“আমার বাঁচার সবটুকু কারণ উত্তর কলকাতা”
শীতের দুপুর তখন বেশ গাঢ়। দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্যাফেতে, গায়ে নরম চাদরের ওম নিয়ে গ্রিনটির কাপে চুমুক দিতে-দিতে পরিচালক মানসী সিংহ (Manasi Sinha) বললেন, ”শীতের দুপুর বলে বুঝতে পারছি না। টেনশনে ঘাম দিচ্ছে।” ঠিক যেন পরীক্ষা হলের সেকেন্ড বেল পড়ে যাওয়ার উদ্বেগ তাঁর চোখেমুখে। আগামীকাল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর নতুন ছবি ‘৫নং স্বপ্নময় লেন’। তার আগে আড্ডা দিলেন রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে
প্রশ্ন: এ বছর অক্টোবরেই ‘এটা আমাদের গল্প’ দিয়ে পরিচালনায় হাতেখড়ি হয়েছে তোমার। দু’মাসের মধ্যেই ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’। শুরুতেই জোড়া ছবি! ভূতের রাজার বর পেয়েছ নাকি?
মানসী: ভূতের রাজা! না-না, আমি নিজেই তো ভূত। রাতবিরেতে বাড়ি ফিরছি, কোথাও কিছু নেই। মোটামুটি ভূতের রাজা হয়ে আছি। বাড়ির লোক আমাকে এখন ওরকমই ধরে নিয়েছে। তবে একটা বর হয়তো পেয়েছি এই বুড়ো বয়সে, যে বলে, বি কনফিডেন্ট। আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আর নতুন কিছুই করার নেই। শুধু একই ধরনের অভিনয় করে যেতে হবে। ছেলেমেয়ে মানুষ করব, সংসার করব, যেটা আমি প্রায় করি না বললেই চলে। সব অবশ্য বরই সামলায়। একটা সময় মনে হচ্ছিল শেষের দিকে পা ফেলছি। ছবি পরিচালনা আমার জীবন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়েছে। দিয়ে বলেছে, তোমার এখনও অনেক কিছু করার আছে। দেখো, ওদিকে তাকাও, তোমার সারাজীবনের রসদ পড়ে আছে।
প্রশ্ন: প্রথম ছবির সাফল্যের পর বাংলার দর্শক সম্পর্কে পরিচালক হিসেবে তোমার কী ধারণা হলো?
মানসী: বাংলার দর্শক সম্পর্কে আমার ধারণাটা বরাবরই উঁচু। কোনওদিনই মনে হয়নি যে দর্শক আসছেন না। দেখো, এটা বিনোদনের জগত। সেখানে দাঁড়িয়ে যদি বিনোদনই দিতে না পারি, তাহলে দর্শক কেন আসবে? টিভি চললেই তো বিনোদনের সম্ভার খুলে যায়। ওয়ার্স্ট আলোচনায় যাচ্ছিই না। আমি বলছি অন্যরকম কিছু করার কথা, যেটা দর্শক টিভির পর্দায় পাননি আগে, তেমন কিছু। তাঁদের তো অপশনটা দিতে হবে। বলতে হবে, এই ভালোটা দেখতে হলে আপনাদের প্রেক্ষাগৃহে আসতে হবে। সেটা হয়ত আমার ছবিটা পেরেছিল। সেই জন্যে তাঁরা এসেছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন আমাকে। প্রত্যেকের মুখে এককথা ছিল যে পরেরটা কবে হবে? সেই ভরসাতেই পরেরটা বানিয়ে ফেললাম। এবার তিন নম্বরটা বানাব কিনা সেটা দর্শকই বলবে।
আরও পড়ুন: বাজিকা ভাষায় প্রথম ছবি, সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন আরিয়ান
প্রশ্ন: উত্তর কলকাতা, পারিবারিক সেন্টিমেন্ট তোমার ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে। এটা কি এক্স ফ্যাক্টর নাকি ছবি হিট করানোর ফর্মুলা?
