তেমন না জমলেও, একবার অন্তত দেখাই যায়

ছবি: আড্ডা

দৈর্ঘ্য: ১ ঘন্টা ৫০ মিনিট

পরিচালনা: দেবায়ুষ চৌধুরী

অভিনয়ে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, দীপাংশু আচার্য, সায়নী ঘোষ, ইন্দ্রাশিস রায়, সৌরভ দাস, প্রান্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বর্ণাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ হালদার, জিৎ দাস, ঋত্বিকা পাল।

RBN রেটিং: ২.৫/৫

বাঙালির স্বত্তা এবং আড্ডা একে অপরের পরিপূরকই বলা চলে। ট্রামে, বাসে, পাড়ার রকে কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডায় মশগুল বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। এই আড্ডার খপ্পরে পড়ে রবিবারের বাজারে কুমড়োর পরিবর্তে লাউ এনে ফেললে গিন্নির সঙ্গে লাঠালাঠি লাগতে বাধ্য। তবু আড্ডা থামে না। এ যেন একেবারে বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে মিশে আছে। এর জন্য চেনাজানার প্রয়োজন নেই, নেই কোনো বয়সের সীমা। যখন খুশি, যেখানে খুশি, যার সঙ্গে খুশি আড্ডা জমাতে সিদ্ধহস্ত বাঙালি। সামান্য ‘কেমন আছ? ভালো আছি’ থেকে শুরু হয়ে আড্ডা চলতে থাকে সমাজের বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনীতি নিয়ে। মাঝেমাঝে নির্ভেজাল আড্ডার রং বদলে শুরু হয় তর্কাতর্কি। চলতে থাকে মতবিরোধ কিন্তু আড্ডার স্থান কোনওদিনই শূন্য থাকে না।




ঠিক এ ধরণের চার রকম আড্ডার গল্প এক সুতোয় বেঁধেছেন পরিচালক দেবায়ুষ চৌধুরী তাঁর প্রথম ছবি ‘আড্ডা’তে। এই ছবির গল্প শুরু হয় আলো ও অন্ধকারের প্রতীকিরূপে সাদা (সব্যসাচী) ও কালো (দীপাংশু) নামের দুই স্বর্গদূতের মর্ত্য পরিভ্রমণ নিয়ে। কালোর বক্তব্য, বাঙালি তাঁর আদর্শ ভুলে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। বাঙালির আর জীবন বলে কিছু নেই। এদিকে কালোকে ভুল প্রমাণ করাই সাদার উদ্দেশ্য। তার মতে, অন্ধকার না থাকলে আলোর মর্ম বোঝা যায় না। আর কলকাতা এমন একটা শহর যেখানে বর্তমান তার অতীতকে সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

সাদা-কালো তাদের দ্বন্দ্ব মেটাতে বেরিয়ে পড়ে বাঙালির আদর্শ ফেরানোর গল্প খুঁজতে। এভাবেই তারা উপস্থিত হতে থাকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তের আড্ডাস্থলে। এক দুর্গাপুজোর দশমীর সকালে তারা পৌঁছয় এক অসুস্থ বৃদ্ধর বাড়ির সামনে। সেখানে আড্ডা জমাতে আসেন তাঁর তিন বন্ধু। আড্ডা দিতে দিতে অধ্যাপক ধৃতিমান পাঁজা (সৌমিত্র) বলে ওঠেন, বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তিকে আপন করে নেওয়ার ফলে মূল্যবোধগুলো ভুলে যাচ্ছে। অত্যধিক যন্ত্র ব্যবহার মানুষকে যান্ত্রিক করে তুলেছে যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়।

আরও পড়ুন: পঁচিশে ‘উনিশে এপ্রিল’

