মিশল ম্যাজিক ও লজিক
ছবি: শ্রীস্বপনকুমারের বাদামী হায়নার কবলে
পরিচালনা: দেবালয় ভট্টাচার্য
অভিনয়ে: আবীর চট্টোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রুতি দাস, প্রতীক দত্ত, গৌতম হালদার, লোকনাথ দে, শাঁওলী চট্টোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিট
RBN রেটিং: ★★★★★★★★☆☆
বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দাদের ছবির পর্দায় আসা কোনও নতুন ঘটনা নয়। অনেক বছর ধরেই এই ধারা চলে আসছে। দর্শকের রহস্যপিপাসা মেটাতে এমন রহস্যসন্ধানী চরিত্রও তৈরি হয়েছে, যারা সরাসরি বড়পর্দায় এসেছে। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাটের দশকে প্রত্যেক বাড়িতে খুঁজলে অন্ততপক্ষে যে বইগুলি পাওয়া যেত, সেই সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে ওরফে শ্রীস্বপনকুমার সৃষ্ট দীপক চ্যাটার্জিকে কেউ কখনও ছবির পর্দায় আনার কথা ভাবেননি। পঞ্চাশের দশকে শশধর দত্তের দস্যু মোহনকে নিয়ে ছবি তৈরি হলেও বাংলার ‘বটতলার গোয়েন্দা’রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবহেলিত থেকেছে। কৌলিন্যে তারা ফেলু-ব্যোমকেশের সমগোত্রীয় হয়ে উঠতে পারেনি কোনওদিনই। এবার সেই ‘গাঁজাখুরি’ কাহিনিকে ট্রিবিউট দিতেই দেবালয় নিয়ে এলেন দীপক চ্যাটার্জিকে। সঙ্গে তার সহকারী রতনলাল ও খোদ শ্রীস্বপনকুমার।
বর্তমান সময়কালেই ছবি শুরু হয় একটি স্কুলে বিস্ফোরণের ঘটনা দিয়ে। নিতান্তই বিক্ষিপ্ত এক ঘটনা। এরপর দেখা যায়, কালের অতলে বিস্মৃত গোয়েন্দা দীপক (আবীর) এক গ্রন্থাগারের সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করে। সরকারের গোয়েন্দা দফতরের মিস নন্দী (শাঁওলী) তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানায়, বাদামী হায়না আসছে কলকাতা শহরকে ছারখার করে দিতে। এই আক্রমণ ঠেকানোর জন্য দীপককে প্রয়োজন। পাঠকদের মন থেকে বিস্মৃত হতে-হতে ‘এলিট কালচার্ড’ বাঙালিদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ দীপক স্রেফ প্রত্যাখ্যান করে বলে ‘জনপ্রিয়’ গোয়েন্দাদের দিয়ে কাজ চালাতে। এতে চিঁড়ে না ভেজায় মিস নন্দী খোদ শ্রীস্বপনকুমারের (পরান) শরণাপন্ন হন। লেখকের আহ্বানকেও দীপক প্রত্যাখ্যান করে। দীপকের মুখে সব শোনার পর রতনলাল (প্রতীক) তাকে অনুরোধ করে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য। দীপক তাতেও রাজি না হওয়ায় রতনলাল নিজেই তদন্তে নামে। তদন্তের জন্য নয়, বরং বন্ধুর খাতিরে অবশেষে রহস্যে জড়ায় দীপক। ঘটনাক্রমে কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে যায় কাঁদলে কাচের ফোঁটা পড়া আশ্চর্য মেয়ে তাসি (শ্রুতি), ফিরে আসে বাজপাখি (গৌতম) এবং অবশ্যই সবকিছুর আড়ালে থাকে বাদামী হায়না।
আরও পড়ুন: ডেভিড হেয়ারের জীবনী প্রকাশ
আড়াই ঘণ্টার ছবিতে এক মুহূর্তের জন্যও ক্লান্তিকর কোনও দৃশ্য রাখেননি দেবালয়। ছবির প্রথমার্ধ এক অদ্ভুত ছকভাঙা কায়দায় নির্মিত। পরিচালক এখানে বাংলা গোয়েন্দা কাহিনি ও গোয়েন্দা ছবির কাঠামোকে আঘাত করেছেন। প্রথমার্ধ একবার দেখলে মনে হতে পারে, কাহিনি বুঝি এগিয়ে চলেছে, কিন্তু পরক্ষণেই বোঝা যায়, না। যে কোনও ঘটনার ফলাফল হিসেবে অগুনতি সম্ভাবনার সেট থেকে র্যান্ডমভাবে যে কোনও একটা সম্ভাবনা বেছে নিয়ে ঘটনা ঘটাচ্ছেন খোদ স্রষ্টা শ্রীস্বপনকুমার। তাঁকে যে ‘বাদামী হায়নার কবলে’ গল্প লিখতে হচ্ছে! কখনও কোনও অংশ পছন্দ না হলে কলমের আঁচড়ে কেটে দিচ্ছেন। ফলস্বরূপ, বদলে যাচ্ছে দীপকের জীবনের চলনও। দর্শকের পক্ষে বোঝা মুশকিল হয়ে ওঠে, কখন বাস্তব ঘটনা চলছে, কখনই বা তা চলছে শ্রীস্বপনকুমারের কলমে। ম্যাজিক ও লজিক নিপুণভাবে মিশিয়েছেন দেবালয়। আদতে কি বাস্তবে একটিও দৃশ্য ঘটেছে? প্রশ্ন রয়েই যায়।
