ধাঁধার থেকেও জটিল প্লটে যকের ধন খুঁজলেন সায়ন্তন

ছবি: সোনার কেল্লায় যকের ধন

পরিচালনা: সায়ন্তন ঘোষাল

অভিনয়ে: পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, কোয়েল মল্লিক, গৌরব চক্রবর্তী, সুপ্রভাত দাস, সাহেব চট্টোপাধ্যায়, জ্যামি বন্দ্যোপাধ্যায়, যুধাজিৎ সরকার

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৪ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★☆☆☆☆☆

সোনার কেল্লা, জাতিস্মর, গুপ্তধন এই ফাটাফাটি ত্রিকোণ কম্বিনেশন বাঙালির সবচেয়ে পুরোনো নস্টালজিয়া। সেই নষ্টালজিয়াকেই সুড়সুড়ি দিলেন সায়ন্তন তাঁর ‘সোনার কেল্লায় যকের ধন’ ( Sonar Kellay Jawker Dhan) ছবিতে। ছবি দেখতে বসে ‘সোনার কেল্লা’র মন্দার বোসের একটি সংলাপ মনে পড়ে গেলম, ‘মশাই এরা তো দেখছি যেখানে ফাঁক পেয়েছে একটা করে কেল্লা গুঁজে দিয়েছে!’ সেরকমই সায়ন্তন তার ছবিতে যেখানে পেরেছেন একটি করে জাতিস্মর গুঁজে দিয়েছেন। একা  রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর। কেন এত হেঁয়ালি? তাহলে চলুন এবার ছবির মূল গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক।




সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই শুরু হয়েছে  এই ছবির গল্প। সোনার কেল্লার মুকুল ধর (সুপ্রভাত) এখন প্রাপ্তবয়স্ক। কলেজ স্ট্রিটের বাবার বইয়ের ব্যবসা এখন সে চালাচ্ছে। কিন্তু ছোটবেলার মতই পূর্বজন্মের ঘটনা এখনও তার মনে ভাসে। বিশ্বাস করে রাজস্থানের সোনার কেল্লার ভেতরেই রয়েছে তার পূর্বজন্মের স্মৃতি। সেই স্মৃতিকে যেন বারবার কেউ উসকে দিতে চাইছে, মনে করাতে চাইছে মুকুলের ফেলে আসা ইতিহাস। ছোট ছোট সংকেতের মাধ্যমে বারবার তার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তার পূর্বজন্মের বিভিন্ন সূত্র। বিমল (পরমব্রত), কুমার (গৌরব) এবং ডঃ রুবিকে (কোয়েল) সঙ্গী করে মুকুল ধর পৌঁছে যান তার চেনা পরিচিত সেই পুরনো সোনার কেল্লা, জয়সলমেরে। পুরনো ছবির মত এই ছবিতেও রয়েছে দু’জন দুষ্টু লোক। ফেলুদা জানিয়েছিল সোনার কেল্লায় কোনও গুপ্তধন নেই, কিন্তু মুকুল ধরের বিশ্বাস তার সোনার কেল্লায় রয়েছে পূর্ব জন্মে ফেলে আসা এক পরশপাথর। যার ছোঁয়ায় সোনা হয়ে যায় যে কোন ধাতু। তবে শুধু মুকুল নয়, এই কথা জানে সেই দুষ্টু লোকও যে চায় মুকুলের মাধ্যমে সেই পরশ পাথরের খোঁজ পেতে। অবশেষে পরশপাথর পাওয়া গেল কিনা, সে পরশপাথর সত্যিই সোনা ফলাতে জানে কিনা, আর সেই দুষ্টু লোক ভ্যানিশ হল কিনা এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য দেখতে হবে এই ছবি।

