“ম্যাকবেথের চরিত্রে এক কথায় হ্যাঁ বলে দিয়েছি”

বেশিরভাগ ছবিতে দর্শক তাঁকে যে ধরনের চরিত্রে দেখতে অভ্যস্ত, ইদানিং কিছুটা সচেতনভাবেই সেই ইমেজ থেকে সরে আসছেন অভিনেতা গৌরব চক্রবর্তী। ‘পরিণীতা’, ‘বিসমিল্লাহ’, ‘আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা’র মতো ছবিতে ধূসর চরিত্রে অভিনয় করার পর এবার তাঁকে দেখা যাবে ম্যাকবেথের ভূমিকায়। প্রথম প্রকাশের ঠিক ৪০০ বছর পর, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটক অবলম্বনে রাজর্ষি দে’র ‘মায়া’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন গৌরব। গত চার শতক ধরে কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া চরিত্রে অভিনয়, নিজের কেরিয়ার ও পরিবার নিয়ে রেডিওবাংলানেট-এর সঙ্গে আড্ডা দিলেন গৌরব 

ইদানিং বেশ কিছু ছবিতে তোমাকে নেগেটিভ চরিত্রে দেখা যাচ্ছে। নিজের অন্য একটা ইমেজ তৈরি করা, এটা কি সচেতন সিদ্ধান্ত? 

গৌরব: নেগেটিভ চরিত্রে কাজ কিন্তু শুরু থেকেই করে এসেছি। আমার প্রথম কাজ টেলিভিশনে, ‘গানের ওপারে’ দিয়ে। সেই ধারাবাহিকে আমার চরিত্র প্রদীপ্ত ছিল খুব শিক্ষিত এবং ভীষণ ভদ্র একটি ছেলে। এর ঠিক পরের ধারাবাহিক ছিল ওই একই প্রোডাকশনের ‘অদ্বিতীয়া’। সেখানে ইন্দ্রাশিস (রায়) আর সোহিনী (সরকার) ছিল মূল চরিত্রে। আমি ছিলাম নেগেটিভ চরিত্রে। এরকম কিছু কাজ শুরু থেকেই এসেছে। তবে হ্যাঁ, আমাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব ভালো, ভদ্র, শিক্ষিত, বিদেশ থেকে আসা চরিত্র দিয়ে দেওয়া হয়। ভালোমানুষের চরিত্র করতে পারা নিশ্চয়ই ভালো কথা। কিন্তু পরপর করতে-করতে একসময় ক্লান্তি এসে যায়। আর নেগেটিভ চরিত্রে কাজ করার মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমি সেই চ্যালেঞ্জটা নিতে ভালোবাসি। বিশেষ কোনও ইমেজে নিজেকে বেঁধে রাখার ইচ্ছে আমার নেই। 



‘মায়া’তে মাইকেল চরিত্র তো কিছুটা নেগেটিভই

গৌরব: না, ঠিক নেগেটিভ নয়। এই মাইকেল নামের ছেলেটি অনেক কুকর্ম করে বেড়ায়। তবু একে সেই অর্থে শুধু নেগেটিভ বলা যাবে না। এই চরিত্রটায় এতরকম শেড আছে, নিজেকে ভাঙার এত সুযোগ রয়েছে যে আমি শুনেই রাজি হয়ে গেছিলাম। মাইকেল কিন্তু মানুষ হিসেবে খারাপ নয়, শুধু ওর জীবনটা অন্যরকম। তাই শুধু নেগেটিভ চরিত্র বললে ভুল হবে। 

ম্যাকবেথ অত্যন্ত জটিল একটা চরিত্র। কীভাবে প্রস্তুতি নিলে? 

গৌরব: প্রথমত চিত্রনাট্য পড়ে বারবার চরিত্রটাকে বুঝতে চেয়েছি। যে প্রেক্ষাপটে এই ছবিটা সেখানে মাইকেল একজন হিন্দিভাষী। সে অনাথ। তাকে যারা মানুষ করেছে তারা অবাঙালি। কাজেই তার বাংলা বলায় একটা টান আছে, আর সেই বলাটা যেন ক্যারিকেচার না হয়ে যায়, এটা খেয়াল রাখতে হয়েছিল। একজন গুন্ডা মাইকেলকে মানুষ করেছে। সে তার ডানহাত। ভেতর থেকে এই ছেলেটি কিন্তু খুব একটা খারাপ মানুষ নয়। তবে ওর পজ়িটিভ দিকগুলো বেরিয়ে আসে না, সেগুলো ওর থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। তাই এই ছেলেটির হাঁটাচলা বা শরীরী ভাষায় একটা প্রচণ্ড ঔদ্ধত্য রয়েছে। মাইকেল হয়ে ওঠার জন্য প্রচুর হোমওয়ার্ক করেছি। চেষ্টা করেছি আমার তরফ থেকে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। 

আরও পড়ুন: “প্রতিটি আঞ্চলিক সিনেমার শিকড় কোথায় আমি জানি”

কোনও অভিনেতার কাজ কি রেফারেন্স হিসেবে ছিল?

