চেনা ছকে অক্ষয়, তবু হলে ফিরুক দর্শক
ছবি: বেলবটম
পরিচালনা: রঞ্জিত তিওয়ারি
অভিনয়ে: অক্ষয় কুমার, লারা দত্ত, বাণী কাপুর, জাইন খান দুরানী, আদিল হুসেন, হুমা কুরেশি, মামিক, কবি রাজ
দৈর্ঘ্য: ১২৫ মিনিট
RBN রেটিং: ৩/৫
গত কয়েক বছরে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছবি তৈরি করার ঢল নেমেছে। বায়োপিক তো আছেই, তার সঙ্গে দর্শকের পছন্দ বুঝে বিভিন্ন দেশ কালে নানাভাবে যেখানেই ভারতের জয় ঘটেছে, সেই সমস্ত ঘটনাকে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরার এক নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। সে খেলা হোক বা যুদ্ধ কিংবা জঙ্গি আক্রমণ। বলা বাহুল্য মোটামুটি ঠিকঠাক সব উপকরণ মেশাতে পারলে সে ছবি বক্স অফিসে উতরেও যায়। আর ইদানিং এই ধরণের ছবির সবচেয়ে চেনা মুখ হয়ে উঠেছেন অক্ষয়। শেষ কয়েক বছরে তাঁর বেশিরভাগ ছবিই এই ধরণের কাহিনী নিয়েই তৈরি হয়েছে। যেমন ‘গোল্ড’, ‘কেশরী’ ও ‘এয়ারলিফ্ট’। ‘বেলবটম’ এই তালিকায় নতুন সংযোজন। রঞ্জিতের এটি দ্বিতীয় ছবি। এর আগে ২০১৭ সালে তিনি ‘লখনৌ সেন্ট্রাল’ পরিচালনা করেছিলেন। সেই ছবিটিও সত্য ঘটনা অবলম্বনেই ছিল।
কাহিনীর প্রেক্ষাপট ১৯৮৩-৮৪ সালের ভারতবর্ষ। এছাড়া গল্পের প্রয়োজনে লন্ডন ও দুবাইতেও পাড়ি দিয়েছেন অংশুল মালহোত্র (অক্ষয়) বা বেলবটম। ১৯৮৪-তে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর (লারা) আমলে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের দিল্লি থেকে শ্রীনগরগামী আইসি ৪২১ প্লেনটিকে হাইজ্যাক করে আইএসআই সমর্থিত জঙ্গিরা। এর আগের পাঁচ বছরে ছটি হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটেছে। এটি ছিল সপ্তম। স্বভাববতই নড়েচড়ে বসে ইন্দিরা সরকার। প্রতিবারই নানা জঙ্গি সংগঠন প্লেনকে লাহোরে অবতরণ করায় আর পাকিস্তান সরকারের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের মধ্যে রফা হয়। এর মধ্যে ভারতীয় সরকারকে চাপ দিয়ে বন্দি মুক্তি থেকে মুক্তিপণ আদায়, কোনও কিছুই বাদ যায় না। বরাবরই এমন হয়ে এসেছে।
তবে এবারের ঘটনায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং (র) এই হাইজ্যাকের ঘটনাকে নিজেদের এক যোগ্য এজেন্টের মাধ্যমে অন্যভাবে তদন্ত ও সমাধানের দাবি জানায়। র-এর এক সিনিয়র অফিসার (আদিল) ইন্দিরাকে জানান, তাদের সিক্রেট এজেন্ট বেলবটমই একমাত্র লোক যে এই বিপদ থেকে যাত্রীদের উদ্ধার করতে পারে। যেহেতু এরকম কোনও এজেন্টের নাম ও পরিচয় সবসময় গোপন থাকে, তাই দিল্লির উচ্চপদস্থ কর্তারা অংশুলের আসল নাম জানতে পারেন না।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
তবে সেই পরিচয় কিছুটা হলেও উঠে আসে তার সিক্রেট এজেন্ট হয়ে ওঠার কাহিনীতে। বছর সাতেক আগে এমনই এক হাইজ্যাকের ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন বেলবটমের মা রাভী মালহোত্র। সেই ঘটনার পর র-তে যোগ দেয় অংশুল। তারপর ১৯৮৩ সালে লন্ডনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের সময় সে সেই প্লেনের দুস্কৃতিদের খুঁজে বার করে। শুধু একজন তার হাত থেকে বেরিয়ে যায়। মূল অভিযুক্ত সেই ছেলেটিকে (জাইন)আইএসআই-এর চর বলে চিনে ফেলে বেলবটম।
এই ঘটনার পর ছবি ফিরে আসে ১৯৮৪-এর আগস্টে। যদিও ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা সকলেই সন্দেহ করেন খালিস্তানের দাবিতে কোনও শিখ সংগঠন এই হাইজ্যাকের কাণ্ড ঘটিয়েছে, বেলবটম তার যুক্তিতে অটল থাকে, এ কাজ পাকিস্তানের। নাহলে প্রতিবার প্লেন লাহোরে কেন নিয়ে যাওয়া হবে? তবে এবার প্রথমে প্লেন দাঁড়ায় অমৃতসরে, পরে তাকে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলবটমের কথামতো ইন্দিরা তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেডিডেন্ট জ়িয়াউল হকের (কবি) ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে বিমানটিকে আশ্রয় ও জ্বালানির যোগান দিতে বারণ করেন। জ়িয়াউল বাধ্য হয়ে অপারেশন টোপ্যাজ় থেকে হাত তুলে নেন। প্লেন দুবাই এয়ারপোর্টে নামে। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো হওয়ায় যাত্রীদের সুরক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠে আমিরশাহী সরকার। এই সময় কীভাবে সমস্ত অপারেশনের দায়িত্ব প্রায় একার কাঁধে তুলে নিয়ে দুবাই বিমানবন্দর থেকে ভারতীয় যাত্রীদের মুক্ত করে বেলবটম, তাই নিয়েই এই ছবি।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
