স্পর্শের অপেক্ষায় থাকা বার্ধক্য
ছবি: বিজয়ার পরে
পরিচালনা: অভিজিৎ শ্রীদাস
অভিনয়ে: মমতা শঙ্কর, দীপঙ্কর দে, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, বিদিপ্তা চক্রবর্তী, খেয়া চট্টোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, মীর আফসর আলী, তানিকা বসু, মিশকা হালিম
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★☆☆☆
একে অপরের হাতে হাত রেখে যেদিন দুজন মানুষ সংসার জীবন শুরু করে, সেদিন চোখে আঁকা থাকে অজস্র স্বপ্ন, পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় এক নতুন চার দেওয়ালের জগতের। তারপর জীবনের পথে পদক্ষেপ বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই পৃথিবীর সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। নতুন ক্রমশ পুরনো হয়, অঙ্কুরিত বীজেরা প্রস্ফুটিত হয়ে নাম লেখায় নতুনের দলে। তারপর একদিন এই নিটোল আনন্দের নিজস্ব গণ্ডিটুকু ছেড়ে তারা পাড়ি দেয় অন্য কোনও জগৎ গড়ার পথে। আগের ঘরবাড়ি পড়ে থাকে শূন্য। চিরাচরিত এই সত্য, তবু জীবন দিয়ে জানতে হয় সকলকেই।
মফস্বলের বাড়িতে থাকেন বয়স্ক দম্পতি অলকানন্দা (মমতা শঙ্কর) ও আনন্দ (দীপঙ্কর)। ছেলেমেয়েরা সকলেই বাইরে। দুই ছেলে কাছে থাকলেও একমাত্র মেয়ে মৃণ্ময়ী (স্বস্তিকা) থাকে মুম্বইতে। প্রবাসী নাতি (ঋতব্রত) ও অভিনেত্রী নাতনি (খেয়া) দুজনেই দাদু-ঠাকুমার খুব প্রিয়। কিন্তু কাছে নেই কেউই। প্রবীণ দম্পতির একাকীত্ব কাটে তাদের অপেক্ষায়।
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটাবার সাধ বোধহয় সব বাবা-মায়েদেরই থাকে। তবু পরিস্থিতি ও প্রয়োজন বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই ইচ্ছে যতই থাকুক, বয়স্ক বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে যাওয়া হয় না এ যুগে বেশিরভাগ সন্তানেরই। সেক্ষেত্রে তাদের স্বার্থপর হিসেবে দেখানো বাধ্যতামূলক নয়। সময় এবং বয়সের দাবি মানুষকে নিজের মতো করে বাঁচতে বাধ্য করে। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে পুজোর পাঁচদিন কেটে গেলেও দশমীর আগে কেউ এসে পৌঁছতে পারে না, এটা কিছুটা চোখে লাগে অবশ্যই। এ ছবিতে একা থাকা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অসহায়তা ভীষণভাবে বাস্তব। তাদের প্রতি মুহূর্তের অপারগতা, দুশ্চিন্তা, একাকীত্ব দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়। ছবির প্রথমার্ধ মনের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করে। কারণ প্রত্যেকের জীবনেই এমন একটা সময় আসবে। যদিও চিত্রনাট্যের বাঁধুনি আরও আঁটোসাঁটো হতে পারত। বেশ কিছু চরিত্রের প্রেক্ষাপট আর একটু পরিষ্কার হলে তাদের আচরণের কারণ জানা যেত।
আরও পড়ুন: ডেভিড হেয়ারের জীবনী প্রকাশ
অভিনয়ের জোরেই ছবিকে অনেকটা টেনে নিয়ে গেছেন নায়ক-নায়িকা দীপঙ্কর ও মমতা শঙ্কর। বয়সের ভারে ন্যুব্জ স্নেহময় পিতার ভূমিকায় দীপঙ্কর অনবদ্য। এরকম চরিত্র বাংলা ছবিতে নতুন না হলেও দীপঙ্করকে এমন ভূমিকায় সেভাবে পাওয়া যায়নি এর আগে। তরুণ বয়সের সপ্রতিভ চেহারার নায়ককে এত বছর পরে বঙ্গজীবনের চেনা চেহারায় দেখে ভালো লাগতে বাধ্য।
অপরদিকে মমতা শঙ্কর এ ছবির প্রাণ। সমস্ত সংসারকে নিজের সহজাত ভালোবাসায় ও পরম যত্নে বেঁধে রাখেন মাতৃরূপা গৃহিণী। এতবছর ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা ক্ষোভ লালন করেও ছেলেমেয়ের আসার অপেক্ষায় যথাসাধ্য করে যাওয়া, মায়েরা তো এমনই হন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আনন্দের অভিনয় করে অবশেষে আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চিপে নিজেকে সামলে নেওয়ার মুহূর্তগুলোয় মমতা শঙ্কর আবারও প্রমাণ করলেন জাত অভিনেত্রী তিনি। সুযোগ পেলে আজও সমস্ত ফোকাস তিনি একাই টেনে নিতে পারেন।
ছবির দ্বিতীয়ার্ধে চরিত্র হিসেবে প্রবেশ করেও স্বস্তিকা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। মৃণ্ময়ী চরিত্রে অসম্ভব আবেগপ্রবণ তিনি। ভালো লেগেছে তাঁকে চালচিত্রে রেখে সিঁদুরখেলা ও সাত পাকে ঘোরার কল্পদৃশ্যও। অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতারা প্রত্যেকেই যথাযথ। আলাদা করে নজর কাড়েন ঋতব্রত ও খেয়া। ছোট চরিত্রে তানিকা বেশ ভালো।
আরও পড়ুন: অন্তত পাঁচ বছর থিয়েটার করার পরামর্শ মনোজের
চিত্রনাট্যে আরও কিছু স্মৃতিচারণ ও ঘটনা জুড়তে পারলে কাহিনির আবেদন বাড়তে পারত। পুজোর আবহ থাকা সত্বেও ছবির শুরু থেকেই যেন এক বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে। চিত্রগ্রহণ ও কালারটোন সেটাই আগাগোড়া ধরে রাখে, যা দেখতে ভালো লাগে। সঙ্গীত এ ছবির অন্যতম শক্তিশালী একটি দিক। রণজয় ভট্টাচার্যের সুরে ছবির সবক’টি গানই শুনতে ভালো লাগে। শাওনি মজুমদারের কণ্ঠে ‘ও সখি কার আঁখি’ গানে ভারী সুন্দরভাবে রাবীন্দ্রিক ধারা ব্যবহার করা হয়েছে। তমোঘ্ন চট্টোপাধ্যায়ের কথায় গানটি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর। শাওনির কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘কেহ কারোর মন বুঝে না’ গানটিও অনবদ্য লেগেছে।
বাড়ির বয়স্ক সদস্যেরা ছোটদের মুখ চেয়ে থাকেন, যদি তারা একটু সময় দেয় কিংবা দুটো কথা বলে। তবু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজের কথা ছাড়া অন্য কিছু বলা হয়ে ওঠে না তাদের সঙ্গে। ‘বিজয়ার পরে’ সেটুকুই শিখিয়ে দিয়ে যায়। স্পর্শের অপেক্ষায় থাকে বার্ধক্য। হাতে সময় বড় কম, যেন দেরি না হয়ে যায়।