ভাঁড়ে পরিণত হলো টেনিদা
ছবি: টেনিদা অ্যান্ড কোম্পানি
পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল
অভিনয়ে: কাঞ্চন মল্লিক, গৌরব চক্রবর্তী, সৌমেন্দ্র ভট্টাচার্য, সৌরভ সাহা, ঋদ্ধিমা ঘোষ, সব্যসাচী চক্রবর্তী, মিঠু চক্রবর্তী, অরিন্দল বাগচী, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট
RBN রেটিং ★★★☆☆☆☆☆☆☆
‘ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক ইয়াক’। পটলডাঙার বিখ্যাত চারমূর্তির এই স্লোগান জানে না এমন বাঙালি সংখ্যায় কম। ক্যাবলা, হাবুল, টেনিদা আর পেটরোগা প্যালারামের কাহিনি যারা পড়েছেন তাদের ছেলেবেলা একদম ‘ইয়াক ইয়াক’ করে কেটেছে বলা যায়। আর যারা পড়েননি, তাদের জন্যই বোধহয় সায়ন্তন ছবি করেন। যেখানে টেনিদা নয়, ক্যাবলাই আসল হিরো। এরকম গল্প তো নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লেখেননি। সায়ন্তনের নতুন ছবি ‘টেনিদা অ্যান্ড কোম্পানি’ কোনওভাবেই সেই টেনিদার নস্টালজিয়া ছুঁতে পারল না, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন যেন ক্যাবলা-কেন্দ্রিক হয়ে রইল।
মূল গল্পে চারজন ছিল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সায়ন্তনের এই ছবিতে তারা সবাই কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। প্যালা (সৌমেন্দ্র) সাহিত্যিক, হাবুল (সৌরভ) এক বিমা কোম্পানির চাকুরে, ক্যাবলা (গৌরব) গবেষক আর টেনি (কাঞ্চন) এখনও পাড়ার লিডার হয়েই রয়েছে। স্কুলের ফার্স্টবয় ক্যাবলা এখানেও বছরের পর বছর একটা করে থিসিস লেখে আর খবরের কাগজে তার নাম বেরোয়। এমতাবস্থায় হঠাৎই ক্যাবলার প্রস্তাবে সবাই মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যায়। সেখানে পৌঁছনোর পর থেকেই শুরু হয় রহস্যময় কাণ্ডকারখানা। নীলপাহাড়ি নামক এক জায়গার ঝাউবাংলোতে থাকেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাতকড়ি সাঁতরা (সব্যসাচী)। তার মেয়ে অন্বেষা (ঋদ্ধিমা) হঠাৎই দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর সেই বাড়িতে শুরু হয় ভুতুড়ে কাণ্ড। ওদিকে জাপানি সন্ত্রাসবাদি কাগামাছির দল সাঁতরামশাইকে গুম করে তার এক ফর্মুলার জন্য।
আরও পড়ুন: এবার তন্ত্র নিয়ে ভূতের ছবি
এতদূর শুনে অনেকেরই হয়তো মনে হতে পারে গল্প জমে গেছে এবং তা উপন্যাসভিত্তিক। একেবারেই তা নয়। এখানে সবুজ দাড়ি নেই। চকোলেটের মোড়কে ছুঁড়ে দেওয়া চিরকুটের বদলে ঝুমুরলাল হোয়াটস্যাপ করেন। সবথেকে বড় কথা, মজাদার সাঁতরা ওরফে পুণ্ডরিক কুণ্ডু সম্পূর্ণ বেপাত্তা। পরিবর্তে সাঁতরামশাইয়ের এখানে ডবল রোল। একজন আসল সাঁতরা যিনি বৈজ্ঞানিক, অন্যজন তার যমজভাই নকল সাঁতরা ওরফে নকড়ি সাঁতরা, যিনি এক দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল। নকড়িকে পুলিশ খুঁজছে কিন্তু ধরছে না। দিনের পর দিন কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির প্রতারক সেজে থাকা একটি লোককে পুলিশ ধরতে পারছে না, এ কি বিশ্বাসযোগ্য? বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করলেই তো তাকে ধরা যায়। অতঃপর গোটা ছবিটাই টেনিদার ভাষায় আস্ত ‘পুঁদিচ্চেরি’।
আরও পড়ুন: ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায় শিলাজিৎ
অভিনয় এ ছবির অন্যতম দুর্বল দিক। টেনিদা মানেই সে সারাদিন শুধু গোগ্রাসে খায় আর গুল দিয়ে বেড়ায় তা নয়। নারায়ণের টেনিদা ডানপিটে, ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারী। সে ছ’ হাত লম্বা। তার মৈনাক পর্বতের মতো নাক, পেল্লায় পেটানো চেহারা। গড়ের মাঠে সার্জেন্ট পিটিয়ে টেনিদা রীতিমত বিখ্যাত। মাঝেমাঝে সে গুল দেয় বটে তবে সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য। এরকম মারাত্মক গুলবাজ বাংলা সাহিত্যে আর একজনই আছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা। মোদ্দা কথা, টেনিদা রসিক। অথচ সায়ন্তনের কল্যাণে টেনিদা ভাঁড়ে পরিণত হলো। গোটা ছবিজুড়ে ভাঁড়ামো করে গেলেন কাঞ্চন। সাড়ে চার দশক আগে মুক্তি পাওয়া ‘চারমূর্তি’ ছবিতে টেনিদার চরিত্রে চিণ্ময় রায়কে যে খুব মানিয়েছিল তা বলা যায় না। তবু চিণ্ময় উৎরে দিতে পেরেছিলেন। তার একটা বড় কারণ ছিল রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত, শম্ভু ভট্টাচার্যের মতো কয়েকজন দাপুটে অভিনেতার উপস্থিতি।
আরও পড়ুন: ‘আপনজন’ সামলে কি ভালোবাসায় জড়ানো উচিত?