ছবির মাধ্যমে মুল ঘটনার ছায়াকে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত ‘বেলবটম’ হিন্দি সিনেমার ধাঁচে গল্প বলাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। শুধুমাত্র কালার টোন পাল্টে অতীতের ঘটনা বলার স্টাইল এখন বেশ পুরোনো আর একঘেয়ে। আসলে বর্তমানে একের পর এক তুখোড় ও বাস্তববাদী ওয়েব সিরিজ়ের নির্মাণ ছবির মাধ্যমে গল্প বলার ব্যাকরণকে এতটাই পাল্টে দিয়েছে যে পুরোনো স্টাইল এখন আর সেই থ্রিল দিতে পারে না। একটি দৃশ্যের চলচ্চিত্রায়নের থেকেও এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার বাস্তবতা। সেই বাস্তব ছোঁয়ার কিছুটা অভাব রয়ে গেছে রঞ্জিতের দ্বিতীয় ছবিতে। প্লেন হাইজ্যাকের মতো সিরিয়াস বিষয়ের ছবিতে শুধুমাত্র নায়িকাকে স্ক্রিন টাইম দেওয়ার জন্য গান রাখার কোনও প্রয়োজনীয়তা ছিল না। ছবিতে তা যথেষ্ট বাহুল্য মনে হয়েছে। এছাড়াও অ্যাকশন দৃশ্যে বহু জায়গায় চেনা ফিল্মি আদল রাখার ফলে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের ওপর আধারিত ছবিও কিছুটা সাদামাটা লাগে।
তবে দিল্লির ক্যাবিনেট বৈঠক ও দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখতে ভালোই লেগেছে। দুবাই এয়ারপোর্টের কিছু দৃশ্যও বেশ ভালো। বড়পর্দায় দেখার জন্য বিশেষ কিছু দৃশ্য মনে রাখার মতো। যেমন আমিরশাহীর জলসীমানায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর জাহাজের প্রবেশ করতে না পারা বা দুবাই বিমানবন্দরে ঘনিয়ে আসা বিশাল ধুলোর ঝড়। এই ধরনের ছবির নিয়ম মেনে বেশ কিছু রক্ত গরম করার মতো সংলাপও অক্ষয়ের মুখে রেখেছেন পরিচালক। যেমন, ‘We are not only from the land of Gandhi, but also the land of Bose’। অবশ্যম্ভাবীরূপেই এই সব সংলাপ হলে হাততালির বন্যা বইয়ে দিয়েছে।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে অক্ষয় তার যথাসাধ্য করেছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে সাত বছর আগের অংশুল পর্দায় খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য না হয়ে উঠলেও সেই খামতি অক্ষয় তাঁর শরীরী ভাষা দিয়ে পূরণ করেছেন। আদিল প্রতিবারের মতোই এখানেও অনবদ্য। প্রতিটি দৃশ্যে তাঁর পরিমিত অভিনয় অবাক করে। নতুন করে চমকে দিয়েছেন লারা। চমকে দেওয়ার মতো মেকআপে ইন্দিরার ভূমিকায় লারাকে এই ছবিতে চেনা মুশকিল। মাপা অভিব্যক্তি দিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্বকে কিছুটা হলেও ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।। স্বল্প পরিসরে হুমা ভালো। তবে তাঁর বিশেষ কিছু করার ছিল না। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় মূল আইএসআই জঙ্গির ভূমিকায় জ়াইনের কথা। শরীরী ভাষায়, চোখের দৃষ্টিতে জ়াইন বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।
আরও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
দীর্ঘ বিরতির পর অবশেষে প্রেক্ষাগৃহ খুলে মুক্তি পেল ‘বেলবটম’-এর মতো ছবি, যা জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে দর্শক টানতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। তবে ছবির ক্লাইম্যাক্স আর একটু জোরালো হলে ভালো লাগত। চিত্রনাট্যের দুর্বলতাও কিছু জায়গায় চোখে লাগে। তানিষ্ক বাগচীর আবহ সঙ্গীত ছবির সঙ্গে মানানসই।
একটা বড় অংশের দর্শক বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে তৈরি ছবিটি দেখতে হলে যাবেন বলে আশা করা যায়। আঞ্চলিক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পক্ষেও যা বেশ সুখের ঘটনা হয়ে উঠতে পারে। হলে ফিরুক দর্শক। মানুষ প্রেক্ষাগৃহে যেতে শুরু করলে ছবি মুক্তির সংখ্যাও বাড়বে। হিন্দি ফিচার ফিল্ম জগতের নিরিখে দেশাত্মবোধক ছবি হিসেবে ‘বেলবটম’ দেখতে মন্দ লাগবে না। তাই অন্তত একবার হলে গিয়ে এই ছবি দেখে আসাই যায়।