“রায় পরিবারের পছন্দের ফেলুদা আমিই”
ডিসেম্বরে মুক্তি পেয়েছে সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজ়ের ছবি ‘হত্যাপুরী’। ২০১৬ সালে সব্যসাচী চক্রবর্তীকে নিয়ে ‘ডবল ফেলুদা’র পর বড়পর্দায় ফেলু চরিত্রে নতুন অভিনেতার খোঁজ চলেছিল বেশ কয়েক বছর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী ও আবির চট্টোপাধ্যায়ের পর বড়পর্দায় চতুর্থ ফেলুরূপে এসেছেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। সম্প্রতি ডিজিটাল মাধ্যমেও মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। ফেলুদা হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা সংবাদমাধ্যমকে জানালেন ইন্দ্রনীল।
ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করা নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছিলে? কতটা নার্ভাস লেগেছিল?
ইন্দ্রনীল: নার্ভাস ছিলাম বললে ভুল হবে। বরং উদ্বিগ্ন ছিলাম বলা যায়। আমি বরাবর কলকাতার বাইরে থেকেছি। ফেলুদার বাঙালিয়ানা নিয়ে দর্শকের মনে একটা বিশেষ ধারণা রয়েছে। যারা কলকাতায় জন্মেছে ও বড় হয়েছে তাদের সঙ্গে আমার বাংলা বলার সাবলীলতায় তফাৎ থাকবেই। তার জন্য আমি কঠিন পরিশ্রম করেছি, উচ্চারণের ওপর জোর দিয়েছি। যদিও আমি মোটামুটি ভালোই বাংলা বলি, তবু ফেলুদা চরিত্রের জন্যই এই পরিশ্রমটা করেতে হয়েছে। বাংলা বই পড়া, বলা অভ্যাস করার পাশাপাশি ফেলুদা চরিত্রের যে সূক্ষ্মতা সেটা বাবুদা (সন্দীপ) বুঝতে সাহায্য করেছেন। বাংলা বলার জন্য যে শরীরীভাষা প্রয়োজন, সেটাও তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন। বলা যায় আমরা একটা টিম হিসেবে চেষ্টা করেছি ফেলুদাকে ফুটিয়ে তুলতে।
দিকপাল অভিনেতারা ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এবং এখনও আরও অনেকে করছেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে কীভাবে গড়ে তুললে?
ইন্দ্রনীল: সৌমিত্রবাবু এবং বেনুদার (সব্যসাচী) মতো অভিনেতারা ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন এটা জেনেও আমি কোনও বিশেষ কারও নাম মাথায় রেখে চরিত্রটার প্রস্তুতি নিয়েছি, এমন কিন্তু নয়। আমি সাধারণত কারও কাজের রেফারেন্স ধরে এগোই না। কোনও বিশেষ চরিত্রের জন্য অন্য কোনও অভিনেতাকে অনুকরণ করাও পছন্দ করি না। বাবুদা নিজেই আমাকে বারণ করেছিলেন আগের ছবিগুলো দেখতে। বলেছিলেন, নিজে চরিত্রটাকে বুঝে, ভিশ্যুয়ালাইজ় করে সেই অনুযায়ী অভিনয় করতে। তবে ‘হত্যাপুরী’ গল্পটা এমিনতেই এত রিল্যাক্সিং যে কাজের সময় অনেকটা চাপমুক্ত থাকতে পেরেছি।
দর্শক কীভাবে নেবে, সেই চাপ তো ছিলই
ইন্দ্রনীল: অবশ্যই, সেটাই আসল। কোটি-কোটি ফেলুপ্রেমী আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের প্রিয় চরিত্র হয়ে উঠতে না পারলে আমাকে সমালোচনায় ছিঁড়ে ফেলতে তারা এক মিনিটও সময় নেবেন না। বাবুদা আমাকে কাস্ট করেছেন, কাজেই আমি ব্যর্থ হলে তিনিও ব্যর্থ হবেন। ওঁর দিকে আঙুল উঠবে। এইসব চাপ থাকা সত্বেও কিন্তু বাবুদা আমাকে শুরু থেকেই রিল্যাক্সড থাকতে বলেছেন। নিজেও তাই থেকেছেন। বারবার বলেছেন কাউকে অনুকরণ না করে নিজের মতো করে চরিত্রটা গড়ে তুলতে। কোথাও সংশোধন করার থাকলে উনি করবেন। বলেছেন, প্রত্যেক অভিনেতার ম্যানারিজ়ম আলাদা। তাই কাউকে নকল করতে গেলে সেটা আমার সঙ্গে মানানসই নাও হতে পারে। তার চেয়ে বইয়ের ফেলুদাকে দেখে সেই মতো কাজটা করা দরকার। আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন অভিনয়ের জায়গায়। আমিও বইয়ের ফেলুদাকে অনুসরণ করেই নিজেকে প্রস্তুত করেছি।
‘হত্যাপুরী’তে অভিজিৎ গুহ (জটায়ু) ও আয়ুশ দাশের (তোপসে) সঙ্গে
বর্তমানে ফেলুদার গল্পগুলোকে নিয়ে কাজ করার সময় দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হচ্ছে। ‘হত্যাপুরী’র ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা কতটা প্রযোজ্য হয়েছে?