গৌরব: না। মাইকেলের ক্ষেত্রে আমি কাউকেই অনুসরণ করিনি। সেটা করতে গেলে লোকে বুঝে যেত। এত মহান অভিনেতারা ম্যাকবেথ করেছেন যে কাউকে দেখে করতে গেলেই লোকে ধরে ফেলত। যদি ‘মকবুল’ দেখে সেরকম করতে চাইতাম লোকে এক মিনিটে বলে দিত। বলত, এ তো ইরফান খানকে নকল করছে। উনি অন্য মাপের অভিনেতা। আমি নিজের মতো করে চরিত্রটাকে বুঝতে চেয়েছি। 

এক কথায় হ্যাঁ

এরকম এক কিংবদন্তি চরিত্রে অভিনয় করা নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল? কোনও বিশেষ পরামর্শ দিয়েছিলেন কি বেনুদা (সব্যসাচী চক্রবর্তী)? 

গৌরব: বাবার সঙ্গে কাজ নিয়ে একেবারেই কথা হয় না। বাবা সবসময় বলেন, যা করবে নিজে করবে। যাতে ভালো হলে কৃতিত্বটা তোমার হয়, আর খারাপ হলেও তোমাকেই সেটা শুনতে হবে। বাবা হয়তো আমার ছবিটা দেখবেন। তবে অভিনয় নিয়ে পরামর্শ কখনও দেন না। ইদানিং বাবা প্রায়ই বলেন, এত কাজ করতে আর ভালো লাগছে না। এখন তোমাদের বয়স, তোমরা প্রচুর কাজ করো। আমি আমার সময়ে অনেক করেছি। এখন তেমন কোনও ভালো চরিত্র পেলে তবেই করব নাহলে নয়। তার চেয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ভালো। তবে এতবছর অভিনয় করার পর আমার মনে হয় যে কোনও অভিনেতার কাছে এই স্বাধীনতাটুকু থাকাই উচিত যে ইচ্ছে হলে তবেই সে কাজ করব। 

কিছুদিন আগে শোনা গিয়েছিল বেনুদা অবসর নেবেন, যদিও সেটা সত্যি ছিল না। অভিনেতার কি সত্যিই কোনও অবসর জীবন হয় বলে মনে হয়? 

গৌরব: না। তার সবথেকে বড় উদাহরণ অমিতাভ বচ্চন আর আমাদের এখানে বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)। বাবা অবসর নিতে চাননি, কাজ কমিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেটা হয়তো এই বয়সে কিছুটা সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে উনি আজকাল থেকে থেকেই বয়স হয়ে গেছে, আর এখন অভিনয় করতে ভালো লাগে না, দাঁড়িয়ে থাকলে কোমর ব্যথা করে, এইসব অজুহাত দেন সেগুলো মোটেও ঠিক নয়। বাবা এখনও আমাদের থেকে অনেক বেশি ফিট। এত তাড়াতাড়ি একেবারে সব ছেড়ে দেওয়াও কোনও কাজের কথা নয়। 

আরও পড়ুন: ‘মাসুম’-এর সিক্যুয়েল করবেন শেখর?

তোমার পরিবারে তো প্রায় সকলেই অভিনেতা। সবাই এক জায়গায় হলে নিজেদের কাজ নিয়ে কথা হয়? অর্জুন (ভাই) আর তুমি সমসাময়িক এবং দুজনেই মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করো। ওর সঙ্গে অভিনয় নিয়ে আলোচনা হয়? 

