নব্বইয়ের নস্টালজিয়া ফেরালেন শিলাজিৎ, নচিকেতা, অঞ্জন
RBN Web Desk: সালটা ১৯৯৩। বাংলা আধুনিক গানের জগতে তখনও অতীত গৌরবের স্মৃতি জ্বলজ্বল করছে। পুজো প্যান্ডেল থেকে প্রজাতন্ত্র দিবস সর্বত্রই বিরাজ করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, মান্না দে, শ্যামল মিত্রেরা। নতুন সৃষ্টি বলতে বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া জনৈক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের অন্য ধরনের বাংলা গান। সেই গানে বাঙালি যখন অবগাহন করতে শুরু করেছে তখনই এলেন আরেক ছকভাঙা গায়ক নচিকেতা চক্রবর্তী। প্রকাশিত হলো অ্যালবাম ‘এই বেশ ভালো আছি’। অ্যালবামের প্রচ্ছদে লেখা ছিল ‘জীবনমুখী বাংলা গান’। একের পর এক বিদ্রোহী কথার গান ছাড়াও বাংলায় র্যাপ, কাওয়ালি এবং নতুন ভাবনায় রোমান্টিক গানকে জনপ্রিয় করলেন তিনি। রুবি রায়ের এতদিন পর বাংলা পেল তার নীলাঞ্জনাকে।
এরপরের বছর উঠে এলেন আরও দুই তারকা, যাঁদের হাত ধরে বাংলা গান এগিয়ে যাবে অনেক দূর। প্রথমজন পরিচিত মুখ, অভিনেতা অঞ্জন দত্ত। প্রকাশিত হলো ‘শুনতে কি চাও?’ অ্যালবাম যেখানে এলভিস প্রেসলি, বব ডিলান, জন লেননদের সঙ্গীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক নতুন ধারার বাংলা গান পাওয়া গেল। এই প্রথম বাঙালি দর্শক তার নিজের ভাষায় শুনল পপ, জ্যাজ়, পশ্চিমী কান্ট্রি সুর। একই সঙ্গে জনপ্রিয় হলো বেলা বোস কিংবা রঞ্জনাও। দ্বিতীয়জন শিলাজিৎ মজুমদার। প্রথমসারির এক বাংলা সংবাদপত্রের বিপনণ বিভাগের কর্মচারী ব্রিফকেস ছেড়ে তুলে নিলেন গিটার। তাঁর আগমনে বিদ্রোহ থাকলেও ধারা ছিল একেবারে আলাদা। ১৯৯৪ সালে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘ভূমিকা’ প্রবল জনপ্রিয় হয়। উদাত্ত কণ্ঠের সঙ্গে তাঁর গানে পাওয়া গেল যৌবনের ঔদ্ধত্যও।
আরও পড়ুন: সিক্যুয়েলের পথে অজয়ও
নব্বইয়ের দশকের ঘ্রাণ নিয়ে ২ সেপ্টেম্বর বিকেলে মঞ্চে এলেন তিনজন। নচিকেতা, অঞ্জন ও শিলাজিৎ, প্রায় একযুগ বাদে তিন কিংবদন্তি শিল্পীকে এক মঞ্চে দেখল শহর কলকাতা, এবং এই কম্বিনেশনে প্রথমবার। এর আগে কখনও এক মঞ্চে তিন শিল্পীকে অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়নি। এই প্রথম মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁরা নিজেদের গানের পাশাপাশি অন্য শিল্পীর গানেও গলা মেলালেন এবং গাইলেন একে অপরের অনুরোধের গানও। প্রত্যাশামতোই আবেগে ভাসল দর্শক।
দু’দিন আগেই নচিকেতা পা রেখেছেন ষাট বছরে। ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন’ দিয়ে শুরু করলেন শিল্পী। এরপর একে একে গেয়ে গেলেন ‘তুমি আসবে বলে’, ‘দেখে যা অনির্বাণ’, ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’, ‘অ্যাম্বিশন’, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে’, ‘রাজশ্রী’ এবং আরও অজস্র গান যা একা নচিকেতা গাইছিলেন না। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইলেন শ্রোতারাও। নব্বইয়ের গানই বেশি গাইলেন তিনি। কারণ হিসেবে বললেন, “নব্বইয়ের সময়ের শ্রোতারা আছেন, তাই পুরনো সময়কে মনে রেখে পুরনো গান গাইছি আজ।”