ইন্দ্রনীল: এটা ঠিক যে অনেকসময় একটা গল্পকে সময়োপযোগী করে তুলতে নানারকম পরিবর্তন প্রয়োজন হয়। তবে আমি ‘হত্যাপুরী’কে সেভাবে দেখি না। বরং এটাকে আমি মূল গল্পের সিনেমা সংস্করণ বলেই মনে করি। গল্পকে আধুনিক যুগে আনতে যেটুকু প্রয়োজন ছিল, তার বেশি কোথাও এতটুকু পরিবর্তন করা হয়নি। আমি গর্বিত, আমি সেলুলয়েডে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছি। সিনেমার ফেলুদা আমিই। স্বয়ং লেখক সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় আমাকে বেছে নিয়েছেন। অর্থাৎ আমি রায় পরিবারের পছন্দের ফেলুদা। এটা একটা আলাদা অনুভূতি। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ফেলুদার বিভিন্ন সংস্করণ সকলেই দেখছেন। প্রত্যেকে তাঁদের নিজেদের মতো করে ফেলুদাকে পর্দায় নিয়ে আসছেন। তবে আমাকে যদি অপশন দেওয়া হয় আমি সবসময়ই বাবুদাকে বেছে নেব। কারণ সিনেমার ফেলুদা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাইতে পারতাম আমি!
আরও পড়ুন: রোড ট্রিপে বন্ধুত্বের গল্প
যারা ফেলুদা পড়েনি বা ‘হত্যাপুরী’ ছবি দিয়েই যারা প্রথম ফেলুদাকে চিনবে, তারা কেন ছবিটা দেখবে বলে মনে হয়?
ইন্দ্রনীল: ফেলুদা চরিত্রটাকে না চিনলেও যেহেতু এই গল্পটা হুডানইট গোত্রের, এবং এটা একটি হত্যা রহস্য, তাই ভারতীয় দর্শককে এই ছবিটি আকর্ষণ করবেই। ভারতীয় দর্শক থ্রিলার দেখতে পছন্দ করেন। পর্দায় গল্পের সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকও ভাবতে থাকেন, অপরাধী কে। ফেলুদার গল্প শুরু থেকেই সেই ভাবনাটার সুযোগ দেয়। আমি চরিত্র এবং গল্পের সরলতা পছন্দ করি। সাসপেন্স কাহিনির সার্থকতা তখনই যখন দর্শকও গল্পের চরিত্রের সঙ্গে অপরাধী খুঁজতে থাকে। এটাই রহস্য গল্পের সবচেয়ে বড় ইউএসপি। আর চরিত্রের কথা বললে ফেলুদা নিজেই একজন ভীষণ ইন্টারেস্টিং মানুষ। বুদ্ধিমান, স্মার্ট বাঙালি, সঙ্গে স্টাইলিশও। তবে তার মধ্যে কোনও লোকদেখানো ব্যাপার নেই। ফেলুদার নানা বিষয়ে এত পড়াশোনা, অথচ তার জন্য কোনও ওপরচালাকি নেই। নায়ক হলেও চরিত্রটা নায়কোচিত নয়, বরং নিজের দাদার মতো। এটাই ফেলুদাকে ভালো লাগার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয়।
আরও পড়ুন: রহস্য থ্রিলারে গৌরব, ঋত্বিকা
ছোটদের জন্য লেখা হলেও ফেলুদার চরিত্রের একটা আলাদা গভীরতা আছে। সেটা বুঝতে কতটা সময় লেগেছিল?
ইন্দ্রনীল: যে কোনও চরিত্রের ক্ষেত্রেই বলা যায় যে যতবার সেই ভূমিকায় কাজ করব, ততই চরিত্রের সূক্ষ্ম দিকগুলো আমাদের চোখে ধরা পড়বে। ফেলুদা আইকনিক চরিত্র। একে সঠিকভাবে বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। আমি একশোটা ছবি করলেও সবসময় আশা করব পরের ছবিটা আগেরটার চেয়ে ভালো হোক। সেরকমই এই চরিত্রটাও বারবার করলে আরও ভালো হবে।
‘হত্যাপুরী’ ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে বলে মনে হয়?
ইন্দ্রনীল: ওটিটিতে ছবিটা মুক্তির ব্যাপারে আমি খুবই আশাবাদী। থিয়েটারে মুক্তির সময় ছবিটা নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা দেখেছি। সেই সময় অনেকগুলো প্রেক্ষাগৃহে গিয়েছিলাম। দর্শক আমার নাম ধরে ডেকে আমার সঙ্গে এসে কথা বলেছেন, ছবি তুলেছেন। কোনও ধাক্কাধাক্কি নেই, অসভ্যতা নেই। যারা ফেলুদার ছবি দেখতে আসেন, তারা সকলেই খুব পরিশীলিত ও ভদ্র। ফেলুদা চরিত্রটাই এমন দর্শকের জন্ম দিয়েছে। আমি সত্যিই মুগ্ধ দর্শকদের ভালোবাসা পেয়ে। একইভাবে ওটিটিতেও ছবিটা আরও বেশি মানুষ দেখবেন ও সকলের ভালো লাগবে বলে আমি আশা রাখি।
সন্দীপ রায়ের সঙ্গে
বাবুদার সঙ্গে প্রথমবার কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? সত্যজিৎ সম্পর্কে কোনও আলোচনা হয়েছে ওঁর সঙ্গে?
ইন্দ্রনীল: বাবুদার মতো এত ভদ্র ও সৎ মানুষ আমি সত্যি আগে দেখিনি। আমার পরিচালক বলে বলছি না, পরিচালনার বাইরেও উনি ভীষণ ভালো একজন মানুষ। সকলের সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার আমি আর কোনও শুটিং ইউনিটে কোনও পরিচালককে করতে দেখিনি। শুধু বাবুদা নন, বুনিদি (ললিতা রায়), ওঁর ছেলে সৌরদীপ সকলেই এত ভালো ব্যবহার করেন, উল্টোদিকের মানুষকে এতটা সম্মান দেন ভাবা যায় না। একদিন একটা শটের পর একটা রিটেকের দরকার ছিল। বাবুদা আমাকে বললেন, সরি এটা আর একবার করতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি সরি বলছেন কেন! উনি বললেন, ক্যামেরা পজ়িশন ঠিক ছিল না, তাই আর একবার শটটা নিতে হবে। আমি তো শুনেই হাসতে শুরু করে দিয়েছি। আমার অভিনয় জীবনে আমি কোনও পরিচালককে কখনও সরি বলতে শুনিনি। বাবুদা এরকমই মানুষ। উনি আমাকে ফেলুদা চরিত্রের সঙ্গে-সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মমেকিং নিয়েও নানা গল্প শোনাতেন। ওই বাড়িতে এবং ওঁর ঘরে যাওয়া সত্যি একটা আলাদাই অনুভূতি। আমি ওঁর সংগ্রহের বই দেখেছি। আর হ্যাঁ, অস্কারটাও ছুঁয়ে দেখেছি। এগুলো সত্যি কোনওদিন ভোলার নয়।
ছবি: RBN আর্কাইভ