গৌরব: অর্জুন আমার থেকে তিন বছরের ছোট। আমরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু। এমন বহুবার হয়েছে যে ওকে শোনানো কোনও চরিত্রে আমি কাজ করেছি আবার আমি যেটা করতে চাইনি সেটা হয়তো ও করেছে। সপ্তাহে একবার আমরা বাড়ির সকলে এক হই। একসঙ্গে সন্ধ্যেটা কাটাই, ডিনার করি। সেখানে কাজের কথা একেবারেই হয় না। বরং ভাইয়ের মেয়ে কতটা দুষ্টু হলো, কাকে পিটিয়ে এল, নতুন কী শিখল এসব নিয়েই সবাই মেতে থাকি। 

এরপর তো বাড়িতে আর একজন নতুন অতিথি আসছে, তার জন্য তোমাকে আর ঋদ্ধিমাকে (ঘোষ, স্ত্রী) অভিনন্দন

গৌরব: ধন্যবাদ। হ্যাঁ নতুন একজন আসতে চলেছে। সেই নিয়ে আমি নিজেও যেমন এক্সাইটেড, বাড়ির সকলেও তাই। কাজেই সকলের দেখা হলে নিজেদের নিয়েই আড্ডা হয়। 



সায়ন্তন ঘোষালের শার্লক হোমসকে নিয়ে ছবিতে তুমি অভিনয় করছ। তুমি নিজে একসময় ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলে। একই চরিত্রে একাধিক ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি চলতে থাকলে কি চরিত্রটার ক্ষতি হয় না?

গৌরব: প্রথমেই বলি আমি হোমসের চরিত্র করছি না, ওটা ঋষভ (বসু) করছে। ‘দ্য হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’ অবলম্বনে ছবিটা হচ্ছে। আমি সেখানে হেনরি বাস্কারভিলের আদলে যে চরিত্র সেটা করছি। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে একই বিখ্যাত চরিত্রে বারবার অভিনেতা বদল করলে দর্শক কিছুটা বিভ্রান্ত হন। তারা বুঝে উঠতে পারেন না, সেই চরিত্রে কাকে ভাববেন। যেমন একটা সময়ে ফেলুদা বলতে শুধুই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। তার অনেকদিন পর আমার বাবা করলেন। তারপর অনেকেই করেছেন।

ফেলুদার চরিত্রে কাজ করার প্রস্তাব এলে করতে?

গৌরব: না। তার দুটো কারণ। এক, বাবা করেছেন তাই আমার করার প্রশ্নই ওঠে না। আর দুই, আমার ফেলুদা হওয়ার মতো শারীরিক উচ্চতা নেই। স্বয়ং লেখক যেখানে ফেলুদার উচ্চতা বলে দিয়ে গেছেন, সেখানে অন্য কেউ আসতে পারে না। তবে এখানে অন্য একটা ব্যাপারও আছে। অনেকেই একই গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে কাজ করছেন। দর্শক ভালোবাসে বলেই করছেন। কিছুদিন আগে পরমদা (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) একটা সিরিজ়ে ফেলুদার চরিত্র করেছে যেটা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে দেখেছি। তবে এটা অনেকেই জানেন না যে ওই চ্যানেলে সাম্প্রতিক সময়ে ওই সিরিজ়ের ভিউয়ারশিপ সবথেকে বেশি ছিল! দর্শক যদি সিরিজ় দেখেন, সিনেমা দেখেন, তাহলে নির্মাতারা বানাবেন না কেন? আসল কথা হলো দর্শক দেখছে কিনা। আর একজন অভিনেতা কী করে এই লোভ সংবরণ করবেন সেটাও তো ভাবতে হবে। আজ আমার কাছে ম্যাকবেথের চরিত্র এসেছে বলে আমি এক কথায় হ্যাঁ বলেছি। যখন ব্যোমকেশের অফার এসেছিল তখন শুধু সিনেমায় ব্যোমকেশ হচ্ছিল। কাজেই আলাদা মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনে চরিত্রটা করতে আমার আপত্তি হয়নি। এরকম একটা কিংবদন্তি চরিত্রের প্রস্তাবে না বলা কি সহজ কথা! একজন অভিনেতার তো ভালো চরিত্রের খিদে থাকবেই। তাঁর কাছে তেমন কোনও চরিত্র এলে তিনি কেন না বলবেন? তাই এখানে দোষটা কারও একার তো নয়। যদি দর্শক না দেখেন তাহলে হয়তো এই ধরনের কাজগুলো আর হবেই না। তবে বর্তমানে অবস্থাটা সেরকম একেবারেই নয়। প্রচুর দর্শক এই কাজগুলো দেখছেন। তাহলে তো না হওয়ার কোনও কারণ নেই। 

ছবি: RBN আর্কাইভ




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *