রোহিত-শ্রীময়ীর বিয়ে, কেন মানতে পারছেন না দর্শকদের একাংশ?
অবশেষে চার হাত এক হতে চলেছে। অনেক জল্পনার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছেন তারা। তবে এই বিয়ে নিয়ে তাদের চেয়েও বেশি চিন্তিত বাংলার টেলিদর্শকের একাংশ। যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে তাদের বিয়ে করা উচিত কিনা, এই প্রশ্নে গত একমাস ধরে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়। উচিত নয়, কারণ পাত্রীর নাম শ্রীময়ী সেনগুপ্ত ও পাত্রের নাম রোহিত সেন। আবার উচিতও সেই একই কারণে। শ্রীময়ী অনিন্দ্য সেনগুপ্তর প্রাক্তন স্ত্রী ও তিন সন্তানের মা বলেই সম্ভবত এত কথা উঠছে। এতদিন তার একটা সংসার ছিল, ছেলেমেয়ের দায়িত্ব ছিল, শ্বশুরবাড়ির প্রতি কর্তব্য ছিল। কিন্তু মধ্যবয়সে এসে যখন অনিন্দ্যও বহুদিন হলো তার পাশ থেকে সরে গেছে, তখন শ্রীময়ী তার পুরোনো ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধতে চাইতেই পারে। কিন্তু এক মধ্যবয়স্কা মহিলা, যার ছেলেমেয়েরাও বিবাহিত তিনি কি নিজের বিয়ের কথা ভাবতে পারেন?
একদল বলছেন কেন নয়? শ্রীময়ী তার সারাজীবন পরিবারকে দিয়েছে, প্রতিদানে সে কিছুই পায়নি। নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার তার যথেষ্ট অধিকার আছে। আর একদল বলছেন ধারাবাহিকে এইসব দেখানো হলে ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই বয়সে এসে শ্রীময়ীর বিয়ে করার দরকার পড়ল কেন? এর সঙ্গে রয়েছে আরও একদল যাদের বক্তব্য, একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে কি এতই প্রয়োজনীয়? শ্রীময়ী কি একা থাকতে পারত না? কেন তার জীবনে রোহিতকে প্রয়োজন?
আরও পড়ুন: রেগে আগুন কমল মিত্র, সুবিধা হলো সত্যজিতের
রোহিত-শ্রীময়ীর বিয়ে নিয়ে তর্কটা এই ধারাবাহিকে সীমাবদ্ধ হলেও এর প্রেক্ষিত অনেকটা বিস্তৃত। প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখার সময় সমাপ্তিতে হ্যাপি এন্ডিং দেখতে চান প্রায় সকলেই। সেখানে কেউ নীতিপুলিশি করতে যান না। পঞ্চাশ বছর বয়সেও যদি নায়ক নায়িকার মিলন হয়, দর্শক খুশি মনে বাড়ি ফিরে আসেন। অন্যদিকে মেগাধারাবাহিক অনেকটাই মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই যাকে প্রতিনিয়ত হাসতে, কাঁদতে ও কষ্ট পেয়েও সহ্য করতে দেখা যায়, সে হঠাৎ অবস্থান পাল্টালে তা মেনে নেওয়া মুশকিল। তখনই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে, কেন একজন মা দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইবেন, কেন তিনি তার সংসারের দায়দায়িত্ব নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন না?
‘শ্রীময়ী’র কাহিনী বাঙালির প্রচলিত সমাজব্যবস্থার খুঁটিকে যে বেশ কিছুটা নাড়িয়ে দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরুষমানুষ ভুল করতেই পারে, নিতেই পারে কোনও সাহসী পদক্ষেপ। তার জন্য তাকে ঘৃণা করা যায় বা এড়িয়ে চলা যায়। কিন্তু কোনও নারী যদি সেই একই কাজ করে তখনই তার ওপর নেমে আসে সামাজিক নিয়মকানুনের খড়্গ। আর সেই নারী যদি মা হন তাহলে তার ওপর দেবীত্ব আরোপ করে তাকে মহান সাজাতে ভালোবাসেন অধিকাংশ নারীপুরুষ। সংসারের বাইরে মায়ের কোন আলাদা অস্তিত্ব মেনে নিতে তার ছেলেমেয়েরা এখনও নারাজ। তথাকথিত আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরাও এখনও মাকে একজন ইচ্ছা অনিচ্ছায় মোড়া স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে মেনে নিতে পারে না।
আরও পড়ুন: শেষের সেদিন, উপস্থিত ছিলেন শুধু মহেশ ও ড্যানি
বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন ‘শ্রীময়ী’র কাহিনীকার লীনা গঙ্গোপাধ্যায়?
“দর্শক নানাভাবে তাঁদের ইচ্ছা জানাতেই পারেন। কিন্তু দিনের শেষে আমার নিজের কাছে যেটা যুক্তিগ্রাহ্য, যেটা আমার ঠিক মনে হবে আমি সেটাই করব,” রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন লীনা।
কোনও ধারাবাহিকের ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্ত কেউ তাঁর ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি করেননি বলে জানালেন লীনা। টিআরপি নেমে গেল সেটা নিয়ে আলোচনায় বসতেই হয়। তবে সেখানেও লেখকই ঠিক করেন গল্প কোনদিকে যাবে।
“’শ্রীময়ী’র ক্ষেত্রে বলতে পারি আমি তো সমাজ সংস্কারক নই। তাই মানুষ কী ভাববে বা তাঁদের এই ব্যাপারটা কীভাবে নেওয়া উচিত সেটা বোঝা আমার কাজ নয়,” বললেন লীনা। “তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেকসময় মানুষ নানারকম চাপে পড়ে, বিভিন্ন অপ্রাপ্তিজনিত কারণে আর একজনের জীবনে অন্যরকম কিছু হওয়াটা মেনে নিতে পারেন না। আমি যা পাইনি তা আর একজন কেন পাবে, এটা মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ সময় ঘটে থাকে। আবার উল্টোটাও কিন্তু সত্যি। আমি পাইনি বলেই আরও বেশি করে চাইব আর একজনের জীবনে সেটা ঘটুক, এমন চাওয়ার মতো মহিলাও অনেক আছেন। আর নতুন কোন পদক্ষেপ যেটা আগে নেওয়া হয়নি সেটা নিতে গেলে কিছু মানুষ তার প্রতিবাদ করবেনই। এটাই স্বাভাবিক। যে কোনও কাজের ক্ষেত্রে সততাই শেষ কথা। আমি সেটাই মাথায় রাখি। এমনও অনেক উদাহরণ আছে যেখানে ছেলেমেয়েরা বিবাহবিচ্ছিন্না মায়ের বিয়ে দিচ্ছে। তাহলে সেই উদাহরণটা তুলে আনব না কেন?”
কিন্তু এই একবিংশ শতকেও একজন নায়কের বিয়ের সংখ্যা গোনা হয় না। অথচ নায়িকা কতগুলো বিয়ে করলেন তাই নিয়ে মানুষ এখনও ট্রোল করতে ছাড়েন না। শ্রীময়ীর ঘুরে দাঁড়ানো কি সেই দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে সাহায্য করবে? “টেলিভিশন অবশ্যই একটা শক্তিশালী মাধ্যম” স্বীকার করলেন লীনা। “তাই সমাজের ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা তো তার থাকেই। যদি শ্রীময়ীকে সুখী হতে দেখলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টায়, হয়তো কেউ ভাবতে পারে সেদিন সিদ্ধান্তটা অন্যরকম নিতে পারতাম। এভাবে হয়তো কোনও বদল আসবে। তবে বিয়ে যে একমাত্র সমাধান নয় সেটাও অবশ্যই ঠিক। কেউ একা জীবন কাটাতে ভালোবাসেন, কেউ কারও সঙ্গে থাকতে চান। এটা তো তাঁর নিজের ইচ্ছা। ভালো থাকার তো কোনও সংজ্ঞা হয় না। শ্রীময়ী এটাই বেছে নিয়েছে। এর কোনও ঠিক বা ভুল হয় না। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাটাই বড় কথা,” বললেন লীনা।
আরও পড়ুন: ৩২ বছরের ঘটনাক্রমে ম্যাকবেথ গৌরব, রাজ্ঞী তনুশ্রী
এই সময়ে দাঁড়িয়ে শ্রীময়ীর সিদ্ধান্ত ও দর্শকের মতামতকে একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলেন মনস্তাত্বিক উপদেষ্টা জয়তী রায়। শ্রীময়ীর ওপরে যে দেবীত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই থেকেই মানুষ এমনটা ভাবছে বলে মনে করেন তিনি। “এটা কিন্তু পড়ে-পড়ে মার খাওয়ার যুগ নয়। মধ্যবয়সে এসে মানুষের শারীরিক বা মানসিক চাহিদা কমে যায় না। এতদিন শ্রীময়ীর ওপর নানা দায়িত্বের চাপ ছিল। সেসব সামলে সে নিজের দিকে তাকাবার সুযোগ পায়নি। এখন যখন তাকে বাচ্চার পড়াশোনা সামলাতে হচ্ছে না বা স্কুলের পেরেন্ট-টিচার মিটিং-এ ছুটতে হচ্ছে না তখন সে অবসরে বসে নিজের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। সেখান থেকেই সে এই সিদ্ধান্তে আসছে। দর্শক তো তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে দেখছে না। যে ত্যাগ সে এতদিন করে এসেছে তার এখন আর কোনও প্রয়োজন নেই। আর শ্রীময়ী একজন সৎ মানুষ। সে কোন অবৈধ পথে তার ইচ্ছাকে চরিতার্থ করবে না, তাই সে বিয়েটা চাইছে। আসলে মনের দাবিকে মানুষ এখনও স্বীকার করতে পারে না। এই যুগে দাঁড়িয়েও তারা সমাজকে মনের উপরে স্থান দেয়,” বললেন জয়তী।
দর্শকদের মধ্যে যাঁরা শ্রীময়ীর বিয়ের বিরুদ্ধে তাঁদের একটা বড় অংশই মহিলা। এর কারণ হিসেবে জয়তী জানালেন, “শৈশব থেকে মেয়েদের মাথায় এই নীতিবোধের ধারণাগুলো এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার ফলে পুরুষের চোখে নিজেকে সতী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা তারা আদি অনন্তকাল ধরে করে আসছে। বেশিরভাগ মহিলার মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা যায়। এখনও অনেক মহিলা ভাবতে পারেন না যে স্বামী তাঁর শারীরিক চাহিদা মেটাতে অক্ষম বলে তিনি অন্য কারোর কাছে সেটা মেটাবেন। এটা ভারত বলে নয়, বিদেশেও তাই। অথচ পুরুষরা প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে সেই চাহিদা মিটিয়ে নেন কোনও অপরাধবোধ ছাড়াই। মেয়েরা কেউ-কেউ এগিয়ে এলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ব্যাপারটা মেনে নেয়। কারণ মানসিক বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সমাজে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় যৌন স্বাধীনতাকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না।” খিদে তেষ্টা বা ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছার মতো শারীরিক চাহিদাও সমান সত্য। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ যদি মধ্যবয়সে এসে বিয়ে করতে চায় তাহলে তার ইচ্ছাকে সন্মান করা উচিত বলেই মনে করেন জয়তী।