আরও পড়ুন: আব্বুলিশ, টেথোস্কোপ আর তিন খুদের স্বপ্ন

এবার আসা যাক ছবির চিত্রনাট্য প্রসঙ্গে। এককথায় বলতে গেলে ছবির চিত্রনাট্য বড় জটিল। চিত্রনাট্যকার সৌগত বসু ধাঁধাগুলো এমনভাবে একের পর এক সাজিয়েছেন যে মাঝখানের সূত্র হারিয়ে গেছে। ছবির প্রথমার্ধ বেশ ভালো,  টানটান, উপভোগ্য। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার পরেই ঘুরে গেল গল্পের মোড়। ডক্টর রুবির সঙ্গে মুকুলবাবুর পূর্বজন্মের সম্পর্ক গল্পের ভরাডুবি করে ছেড়েছে। ধাঁধায় ধান্যলক্ষ্মীর মন্দিরের উল্লেখ থাকলেও শিবমন্দির থেকে কীভাবে সেখানে যাওয়ার রাস্তা পাওয়া গেল সে সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছবিতে পাওয়া যায়নি। সকলে যখন সুড়ঙ্গে ঢুকলেন তখন বেশ রাত কিন্তু যখন সবসময় থেকে বেরোলেন তখন দিন হয়ে গেল কীভাবে? বলা হয় যারা জাতিস্মর তারা সারা জীবন ধরেই তাদের পূর্বজন্মের কিছু কিছু ইতিহাস মনে করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে রুবির চরিত্রটি গতবার ‘সাগরদ্বীপে যকের ধন’ এবং এই ছবিতে এর আগে কখনোই পূর্বজন্মের কথা মনে করেনি। সেই চরিত্রই এই ছবির শেষ পর্যায়ে যখন গড়গড় করে পূর্বজন্মের সব ঘটনা বলতে আরম্ভ করল তা মেনে নেওয়া বড় কষ্টকর। আবারও মন্দার বোসের সেই মজার সংলাপ মনে পড়বে, ‘শেষকালে দেখবেন ঘরে ঘরে কচি ছেলেরা সব নিজেদের জাতিস্মর বলে ক্লেম করছে’।

ছবির শেষে গিয়ে দর্শকের মনে হতে বাধ্য, শুরু থেকে এত থ্রিল, এত রহস্যের আদপেই কোনও দরকার ছিল কি?  জোর করে এই দৃশ্য, এই রহস্য তৈরি করা হয়েছে। এক লাইনের একটি সামান্য চিত্রনাট্যকে টেনে হিঁচড়ে লম্বা করা হয়েছে ছবিতে। অনেকটা রামায়ণের বালির সঙ্গে সুগ্রীবের যুদ্ধের মত। রাম যদি আগে থেকেই বালির কাছে যেতেন তাহলে যেমন রামায়ণ তৈরি হতো না তেমনই এই ছবিতে প্রথমেই যদি দুষ্টু লোক মুকুলবাবুর কাছে যেত তাহলে এই ছবির গল্প হতো না। চিত্রনাট্যের বাঁধন ভীষণ নড়বড়ে।

আরও পড়ুন: গরমের ছুটি জমিয়ে দেবে টিম একেন

অভিনয়ে সকলেই নিজেদের মতো করে বেশ ভালো। ভালো লাগল এত বছর পরে আবার ছবিতে সেই চেনা পরিচিত সোনার কেল্লা। সত্যজিৎ রায়ের নস্টালজিয়া মাঝেমধ্যেই এদিক সেদিক গুঁজে দিয়েছেন সায়ন্তন। মুকুলের সংলাপে হোলি খেলার কথা, গিরিধারীর বাড়ি, রাজস্থান মে ডাকু হ্যায়, রাজস্থানে  রক্তপাত, মুকুল ধরের রাজস্থানী গান শোনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এত বছর পরেও রাজস্থানের জয়সলমেরের কেল্লা নিয়ে বাঙালির এই নস্টালজিয়া শুধুমাত্র একটি মানুষের জন্যই সম্ভব হয়েছে। আর সেই ছবিই তুলে ধরেছেন সায়ন্তন। চিত্রগ্রহণ প্রশংসনীয়। ছবির আবহ সংগীতে কোথাও যেন ক্ষীণ মিল খুঁজে পাওয়া যায় সোনার কেল্লার বিভিন্ন আবহের। সব মিলিয়ে এই ছবি ছোটদের জন্য উপযুক্ত ও উপভোগ্য। তবে ‘সোনার কেল্লা’র রেফারেন্স না জেনে থাকলে এ ছবি কিন্তু বোধগম্য হবে না। তাই পুরোনো চাল ভাতে বাড়ার মতোই আগে ছোটদের ‘সোনার কেল্লা’ দেখান, তারপর নিয়ে চলুন প্রেক্ষাগৃহে।  




Like
Like Love Haha Wow Sad Angry

Gargi

Travel freak, nature addict, music lover, and a dancer by passion. Crazy about wildlife when not hunting stories. Elocution and acting are my second calling. Hungry or not, always an over-zealous foodie

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *