“আমি চাইলে দশটা ‘শিবপুর’ বানিয়ে ফেলতে পারি”
প্রযোজকদের অভিযোগকে উড়িয়ে তাঁদের আচরণকে অপেশাদার বললেন অরিন্দম ভট্টাচার্য। সম্প্রতি তাঁর পরিচালিত ‘শিবপুর’ নিয়ে তৈরি নানা সমস্যার কথা তুলে সাংবাদিক বৈঠকে অভিযোগ জানিয়েছিলেন ছবির অন্যতম প্রযোজক অজন্তা সিংহ রায়। ছবির মূল দুই চরিত্রে রয়েছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে অরিন্দমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রেডিওবাংলানেট-কে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালেন।
আপনি নাকি ছবির বাজেট বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছেন
প্রযোজক-পরিচালকের মধ্যে মতবিরোধ হতেই পারে। তবে সেটা নিয়ে এই বোকা-বোকা আচরণটা ওঁরা না করলেই পারতেন। সাংবাদিক বৈঠক করে এসব অভিযোগ করা অত্যন্ত বোকামির পরিচয়। একটা ছবি করতে যা খরচ হয় তার চুক্তি প্রযোজকের সঙ্গে হয়। সেটা মনিটর করেন একজন কার্যনির্বাহী প্রযোজক। পেমেন্ট প্রযোজকই করেন। সেখানে আমি কী করে এলাম? আমি খরচ করতে বললাম, আর ওঁরাও করে দিলেন? ওঁদের নিজেদের বোধবুদ্ধি নেই? ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে ঝগড়া হলে আমরা বড়দের কাছে গিয়ে নালিশ করতাম। এরাও সেটাই করছে। এগুলো নিয়ে কিছু বলতেই অদ্ভুত লাগছে আমার।
স্বস্তিকার সঙ্গে কোনও সরাসরি যোগাযোগ ছিল না বলে অভিযোগ করেছেন প্রযোজকরা। আপনিই নাকি সবটা দেখতেন
ঠিকই তো (হাসতে-হাসতে), স্বস্তিকার বয়স পাঁচ আর আমার বারো। আমি যা করতে বলেছি স্বস্তিকা তাই করেছে। ও নিজে কিছুই বোঝে না, পরিচালকের কথায় কাজ করে। এর বেশি আর কীই বা বলতে পারি! স্বস্তিকাকে যে নোংরা ইমেল করা হলো সেটা নিয়ে উত্তর দিক ওঁরা।
ছবির আরেক প্রযোজক সন্দীপ সরকারের আইডি থেকে স্বস্তিকাকে যে ইমেল করা হয়, সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি প্রযোজকরা
আমার কাছে সন্দীপের পাঠানো সেই ইমেল রয়েছে যেখানে তিনি ক্ষমা চেয়ে জানিয়েছেন তিনি তাঁর বন্ধুকে স্বস্তিকার ইমেল আইডি দিয়েছিলেন এবং সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ওই মেল পাঠায়। সেই মেলের প্রমাণ আমি দিতে পারি।
আরও পড়ুন: এবার ইতালির প্রেক্ষাপটে বাংলা ছবি ‘গুডবাই ভেনিস’
পরমব্রতর বেশ কিছু দৃশ্য নাকি আপনি ছবিতে রাখতে চাননি। ফলে ছবিতে পরমব্রতর চরিত্রের গুরুত্ব কমে গিয়েছে
পরিচালক হিসেবে আমি সেটা করতেই পারি। দৃশ্যটা আমার পছন্দ হয়নি তাই রাখিনি। সেটা করার অধিকার যে কোনও পরিচালকের থাকে। তাতে কার বাপের কী এসে গেল? পরমের সঙ্গেও আমার এই নিয়ে কথা হয়েছে। এটা একজন পরিচালক ও অভিনেতার মধ্যে ক্রিয়েটিভ ডিফারেন্স। সেটা তো হতেই পারে। সেই নিয়ে পরমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে, এমনটা একেবারেই নয়। পেশাদার অভিনেতা ও পরিচালকদের মধ্যে এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার।
মমতা শঙ্করের সঙ্গে দু’দিন শুটিং করার পরেও আপনি নাকি তাঁর দৃশ্য ছবি থেকে বাদ দিতে চেয়েছেন
হ্যাঁ, দু’দিন শুটিং করেছিলাম। পরে আমি আর ছবির সম্পাদক সেটা বাদ দেব ঠিক করি। যদিও আমরাই সেটা আগে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শুট করা অংশ দেখে যখন ভালো লাগল না, তখন বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পরিচালক এবং সম্পাদক যদি সেটা করে থাকে, তাতে কার কী এসে গেল? আমরা তো লুকিয়ে কিছু করি না। যা করি সবাইকে জানিয়েই করি। আর এমনটা নতুন হচ্ছে না। বহু ছবিতেই এমন হয়ে থাকে। এরা কোথা থেকে এসেছেন জানি না। সিনেমা তৈরির কোনও অভিজ্ঞতাই নেই, এমনকি স্টুডিও থেকে মালপত্র নিয়েও চলে যাচ্ছিলেন, কী না তাঁদের পছন্দ হচ্ছে না, তাই কাজ করবে না কেউ। আমি এমন প্রযোজক জীবনে দেখিনি যাঁরা টাকাপয়সা ঢেলে তারপর এরকম বোকা-বোকা ব্যাপার নিয়ে কাজ বন্ধ করে দিতে চায়।
আরও পড়ুন: এবার বড়পর্দায় নন্টে-ফন্টে, সুপারিনটেনডেন্ট স্যার
ছবির আবহসঙ্গীত নিয়েও তো অভিযোগ আছে। প্রযোজকরা অমিত-ঈশান জুটির অমিত চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে কাজ করাতে চাইলেও আপনি নাকি তাঁকে নাকচ করে দিয়ে অন্য একজনকে দিয়ে আবহ তৈরি করিয়েছেন। অমিত নিজেও সেদিন অজন্তার সঙ্গে সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন
আমার সঙ্গে আসল সমস্যা হয় মিউজ়িক নিয়েই। ওঁরা আমার সঙ্গে কথা না বলে নিজেরা ঠিক করে নেন অমিতকে নিয়ে কাজ করবেন। সেটা আমার পছন্দ হয়নি। পরিচালককে না জানিয়ে এভাবে ওঁরা কাউকে ঠিক করে ফেলতে পারেন না। সৃজন সৌম্যকে দিয়ে আমি কাজটা করাই। ও এর আগে কোথাও কাজ করেনি। তবু ওর কাজ আমার খুব পছন্দ হয়। আমার কাছে নতুন বা নামী কোনও ব্যাপার নয়। যে কাজটা যে জানে, তাঁকে দিয়ে সেটা করাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আর শুধু আমার নয়, স্বস্তিকা, রজতাভ (দত্ত) সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছিল। তখন আমি সেটাই ফাইনাল করি। আমার তো এটা চার নম্বর ছবি। আমি জানি এটাই নিয়ম যে পরিচালকই ঠিক করবেন তাঁর ছবিতে কে মিউজ়িক করবেন। প্রযোজক এই ব্যাপারে নাক গলান না। ওঁরা হঠাৎ আমাকে কিছুই না জানিয়ে একজনকে ঠিক করে ফেললেন। আমি তখন ক্ষেপে গেলাম। কারণ আমি এই কম্প্রোমাইজ়টা করতে পারব না। আমি কেমন ছবি বানাই সেটা আমার দর্শক জানেন। আমার কাজটা আমি প্রাণ দিয়েই করি। সেখানে কেউ এসে জোর করে সব পাল্টে দিয়ে ছবিটাকে খারাপ করতে চাইলে আমি কেন মেনে নেব? আর শুধু তাই নয়, একটা আদ্যোপান্ত মাফিয়া কর্মকাণ্ড নিয়ে ছবিতে ওঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত রাখতে চেয়েছিলেন। সেটা আমি কী করে মেনে নেব? আমি তখন সত্যিই রেগে যাই। যাই হয়ে যাক, এত যত্নে বানানো ছবিটাকে তো নষ্ট হতে দিতে পারি না।
বাংলা ইন্ডাস্ট্রির নামী প্রযোজক-পরিচালকের নাম নিয়ে আপনি প্রযোজকদের ভয় দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ
আমি এটাই বলেছি যে শ্রীকান্ত মোহতার মতো প্রযোজকও এইসব ছোট-ছোট ব্যাপারে নাক গলান না। আর সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও তাঁর ছবিতে কে সুর করবে সেই ব্যাপারে প্রযোজকের পরামর্শ নেন না। এটাকে যদি হুমকি দেওয়া বলে তাহলে আর কী বলব!
ছবির হার্ড ডিস্ক এডিটএফএক্সে আছে অথচ আপনার হস্তক্ষেপেই নাকি তাঁরা সেটা হাতে পাচ্ছেন না
এরকম লোকজনের সঙ্গে কাজ করা সত্যি মুশকিল। কাজ কিন্তু শেষ হয়নি। মিউজ়িক নিয়ে ওঁরাই দেরি করেছেন। আর এই সমস্যা তৈরি হওয়ার পর স্টুডিও থেকেই ঠিক করে যে সমস্ত সমস্যা না মিটলে ওরা ফিল্মের কপি দেবে না। আর টেকনিক্যালি ছবির কাজ এখনও শেষ হয়নি। এমনিতেও স্টুডিওর সঙ্গে পরিচালকই যোগাযোগ রাখেন, প্রযোজক কখনওই এখানে নাক গলান না। তাছাড়া ছবিটা এখন সেন্সর বোর্ডের কাছে গেছে। সেই অবস্থায় যে হার্ড ডিস্ক তোলা যায় না এটা ছবির সঙ্গে জড়িত সকলেই জানে, ওঁরা জানেন না।
ছবি তো তৈরি হয়ে গেছে। এখন এরকম একটা সমস্যায় ছবিটার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে? আপনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নিচ্ছেন না কেন?
একটা ইগোর লড়াই চলছে। সেই কারণেই ছবিটার ক্ষতি হচ্ছে। আমি কিন্ত চাইলে দশটা ‘শিবপুর’ বানিয়ে ফেলতে পারি। ওঁরা একটাও বানাতে পারবেন না। এটা বললেও এখন বলা হবে আমি হুমকি দিচ্ছি। আমার সঙ্গে যাই হয়ে যাক, যত ঝামেলাই হোক আমি চাইব ছবিটা মুক্তি পাক। আজই আমি এবং অজন্তার স্বামী দুজনেই থানায় গিয়েছিলাম। একটা মধ্যস্থতার জায়গায় ব্যাপারটা হয়তো আসবে। থানা থেকে অভিযোগও তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন আমি অবশ্যই চাই একটা সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসুক এবং এত লোক মিলে পরিশ্রম করে বানানো ছবিটা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাক। তবে ক্রিয়েটিভ দিক দিয়ে আমি কম্প্রোমাইজ় করতে রাজি নই। কারণ ছবি খারাপ হলে লোকে পরিচালককেই দোষ দেবে। আশা রাখছি সব সমস্যা মিটে গিয়ে ‘শিবপুর’ শীঘ্রই মুক্তি পাবে।
ছবি: RBN আর্কাইভ