বাঙালি অভিনেতারা অনবদ্য, চ্যাম্পিয়নের মতোই খেলল অজয়ের টিম
ছবি: ময়দান
পরিচালক: অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মা
অভিনয়ে: অজয় দেবগন, প্রিয়মণি, গজরাজ রাও, রুদ্রনীল ঘোষ, অমর্ত্য রায়, চৈতন্য শর্মা, বাহরুল ইসলাম, তেজস রবিশঙ্কর, দভিন্দর গিল, আরিয়ান ভৌমিক, সুশান্ত ওয়েদান্ডে
দৈর্ঘ্য: ৩ ঘণ্টা ১ মিনিট
RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆
সোনার মেডেল এসেছিল ১৯৫১ সালেই, প্রথম এশিয়ান গেমসে। কিন্তু তারপরের বছরেই হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার কাছে লজ্জাজনক হার। অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। ম্যাচের স্কোর ছিল ১-১০। এই ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে বর্তমান ভারতীয় ফুটবল দলের অবস্থা যেমনই হোক না কেন ৭২ বছর আগে এ দেশের জাতীয় দল বিদেশের মাটিতে ওই ফলাফলের পরেও আবার ঘুরে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিল। সেই দলের কাণ্ডারী ছিলেন সৈয়দ আবদুল রহিম (Syed Abdul Rahim)। ‘ময়দান’ (Maidaan) তাঁরই কাহিনি।
১৯৫২ থেকে ১৯৬২, এই দশ বছরকে ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তার একমাত্র কারণ কোচ আবদুল রহিম ওরফে রহিমসাব। সেই সময়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আর কখনও ভারতীয় ফুটবল তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে পারেনি। কারণ রহিমের মতো কোচ বারবার জন্মায় না।
ছবির কাহিনি শুরু হয় তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে সেই জঘন্য হারের সময় থেকে। পছন্দের দল পাননি রহিম (অজয়)। তার ওপর খালি পায়ে খেলা এবং দেশে মাত্র ৭০ মিনিট খেলার অভ্যাস থাকা দল বিদেশে গিয়ে ৯০ মিনিটের দম রাখতে পারেনি। তাই নতুন খেলোয়াড় যেমন চাই তেমনই চাই নতুন জুতো ও নয়া স্ট্র্যাটেজি। লেগে পড়লেন রহিম। হায়দরাবাদের মানুষ রহিম আক্ষরিক অর্থেই খোঁজ শুরু করলেন একেবারে ফুটপাথ থেকে। তুলে আনলেন এমন কয়েকজন খেলোয়াড় যাঁদের মধ্যে কলকাতা ময়দানে খেলা প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (চৈতন্য) বা গোয়ার নেভিল ডিসুজ়া (আরিয়ান) যেমন ছিল, তেমনই ছিল পুরোনো হায়দরাবাদের গলি থেকে উঠে আসা তুলসীদাস বলরাম (সুশান্ত)। তৈরি হলো চ্যাম্পিয়ন টিম। কিন্তু এত সহজে সাফল্য এল কি?
আরও পড়ুন: ডুংরুতেই ভরসা রাখছেন সন্দীপ রায়
কলকাতা ময়দান আর ফুটবল বাঙালির রক্তে মিশে আছে। তাই বাঙালিকে ফুটবল নিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ কষ্ট করতে হয় না। এই একটি খেলার জন্য সব ছাড়তে রাজি তারা। ‘ময়দান’ হয়তো অনেকটাই তাদের কথা ভেবেও তৈরি। কারণ ‘ময়দান’ শুধু রহিমসাবের গল্প নয়, বাংলার দুই গর্ব পিকে এবং চুনী গোস্বামীর (অমর্ত্য) উঠে আসারও গল্প। নতুন দল তৈরি হওয়া থেকে জয়ের পথে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়ার এই লড়াই যে কোনও ফুটবলপ্রেমীর রক্ত গরম করবেই। প্রায় অসম্ভব একটা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে রহিমের যে অসামান্য পরিশ্রম ছিল তার চেয়েও বোধহয় একটু বেশি ছিল তাঁর টিমের দুর্ভাগ্য। না হলে ১৯৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়াকে ৪-২ হারানো এবং নেভিলের দুর্ধর্ষ হ্যাটট্রিকের পরেও একটা ১৯৬০-এর বিপর্যয় হয় না। দুই টুর্নামেন্টেই চতুর্থ স্থানে শেষ করে ভারত এবং রহিমকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও জীবনের শেষ মোড় থেকে তাঁর কামব্যাক করার গল্পকে অলীক কাহিনির মতোই দেখতে লাগে।
১৯৬২ সালের জাকার্তা এশিয়ান গেমস (Jakarta Asian Games) শুরু থেকেই ছিল বিতর্কিত। ভারতীয় অর্থনীতি সংকোচনের ফলে বিদেশে খেলতে যাওয়াও অনিশ্চিত ছিল দলের। শর্তসাপেক্ষে যদি বা ফুটবলাররা পৌঁছতে পারলেন, তাঁদের পড়তে হলো ভয়ঙ্কর বিক্ষোভের মুখে। রাজনীতির নোংরা খেলায় ইন্দোনেশিয়া সরকার ইজ়রায়েল ও তাইওয়ানকে টুর্নামেন্ট থেকে নিষিদ্ধ করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতীয় কর্মকর্তা জিএস সন্ধির সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘একে এশিয়ান গেমস না বলে জাকার্তা গেমস বলাই ভালো’, যার জেরে কলকাতায় সে যুগে দেওয়াল লিখনও হয়েছিল ‘সন্ধি বিচ্ছেদ’ বলে, সেই ঘটনা ভারতীয় ফুটবলারদের বিদেশের মাটিতে ভিলেন বানিয়ে দিয়েছিল। সেই জায়গা থেকে জয় ছিনিয়ে আনা সহজ ছিল না। তার ওপর থঙ্গরাজের মতো নির্ভরযোগ্য গোলকিপারের চোট, জার্নেল সিংয়ের আহত হওয়া, সবমিলিয়ে এক প্রায় দুর্ভেদ্য লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়া, অজয় এবং তাঁর শিষ্য ব্রিগেড মুগ্ধ করেছেন প্রতিটি ফ্রেমে। যে ইতিহাস ভারতবাসী প্রায় ভুলতেই বসেছিল তাকে আবার পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন পরিচালক। কৃতিত্ব তাঁর এবং তাঁর অভিনেতা ও কলাকুশলীদেরও।
আরও পড়ুন: সত্যজিতের আরও দুটি ছবি সংরক্ষণের কাজ শুরু