এই ছবিতে প্যালা ও হাবুল থেকেও নেই। ‘ঝাউবাংলো রহস্য’ টেনিদার অন্যতম সেরা কাহিনি। একের পর এক কবিতার রহস্যের উন্মোচন এবং অ্যাডভেঞ্চার ছবিতে নেই। প্যালা ও হাবুলের বিভিন্ন মজাদার কাণ্ডকারখানার কিছুই পাওয়া গেল না। গৌরবকে ক্যাবলা কম, গোয়েন্দা বেশি মনে হয়েছে। সব্যসাচীর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। সেই তিনি এই ছবিতে এত খারাপ অভিনয় কী করে করলেন, প্রশ্ন থেকে যায়। মিঠু, ঋদ্ধিমা কেন ছিলেন বোঝা গেল না।
প্রেক্ষাগৃহে বসে মনে হচ্ছিল, কেন দেখছি এই ছবি? এ তো ছেলেবেলার স্মৃতি ধ্বংস হওয়ার মুখে!
কদম্ব পাকড়াশি এখানে পুলিশ ইনভেস্টিগেটর। ঝুমুরলাল চৌবে চক্রবর্তী হলো নকল সাঁতরার সহকারী। এসবের কোনও দরকার ছিল কি? পরাণ এখানে পটলডাঙার পুরনো বাসিন্দা। অত্যন্ত জড়ানো গলায়, মুখ বেঁকিয়ে তিনি ঠিক কী সংলাপ বললেন তা বুঝতে সময় লাগছিল। মূল গল্পে যেখানে একের পর এক থ্রিলিং সিকোয়েন্সে ভর্তি, সেখানে চিত্রনাট্যকার সৌগত বসু নতুন উপাদান কেন ঢোকালেন বোঝা গেল না।
আরও পড়ুন: টেলিভিশনে প্রবল অনীহা ছিল বাবার, মৃণাল সেনের স্মৃতিচারণে পুত্র কুণাল
ছবির সিনেমাটোগ্রাফিও তথৈবচ। দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্যকে সেভাবে ধরতেই পারলেন না রম্যদীপ সাহা। টাইগার হিলে ভিড়ে গুঁতোগুঁতি করে চারমূর্তির সূর্যোদয় দেখার দৃশ্যটি সাংঘাতিক ম্যাড়ম্যাড়ে। তাই ঝুমুরলালের লাইন ধার করে বলা যায়
নতুন ছবি টেনিদা অ্যান্ড কোম্পানি,
ছেলেবেলার পক্ষে খুবই হানি।
এই ছবির প্রতিটি সিন,
নেইকো মাথা, মুন্ডু, শিং।
প্যালা, হাবুল, টেনিদা ভোঁদা,
ক্যাবলাই এখানে পালের গোদা।
নড়ে না হেথায় সবুজ দাড়ি,
বিরক্তিতে হবে মুখটি হাঁড়ি।
যারা বাংলা সাহিত্য তথা টেনিদা পড়ে বড় হয়েছেন, তারা নিজ দায়িত্বে এ ছবি দেখতেই পারেন। তবে বর্তমান প্রজন্মের যারা টেনিদার গল্প পড়েনি, তাদের ভালো লাগতেও পারে। হয়তো চারমূর্তিকে ঘিরে এক অন্য ধারণা তৈরি হবে। আসলে বাংলা সাহিত্যের কিছু চরিত্র বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকাই বাঞ্ছনীয়, এ কথা ইদানিং বারবার মনে হচ্ছে। বাইরে এলেই ব্যাপারটা কেমন যেন মেফিস্টোফিলিস হয়ে যায়।