অনুষ্ঠানে পরেরদিকে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন অঞ্জনও। তাঁর পরিচালিত ছবিতে গান গেয়েছেন নচিকেতা। প্রবল জনপ্রিয় ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ শোনা না গেলেও দুই শিল্পী গলা মেলালেন নচিকেতার ‘দুলছে হাওয়ায়’। বলা বাহুল্য দর্শকরাও গাইলেন তাঁদের সঙ্গেই। এমন বিরল মুহূর্তকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে উঠল ভিডিও, ঝলসাল ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। গানের কথায় কিঞ্চিৎ ভুল করেছিলেন অঞ্জন। মেনে নিয়ে বললেন, পরেরটায় আর ভুল হবে না। বলে নচিকেতার কেক কাটার সঙ্গে-সঙ্গেই ধরলেন ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’। দর্শক হেসে গড়াগড়ি। এরপর শিলাজিৎ এসে গলা মেলালেন ‘নীলাঞ্জনা’র সুরে।
“আগে এমন অনুষ্ঠান অনেক করেছি আমরা। তবে শিলাজিতের সঙ্গে এই প্রথম আমি এক মঞ্চে এলাম,” জানালেন অঞ্জন। ইদানিং নানান ফর্মে গান শোনা গেলেও লাইভ গানের অনুষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি। মঞ্চে এসে প্রথমেই শিলাজিতের অনুরোধে গাইলেন ‘শুনতে কি চাও তুমি’। তারপর একে একে এল ‘দার্জিলিং’, ‘রঞ্জনা’, ‘মেরি অ্যান’, ‘বেলা বোস’। এর মধ্যেই ছোট-ছোট বিরতিতে নীল দত্ত গাইলেন ‘আমি আসব ফিরে’ বা ‘মাঝি রে’। সেসব গানকেও তুমুলভাবে স্বাগত জানাল দর্শকদের করতালি। অমিত দত্তের আঙুল যখন গিটারের তারে ঝড় তুলল, উল্লাসে ফেটে পড়লেন শ্রোতারা।
তিন শিল্পীর মধ্যে বয়সে সবথেকে বড় হলেও অঞ্জনের এনার্জিতে কোনও ঘাটতি দেখা গেল না। তবু এটুকুতে মন ভরে কই! তাঁকে এত অল্পে ছাড়তে রাজি ছিলেন না দর্শক। তবে সময় সীমিত, তাই যেতেই হয়। নচিকেতার অনুরোধে তিনি সে রাতের শেষ গানটি গাইলেন, ‘তুমি আসবে বলে তাই’। দর্শক আসনে তখন অনেকের চোখেই জল। উন্মাদনা আর আবেগের সঙ্গে এক আলাদা সময়ের সাক্ষর রেখে গেলেন তিনি।
আরও পড়ুন: জেন্টস পার্লারের দায়িত্বে মধুরিমা, সঙ্গী খরাজ
তৃতীয় ও শেষ শিল্পী ছিলেন শিলাজিৎ। স্বভাবসিদ্ধ দাপুটে ভঙ্গিতে শুরু করলেন ‘বুকে আমার বারুদের বাসা’ দিয়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই দর্শককে হাসালেন, কাঁদালেন এবং আনন্দ দিয়ে গেলেন তিনি। তাঁর এদিনের গানের তালিকায় ছিল ‘কত রাত খুঁজেছি তোমায়’, ‘সামনের মাসে তোমায় নৌকা কিনে দেব’, ‘লালমাটির সরানে’, ‘বাজল ছুটির ঘণ্টা’র মতো গান। দর্শকের সঙ্গে আবেগের জার্নিতে সামিল হয়ে মঞ্চ দাপালেন শিলাজিৎ, সাক্ষী থাকল ভক্তকুল। প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে তাঁরাও গেয়ে উঠলেন বহুশ্রুত গানগুলি। গানের সঙ্গে পিছনের স্ক্রিনে চলছিল এভি। সঙ্গে ছিল কোরাস। ‘কত রাত খুঁজেছি তোমায়’ গানটির পরিবেশনা ছিল অনবদ্য।
সময় বদলেছে। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আর্থিক পালাবদলের পাশাপাশি বদলে গেছে মানুষের পছন্দ অপছন্দও। তবু ইঁট-কাঠ-পাথরের কঠিন এই শহরে নব্বইয়ের নস্টালজিয়া আজও শ্রোতাদের স্পর্শ করে। আজও নগর বাউলরা তাঁদের ‘খেলনা দোতারা’ নিয়ে আম জনতার মনে দোলা দিয়ে যেতে পারে, আবার দেখা গেল শহর-সন্ধ্যায়।