সাদা-কালো এরপর ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে একটি পুজোমণ্ডপে। সেখানে তখন তিনজন যুবকের জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে হাসাহাসি করে উড়িয়ে দিয়ে পরিস্থিতি লঘু করার চেষ্টা চলছে। পুরোহিত ওরফে পুরু (প্রান্তিক), সাহিল (স্বর্ণাভ), বাপ্পা (জিৎ) এই তিনবন্ধুর কেউ চাকরি পেয়েছে বলে আরেকজনকে তার বেকারত্বের খোঁচা খেতে হচ্ছে। আবার সাহিলের দীর্ঘদিনের প্রেমিকার সঙ্গে পুরুর আচমকা প্রেমের কারণে বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে যায় দুজনের। এদের সঙ্গে রয়েছে অমর (দেবপ্রসাদ) যার প্রেমিকা তানিয়া (সায়নী) তাকে ঠকিয়ে বিত্তশালী রুদ্রকে (ইন্দ্রনীল) বিয়ে করেছে। টালিগঞ্জের জুনিয়র শিল্পীর কাজ করে তানিয়া। কর্মক্ষেত্রে এবং বৈবাহিক জীবনে নিগৃহীত হতে হতে তানিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের দাবি জানায় রুদ্রর কাছে এবং তা পেয়েও যায়।এদিকে বড় চাকুরে রুদ্র ভীষণভাবে নস্টালজিক তার আগের জীবন নিয়ে। গানকে ভালোবাসলেও কাজের চাপে তাকে হারিয়ে ফেলেছে সে।

এরপর সাদা কালো ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছায় ধৃতিমানের কলেজে। সেখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের কিছু দাবি না মানার প্রতিবাদে গ্রেপ্তার হয় আফরিন (ঋত্বিকা)। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাপান উতোর চলতে থাকে বৃদ্ধ ধৃতিমান এবং আরেক কম বয়সী অধ্যাপকের মধ্যে। কোথাও যেন দুটো প্রজন্মের মধ্যেকার ফাঁকটা প্ৰবলভাবে ফুটে ওঠে এই দৃশ্যে। প্রত্যেকেই তাদের মতামতে অবিচল।

আড্ডার রেশ এসে উসকে দেয় সত্যজিৎকেও (সৌরভ)। বিদেশে থাকা সত্যজিতের দেশের মাটির প্রতি টান তাকে ফিরিয়ে আনে। কলকাতায় সে এক নতুন বন্ধু খুঁজে পায়। এরপর ঘুরে যায় সাতটি বসন্ত।

আরও পড়ুন: গান শেষ আর জান শেষ তো একই কথা রাজামশাই

অভিনয়ে প্রত্যেকেই তাদের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। সাদা-কালোর ছন্দ মিলিয়ে বলা সংলাপ প্রশংসনীয়। সবকিছুই ঠিক ছিল শুধু গল্পটা জমতে গিয়েও জমলো না। পরিচালক বোঝাতে চেয়েছেন অনেক কিছু কিন্তু ছবির সীমিত পরিসরে পেরে ওঠেননি। সেটা সম্ভবও নয়। সম্পর্কগুলোর হঠাৎ করে বদল ভীষণ চোখে লাগে। চরিত্রগুলোর অতীতের গল্পও ঠিকমতো খোলসা হওয়ার আগেই তারা লাফিয়ে ঢুকে গেলেন বর্তমানে। গল্পে প্রেম ও যৌনতা নিয়ে একটু বেশিই কচকচানি ছবিকে কিছুটা সময় একঘেয়ে করে দেয়। বাঙালির সেন্টিমেন্টকে নিয়ে বানানো ছবিতে অহেতুক লম্বা লম্বা ইংরেজি সংলাপ এক একসময় ‘আড্ডা’কে আঁতলামোর পর্যায় নিয়ে যায়। ছবির শেষে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ একটু অন্যরকম ভাবে উপস্থাপন করেছেন সঙ্গীত পরিচালক শুভম মৈত্র এবং জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এরপরেও ‘আড্ডা’ খারাপ ছবি নয়। গল্পে নতুনত্ব না থাকলেও, বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি নিজের মতো করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন দেবায়ুষ। ছবিতে একঝাঁক প্রতিভাবান তরুণ শিল্পীর উপস্থিতি ভালো লাগে। বর্তমানে থ্রিলার এবং অতিপ্রাকৃত গল্পের ভিড়ে দেবায়ুষের এই প্রচেষ্টার সাক্ষী হতে একবার অন্তত দেখাই যায় ‘আড্ডা’।

Amazon Obhijaan



Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *