কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনার কোলাজ
ছবি: হুব্বা
পরিচালনা: ব্রাত্য বসু
অভিনয়ে: মোশারফ করিম, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, লোকনাথ দে, পৌলোমী বসু, গম্ভীরা ভট্টাচার্য, অশোক মজুমদার, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆
ভারতবর্ষে এলাকাভিত্তিক গুণ্ডারাজ কোনও নতুন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় প্রতিটি রাজ্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে একাধিক ডন। পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এ রাজ্যে গুণ্ডারাজ চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের এলাকা অনেকটা বিস্তৃত করে ফেলেছিল। এদের মধ্যে এলাকা দখলের লড়াইও লেগে থাকত। রাজনৈতিক দলগুলো এদের যেমন উৎসাহ দিত, তেমনই প্রয়োজন পড়লে দমনও করত।
এইসব কুখ্যাত ডনের জীবনযাত্রা নিয়ে হিন্দিতে ছবি হলেও, বাংলায় হয়নি বললেই চলে। নির্দিষ্ট কোনও সমাজবিরোধীকে নিয়ে বাংলায় ‘হুব্বা’ (Hubba) সম্ভবত প্রথম ছবি। কোন্নগর-রিষড়া এলাকায় একসময়ের ত্রাস শ্যামল মণ্ডল, ওরফে হুব্বা শ্যামলকে নিয়ে ছবি করেছেন ব্রাত্য যদিও নামগুলি বদলে দেওয়া হয়েছে।
ছবি শুরু হয় ব্রাত্যর কণ্ঠে একটি পরিচয়কথন দিয়ে। তারপর জাম্পকাটে দেখা যায় হুব্বা বিমলের (মোশারফ) ডেরা। সেখানে বোকারো বাপি (লোকনাথ) ও বিমলের কথোপকথনের মাধ্যমে বোঝা যায় ডন হিসেবে হুব্বার ক্ষমতা ঠিক কতখানি। হুব্বা মোবাইল ফোন ব্যবহারে অত্যন্ত সাবধানী। সে জানে, পুলিশ তার সবক’টি ফোনে আড়ি পেতে রয়েছে। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে পুলিশ ‘হুগলির দাউদ’ হুব্বা বিমলকে ধরতে ব্যর্থ। মাঠে নেমেছেন বিশেষ সিআইডি অফিসার দিবাকর (ইন্দ্রনীল)। বেশ কিছুক্ষণ লুকোচুরির পর ধরা পড়ে হুব্বা। দিবাকর জেরায় মাধ্যমে বিমলের ছোটবেলা থেকে ‘হুব্বা’ হয়ে ওঠার কাহিনি জানতে পারে। তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় দিবাকরের ব্যক্তিগত জীবনও। সে যে আদতে সাদাকালোয় মেশা এক ধূসর চরিত্র, সেটাও বোঝা যায়। এরপর নিজের প্রভাব খাটিয়ে জামিনে মুক্তি পায় হুব্বা বিমল। এর কিছুদিন পরেই গুপ্ত-দলাদলিতে তার মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন: রণবীরকেই চান যুবরাজ
চুম্বকে এই হলো ‘হুব্বা’। ঠিক এমনই খাপছাড়াভাবে এগিয়েছে ছবির কাহিনি। ‘হুব্বা’ দেখতে বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে প্রশ্ন জাগে, এই ছবিটা বানানোর খুব দরকার ছিল কি? চিত্রনাট্য এতটাই আলগা যে বেশ কিছু দৃশ্যে বিরক্তির উদ্রেক ঘটে। সুপ্রতিম সরকারের ‘গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার’ বইয়ের একটি অধ্যায় থেকে এ ছবির মশলা নেওয়া হয়েছে। তবে শুধু মশলা সংগ্রহ করলই তো আর হলো না, তা রান্না করতেও জানতে হবে। অন্তত চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে একটি কাহিনিসূত্রে বাঁধতে হয়। সেটাই করে উঠতে পারেননি ব্রাত্য। করবেন কী করে? সুপ্রতিমের বই ছাড়া আর তেমন কোনও গবেষণাই করেননি তিনি। এমনকী হুব্বা বিমলের রহস্যময় পরিণতিকে নাটকীয় রূপ দিতে গিয়ে ব্যাপারটি হাস্যকর করে তুলেছেন তিনি।
থিয়েটারের বহু শিল্পী রয়েছেন এই ছবিতে। তাঁদের অনেকের অভিনয়েই থিয়েটারি ছাপ স্পষ্ট। সেই কবে সত্যজিৎ রায় উত্তমকুমারের মুখে সংলাপ বসিয়েছিলেন: ‘ক্যামেরার সামনে অতিঅভিনয় চলে না। একটু বাড়িয়েছ, দশগুণ বেড়ে যাবে।’ সেই অতিঅভিনয়ই চোখে পড়ল বারবার। তবে এক প্রায়-অশিক্ষিত, নির্মম ডনের ভূমিকায় মোশারফ এবং তার ডানহাত বোকারো বাপির চরিত্রে লোকনাথ দুর্দান্ত। তাঁরাই এ ছবির সেরা প্রাপ্তি। যুবক হুব্বার চরিত্র গম্ভীরা প্রশংসার দাবি রাখেন। তাঁর পর্দায় উপস্থিতি বেশ ভয়ের এবং এক একটি অপরাধের মাধ্যমে হুব্বার সমাজবিরোধী হয়ে ওঠার অভিনয়ে তিনি সফল। ইন্দ্রনীলের এই ছবিতে বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবু তিনি সীমিত পরিসরে চেষ্টা করেছেন।
ছবিতে গানের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আবহ। সে কাজে প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় সফল। শিলাজিতের কথায়, সুরে ও কণ্ঠে ‘দুষ্টু লোক’ গানটি শুনতে ভালো লাগে। তবে তা ছবির মুড কিছুটা লঘু করে দেয়।
আরও পড়ুন: সৌরভের বায়োপিকে নেই ঐশ্বর্যা
সৌমিক হালদারের চিত্রগ্রহণ যথাযথ, বিশেষ করে রাতের দৃশ্যগুলি। সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা ভালো। তবে ছবিটির দৈর্ঘ্য আরও ১৫ মিনিট কমানো যেত।
যে কোনও গ্যাংস্টারের জীবনযাত্রা নিয়ে ছবি করতে গেলে চিত্রনাট্যের বাঁধন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সেটা করতে না পারলে ছবিটিকে কিছু ঘটনার কোলাজ বলে মনে হয়। ব্রাত্য যখন কাল্পনিক নামই ব্যবহার করলেন, তখন চিত্রনাট্যে কোনও সাবপ্লট রাখলেন না কেন, বোঝা গেল না। তবু মোশারফ করিমের অভিনয়ের জন্য ‘হুব্বা’ দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়াই যায়।