মানসী: উত্তর কলকাতা আমার সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে। একপাতা সেফটিপিন কিনতে হলেও গড়িয়াহাট মোড়ের থেকে হাতিবাগান আসতে আমার আরাম লাগে বেশি । আমার ছবিতে উত্তর কলকাতা ফিরে আসা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। যাঁরা চেনেন আমাকে, জানেন। পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আসলে আমি উত্তর কলকাতার। ২০০৫ থেকে আমি দক্ষিণে থাকি। কিন্তু উত্তর কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার সময় আজও কেঁদে ফেলি। আমার বাঁচার সবটুকু কারণ এই নর্থ। হয়তো বাকি ছবিগুলোতেও দেখবে কোথাও না কোথাও আছে আমার খুব চেনা এই শহরটা। যদি লন্ডনেও ছবির শুটিং হয়, একটুকরো উত্তর কলকাতা থাকবেই।
প্রশ্ন: লেন্সে যখন চোখ রাখো তখন উত্তর কলকাতা তোমাকে কীভাবে অনুপ্রেরণা দেয়?
মানসী: আসলে কী জানো তো, নর্থ ভীষণ হ্যাপেনিং। এর অলিতে গলিতে রহস্য। আমাদের স্কটিশ চার্চ কলেজের উল্টোদিকে একটা সরু গলি আছে। সেটা এতটাই সরু যে দুটো মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে পারে না। সে গলি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ফুরোয় না। বরের সঙ্গে প্রেম করার সময় ওই গলির নাম দিয়েছিলাম অনন্ত যাত্রা। ওখানে একবার ঢুকে পড়লে তোমার একবেলার প্রেম হয়ে যাবে! এই শহরে ছোটবেলা কাটিয়েছি। সেই যে সুমনদার (কবীর) গান আছে, ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু।’ অনেক ইতিহাস রয়েছে এই শহরের পরতে-পরতে। লেন্সে চোখ রেখে নর্থ ক্যালকাটা দেখলে মনে হয়, সবটুকু আমার চেনা। আমি জানি এখানকার বাড়ি, রাস্তা, ল্যাম্পপোস্ট কীভাবে কথা বলে।
‘৫নং স্বপ্নময় লেন’-এর সেটে
প্রশ্ন: নতুন বছরেও কী জোড়া ছবি উপহার দেবে বাংলার দর্শককে?
মানসী: এইটা আমি জানি না। শুভঙ্কর (মিত্র, প্রযোজক) আমাকে তৈরি থাকতে বলেছে। যে কোনওদিন যে কোনওসময় নাকি চিত্রনাট্য লাগতে পারে। ও সবসময় আমাকে থ্রেট করে। ওই থ্রেট কালচার এখানেও চলছে কিন্তু (হেসে)। বলেছে, দিদি স্ক্রিপ্ট তৈরি করো, কবে শুটিং হবে আমি জানি না। তবে আমাদের কাজ ভীষণ ভাগ করা। ও ক্রিয়েটিভ ব্যাপারে ঢোকে না। তেমনই আমি ব্যবসা, প্রচার এসবে নাক গলাই না। আমরা দুজনেই ভীষণরকম ভাবে বুঝি যে কোনটা আমরা জানি, কোনটা জানি না। সত্যি বলতে এই বয়সে ও এতটা পোক্ত যে ওর কাজ ঘেঁটে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না।
প্রশ্ন: লেন্সের এপারে অভিনেত্রী মানসীদিকে কি আর দেখা যাবে?