দ্বিতীয়ার্ধে স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠে দীপক। সে স্রষ্টার কলমের খোঁচায় নাচা পুতুল নয়। সে নিজের মতো করে বাঁচতে পারা মানুষ, একজন গোয়েন্দা, যার ওপর গোটা শহরকে বাঁচানোর দায়িত্ব।
আরও পড়ুন: অন্তত পাঁচ বছর থিয়েটার করার পরামর্শ মনোজের
বর্তমানে রহস্যকাহিনির মধ্যে যে ধরনের উপাদান পেতে দর্শক অভ্যস্ত, তা কোনওকালেই ক্লাসিক গোয়েন্দা সাহিত্যের উপাদান ছিল না। আধুনিকতার ধারায় সেই উপাদানগুলি যুক্ত হয়েছে ছবির খাতিরে, বইয়ের পাতায় ইনফোডাম্পিংয়ের জন্য। এই ব্যাপারগুলি একটি কাহিনিকে কতখানি মেদবহুল করে তুলতে পারে, তা যেন প্রতিটি দৃশ্যে দর্শকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন দেবালয়। তবে তিনি শুধু এখানেই থামেননি। শাসনব্যবস্থার দিকে আঙুলও তুলেছেন তিনি। সংলাপের কড়া হাতুড়ির আঘাত এতটাই কঠিন হয়ে গিয়েছে যে সেন্সর বোর্ডকে বাধ্য হয়েই দীপকের কিছু সংলাপ মিউট করে দিতে হয়েছে। অনুমান করা যায়, কিছু দৃশ্যসহ বেশ কিছু সংলাপ হয়তো প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই বাদ পড়েছে।
অভিনেতা নির্বাচন খুবই যথাযথ। যাঁরা দীপক চ্যাটার্জির একক পাল্প ফিকশন বইগুলির প্রচ্ছদের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা বুঝতে পারবেন, এই চরিত্রের জন্য আবীর এবং স্বপনকুমারের ভূমিকায় পরান ঠিক কতটা যথাযথ নির্বাচন। জেমস বন্ডের ছবিতে যেমন ‘বন্ডগার্ল’ থাকে, এই ছবিতে তাসিকে বোধহয় তেমনই ‘দীপকগার্ল’ বলা চলে। সেই ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেছেন শ্রুতি। রতনলালের ভূমিকায় প্রতীক দত্ত বেশ ভালো। তাঁর কমিক টাইমিং যথাযথ। এছাড়া বাজপাখির ভূমিকায় গৌতম, বনেদি জমিদার দীপেন্দ্রনারায়ণের চরিত্রে লোকনাথ, এবং শাঁওলীও যোগ্য সঙ্গত করেছেন।
ছবির কাহিনি সমরেন্দ্রনাথের লেখা কোনও গল্প থেকে গৃহীত নয়। এটি লিখেছেন দেবালয় নিজে। কিন্তু ছবি দেখলেই বোঝা যায়, দীপক চ্যাটার্জির প্রতিটি খুঁটিনাটি তিনি কীভাবে আত্মস্থ করেছেন। দীপকের বেশিরভাগ কাহিনিতে উপস্থিত, ২৩ নম্বর সংখ্যা থেকে শুরু করে ড্রাগন, কালনাগিনী, কালো নেকড়ে, শহরের বুকে আচমকা হেলিকপ্টার, চায়না টাউনে দুর্বৃত্তদের গোপন আস্তানা, সবই রয়েছে ছবিতে। যাঁরা ছেলেবেলায় পড়া এই গোয়েন্দাকে প্রথমবার ছবির পর্দায় দেখতে যাবেন, তাঁদের অতীত রোমন্থনের জন্য বহু সূত্র ছেড়ে রেখেছেন পরিচালক।
এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর আবহ ও সঙ্গীত। আবহ তো বটেই, রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে দেবালয়ের নিজের লেখা গানগুলিও যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন সঙ্গীত পরিচালক অমিত চট্টোপাধ্যায়। ছবির কাহিনিপ্রবাহের সঙ্গে গানগুলির কথা যথার্থভাবে মিলে যায়। গায়ে পুরোনো বইয়ের গন্ধ নিয়ে ন্যাপথলিন শোঁকা বিস্মৃত গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি পথে নামলে বেজে ওঠে ‘নির্বাসিত চাঁদ’। বিভিন্ন অংশে ব্যবহৃত এই গানটি যেন ছবির মূল সুরটিকে ধরে রাখে। শ্রীস্বপনকুমারের জাদুজগৎকে তাঁর ক্যামেরায় যথার্থভাবে ধরতে সফল রম্যদীপ সাহা। যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা।
আরও পড়ুন: ৪০ বছর পর পরিচালনায় ফিরছেন বিশ্বজিৎ
দীপক চ্যাটার্জি রহস্যভেদ করতে বেরোলে শহরে বৃষ্টি নামত। জানুয়ারির শীতে বৃষ্টি নামবে কিনা জানা নেই, তবে ছেলেবেলা থেকে যে ছোটরা ফেলুদা বা ব্যোমকেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে এসেছে, তারা হয়তো এবার দু’হাতে দুটো বন্দুক নিয়ে দীপক চ্যাটার্জি হতে চাইবে। আর একসময় যাঁদের দিন কাটত দীপকের নানা অভিযান নিয়ে, তাঁরা ফিরে পাবেন একরাশ ছোটবেলা।
সবশেষে, মূলস্রোতের বিরুদ্ধে একরাশ শ্লেষ ও খেদোক্তি বুদ্ধিদীপ্তভাবে মিশিয়ে এক সম্পূর্ণ অন্য ঘরানার, ছকভাঙা ছবি দেখে একবুক প্রাপ্তি নিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোবেন দর্শক।