পঞ্চাশের দশকের জাতীয় দলের প্রতিটি ফুটবলারের ছবি দেখে সেই সাদৃশ্য রেখে অভিনেতা খুঁজে বের করা এবং তাঁদের দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ফুটবল খেলিয়ে নেওয়া অতি জটিল এক পদ্ধতি। এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। সেখানেই অবিশ্বাস্যভাবে সফল হয়েছেন অমিত। প্রতিটি খেলোয়াড়ের চেহারায় আসল মানুষটির সঙ্গে অদ্ভুত মিল। আর অবাক করেছে তাঁদের প্রত্যেকের অভিনয়। পিকে কিংবা চুনী, জার্নেল কিংবা থঙ্গরাজ, প্রত্যেকে যেন একেবারে মাঠ থেকে উঠে এসেছেন। চোখ দিয়ে অভিনয় করাকে বহুদিন হলো অজয় (Ajay Devgn) এক শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। সত্তর বছরেরও আগের এক সত্যি রূপকথাকে পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন অজয় শুধুমাত্র তাঁর দৃষ্টি দিয়েই।
বাংলার তিন অভিনেতাই অনবদ্য। রুদ্রনীল (Rudranil Ghosh) প্রত্যাশিতভাবেই অসাধারণ। তিনি কোন পর্যায়ের অভিনেতা সে বাঙালি জানলেও গোটা ভারত জানত না। এবার জানবে। অজয়ের চোখে চোখ রেখে খলচরিত্রে নিজের অভিনীত বহু চরিত্রকে ছাপিয়ে গেছেন তিনি। নেভিলের চরিত্রে আরিয়ানকে উজ্জ্বল লেগেছে। তবে সবথেকে অবাক করেছেন অমর্ত্য (Amartya Ray)। চুনী গোস্বামীর চরিত্রে এত সপ্রতিভ সম্ভবত আর কেউ হতে পারতেন না। সঠিক সুযোগ পেলে অনেকদূর যাবেন অমর্ত্য।
আরও পড়ুন: মধুবালার বায়োপিক
চমৎকার অভিনয় করেছেন অভিজ্ঞ গজরাজও। চৈতন্য, তেজস, দভিন্দর, সুশান্ত চমকে দিয়েছেন অভিনয় দিয়ে, ফুটবল দিয়েও। বাহরুলের অঞ্জনকে মনে থেকে যাবে অনেকদিন। আর সবশেষে প্রিয়মণি, যাঁকে ছাড়া অজয়ের অভিনয় পূর্ণতা পেত না। কিংবদন্তি ফুটবল প্রশিক্ষকের শীতল উপস্থিতিকে অদ্ভুতভাবে নিজের উষ্ণতায় ব্যালেন্স করে গেলেন সারাক্ষণ, রহিমের স্ত্রী সাইরা।
বড়পর্দায় টেকনিক্যাল কারিগরিতে ফুটবল ম্যাচ দেখতে দিব্যি লাগে। প্রতিটি শটের ধাক্কা এবং শব্দ দর্শককে শেষ পর্যন্ত চাগিয়ে রাখবে। ছবির দৃশ্যগ্রহণ সময়োপযোগী। আগাগোড়া ছবির কালার টোন পঞ্চাশের দশককে ধরে রাখতে সক্ষম। এআর রহমানের সঙ্গীত ও আবহ ভালো, তবে মনে রেখে দেওয়ার মতো নয়।
ছবির দৈর্ঘ্য কিছুটা কমানো যেত। যেখানে ৯০ মিনিট লাগে একটা ফুটবল ম্যাচ শেষ হতে, সেখানে পাক্কা তিন ঘণ্টার ছবি কিছুটা ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। যদিও ছবি যথেষ্টই টানটান। তবু কিছু জায়গায় মেদ কমানো যেত। তবে ১৯৫০-এর বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে সুযোগ পেয়েও সরকারি টালবাহানায় দল নিয়ে যেতে না পারার মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা কেন দেখানো হলো না বোঝা গেল না। কলকাতার ফুটবল এবং ফেডারেশন নিয়ে চাপানউতোরের ভিড়ে যেন কিঞ্চিৎ পিছিয়ে পড়ল কলকাতা ময়দান। যেখান থেকে চুনী-পিকের জন্ম, সেই ঘাসে তাদের দাপট দেখতে মন্দ লাগত না। এটুকুই যা আফসোস রয়ে গেল। তবে সব আফসোস মিটে যায় এন্ড স্ক্রোলের ঠিক আগে, পরিচালকের করা সর্বশেষ গোলে। না দেখেও বলে দেওয়া যায়, এই দৃশ্যে যে কোনও ভারতীয় ফুটবলপ্রেমী নিশ্চিতভাবেই গর্বে উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চিপে আবেগ সামলাবেন।
সাম্প্রতিক বায়োপিকের ভিড়ে, ইতিহাস আর অভিনয় দিয়েই দর্শকের স্মৃতিতে থেকে যাবে ‘ময়দান’, এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।