, দেখে দর্শকও। গোগোর দর্শন, তার কাটা-কাটা সংলাপ দর্শকের মনকে ক্ষতবিক্ষত করে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। দেখায় মানুষের নগ্ন, কদর্ষ রূপ। এ ছবি যেন বারবার মানুষকে তার ভুল পথ দেখিয়ে দেয় তীব্র ইঙ্গিতে। পালেস্তাইনের ওপর তেল আবিবের হামলা থেকে শুরু করে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, সবকিছুই দর্শকের সামনে আসে কখনও সরাসরি, কখনও রূপক হিসেবে।
আরও পড়ুন: হরর-কমেডিতে সঞ্জয় দত্ত
‘অথৈ’ নিয়ে বলতে গেলে নাটকের প্রসঙ্গ আসা অবশ্যম্ভাবী। মঞ্চের স্বল্প পরিসরে নাটকের চরিত্রবিন্যাসে যতটা খুঁতখুঁতানি রয়ে গিয়েছিল, ক্যামেরার কাজ দিয়ে তা সুদে-আসলে উসুল করেছেন অর্ণ। ‘অথৈ’ শুধুমাত্র কোনও চরিত্র বা কাহিনি নয়, তা ঘটনার সমষ্টিও বটে। বিভিন্ন দৃশ্যে বহু রূপক ব্যবহার করে অর্ণ বারবার দর্শককে বিদ্ধ করলেন। মঞ্চসুলভ নাটকীয়তাও এ ছবিতে ভরপুর কিন্তু কখনওই তা অতিনাটকীয় লাগে না। বরং তার জন্য যেন এই ছবি নতুন প্রাণ পায়।
একজন অভিনেতাও এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়লেন না। অর্ণ তাঁর দ্বিধাবিভক্ত, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা নেতাসুলভ চরিত্র তৈরি করতে সফল। অপরদিকে অনির্বাণ তাঁর অভিনয়শিক্ষার সেরাটুকু ঢেলে দিয়েছেন। দুজনে একসঙ্গে পর্দায় এলে কাকে ছেড়ে কাকে দেখব, এ দ্বিধায় ভুগবেন দর্শক। এই ছবির নায়ক গোগো না অথৈ, তা নির্ধারণ করা মুশকিল। সোহিনী তাঁর ভূমিকায় ভীষণ সাবলীল। পার্শ্বচরিত্র হলেও অর্পণ এবং মিলি দক্ষ সঙ্গত দিয়েছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্রেও দিতিপ্রিয়ার অভিনয় ছাপ রেখে যায়।
সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ বিশেষ প্রশংসার দাবীদার। প্রতিটি দৃশ্যের জন্য কাল্পনিক গ্রাম ভিনসুরা যেন বাস্তব হয়ে ওঠে। ছবির গানগুলির জন্য অমিত চট্টোপাধ্যায় ও গীতিকার অনির্বাণ প্রশংসা পাবেন। গান এবং তার কথা যে অনেক সময় ছবির গতিকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তা অনির্বাণ-অমিত জুটি আবারও প্রমাণ করলেন। সঙ্গীতের সঙ্গে যথাযথ সঙ্গত দিয়েছে শুভদীপ গুহর আবহ। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা যথাযথ।
তবু কিছু খারাপলাগা থেকেই যায়। ছবির ক্লাইম্যাক্সে অনির্বাণের ‘মন্দার’-এর প্রভাব স্পষ্ট। এহেন মিলের কারণ কি সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে অনির্বাণের উপস্থিতি? এছাড়া মুখ্য চরিত্র ব্যতীত অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রেরা নিজেদের মেলে ধরার জন্য খুব বেশি জায়গা পাননি। অথৈ দলিত বলে বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার ব্যাপারটিও সংক্ষেপে সেরে দেওয়া হয়েছে। চলচ্চিত্রের পরিসরে সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানো হয়তো এর অন্যতম কারণ। ওয়েব সিরিজ় হলে পরিচালক এই দিকগুলিকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে বড় পরিসরে দেখাতেন বলেই অনুমান করা যায়।
সবমিলিয়ে ‘অথৈ’ সমসাময়িক অন্যান্য ছবির মধ্যে নিজের গুরুত্বটুকু চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে এই ছবি পুরোপুরি প্রেক্ষাগৃহের জন্য। মোবাইল ফোনে এ ছবির নাটকীয় দৃশ্যায়ন খুব বেশি উপভোগ করা সম্ভব হবে না।