মানসী: যাবে তো! একটা ধারাবাহিকও করছি, ‘মিত্তির বাড়ি’। কিন্তু সময়টা কীভাবে ম্যানেজ করব বুঝতে পারছি না। টিভি ধারাবাহিক হয়তো সত্যিই আমার জীবন থেকে চলে যাবে আস্তে-আস্তে। যে ডেডিকেশন আর কমিটমেন্ট প্রয়োজন, সেটা হয়তো দিতে পারব না আগামী দিনে। আর দায়িত্ব নেওয়ার পর একটা হাউজ়কে বিব্রত করার অধিকার তো আমার নেই। ছবি তো করবই। অনেকে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন, তুই ডিরেক্টর হয়েছিস কেউ তোকে আর অভিনয় করতে ডাকবে না। কিন্তু ডেকেছে, জানো। শুভঙ্কর চক্রবর্তীর ছবি ‘পাটলীগঞ্জের পুতুলখেলা’ মুক্তি পাবে তাড়াতাড়ি। আমি একটা ক্যামিও করেছি, কিন্তু খুব ভালো। অরিত্রর (মুখোপাধ্যায়) পরিচালনায় একটা ছবি করব। শুটিং দেরি আছে যদিও। স্ক্রিপ্ট এখনও শোনায়নি। শুধু ধমকে বলেছে, তুমি করছ। (একগাল হেসে) সবাই থ্রেট দেয়।
আরও পড়ুন: বাস্তুচ্যুত প্রান্তজন, নর্মদা ‘পরিক্রমা’য় দেখালেন গৌতম
প্রশ্ন: একঝাঁক নতুন মুখ রয়েছে ‘৫ নং স্বপ্নময় লেন’-এ। পরিচালক হিসেবে তুমি কি রিস্ক নিতে পছন্দ করো?
মানসী: আমারও তো একদিন ডে-ওয়ান ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে। সেই সময় আমাকে নিয়েও কিন্তু রিস্ক নিয়েছিলেন আমার পরিচালক। তাহলে আমি আরেকজনকে নিয়ে সেই রিস্কটা নেব না কেন? না হলে নতুন শুরু হবে কীভাবে? অডিশন করিয়ে নতুন শিল্পীদের নেওয়ার পরিকল্পনা আমাদের ছিলই। এবং অডিশনে এতটা সাড়া পেয়ে চমকে গিয়েছিলাম। অনেকে ভেবেছিলেন এর মধ্যে টাকাপয়সার গল্প আছে। নিন্দুকে অনেক সমালোচনা করেছে। একটা সময়ের পরে তারাও বুঝেছে। দ্বিতীয় অডিশন আমরা অনেকটা গুছিয়ে করেছিলাম। প্রথম অডিশন শেষ হলো যখন, তখন রাত ২টো। এরপর দেখি ৭২ জনের লাইন! এত মানুষ এসেছিলেন কেন? তারা জানেন, এখানে মিথ্যাচার হয় না। আগে ৭৫০ জনের মধ্যে ২৫০ জনকে বাছাই করেছিলাম। সেখান থেকে ৫১ জন নতুন মুখ এই ছবিতে কাজ করেছে। দুটো অডিশনের ব্যাঙ্কিং থেকে আগামী দিনে আরও পাঁচটা ছবি করব।
প্রশ্ন: তার মানে নতুন বছরে পরপর পাঁচটা ছবি?
মানসী: বাবাগো! ধুর, মরে গেলেও পারব না। অত পোক্ত নাকি আমি।
প্রশ্ন: ছবির সেটে নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব হয়নি?
মানসী: একটা কথা না বলে পারছি না। অডিশনের দিন একটি মেয়ে আমাকে বলল, দিদি আমি আজ পর্যন্ত কোনও সংলাপ বড়পর্দায় বলিনি। একটা সুযোগ দেবেন। আপনার নাম শুনে ভরসা করে অডিশন দিতে এসেছি। সে মেয়েটি একটি বড় চরিত্রে কাজ করেছে। আর তার বিপরীতে ছিল চন্দন সেন। চন্দনের কোনও অসুবিধা হয়নি। এদিকে সেই মেয়েটির তো হাত-পা কাঁপছে, ঝরঝর করে কাঁদছে। আমি বলেছি, অভিনয় করতে হলে সকলের সঙ্গেই করতে হবে। সেটে দাঁড়িয়ে এটা ভাবলে হবে না কে সিনিয়র, কে জুনিয়র। আমি থিয়েটারের মেয়ে। এটাই বিশ্বাস করি। ক্যামেরা একবার রোল হয়ে গেলে, আমি আর পরোয়া করি না। তখন আমি, আমিই।
ছবি: প্রতিবেদক