টানটান লকড রুম মিস্ট্রি
সিরিজ়: টিকিটিকি
পরিচালনা: ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিনয়ে: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট (৬ পর্বে)
RBN রেটিং: ৩.৫/৫
সিনেমা হোক, বা সাহিত্য, ‘লকড রুম মিস্ট্রি’ হলো থ্রিলার ঘরানার একটি অন্যতম জনপ্রিয় রহস্যের ছক। এই কাহিনী যে কেবলমাত্র একটি ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা নয়। কিছু ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বাড়ি, বা ছোট জায়গাকে কেন্দ্র করেও বোনা হয় রহস্যের জাল। সেক্ষেত্রে দর্শকের চোখের সামনেই থাকে নানা সূত্র, আর রহস্যভেদীর মুনশিয়ানা সেই সূত্রগুলো খুঁজে বের করে রহস্য ভেদ করাতে। স্বাভাবিকভাবেই, স্থান সীমিত হওয়ায় চরিত্রের সংখ্যাও সীমিত হয়ে যায়। তবু সেই চরিত্রের মধ্যে থেকেই কে সাদা আর কে কালো, তা খুঁজে বের করার মধ্যেই নিহিত থাকে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। আর যদি রহস্যের সঙ্গে মিশে যায় মনস্তত্ত্ব ও কিছুটা উদ্ভটরস? সেক্ষেত্রে যা ফলাফল হয়, সেটাই হয়েছে ধ্রুবর ওয়েব সিরিজ় ‘টিকটিকি’তে।
এই কাহিনীর ঘটনাস্থল গড়পঞ্চকোট প্যালেস। দু’ ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে সর্বদাই দর্শক এই বাড়ির মধ্যে বা বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু এখানেই হওয়ায় বাড়ির বাইরে গিয়ে দৃশ্যায়নের প্রয়োজন হয়নি। কেবলমাত্র দুটি চরিত্র নিয়ে যে এক সফল থ্রিলার চিত্রায়ণ করা সম্ভব, তা পরিচালক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।
এই সিরিজ়ের দুই চরিত্রের একজন সৌমেন্দ্রকৃষ্ণ দেব (কৌশিক) ও অন্যজন তাঁর স্ত্রীর প্রেমিক মিলন বসাক (অনির্বাণ)। সৌমেন্দ্র প্রৌঢ়। প্রচুর অর্থের মালিক হওয়ায় জীবনধারণ করতে তাঁর অসুবিধে হয় না। তবে তিনি গোয়েন্দাকাহিনীর ভক্ত। তাই সুযোগ পেলেই বীরূপাক্ষ রায়চৌধুরী নামে এক গোয়েন্দাকে নিয়ে তিনি গল্প লেখেন। এই কাহিনীর সূত্রপাতের সময়ও তিনি বীরূপাক্ষকে নিয়ে একটি গল্প লিখে, নিজের মনে তা পড়ছিলেন। গড়পঞ্চকোট প্যালেসের প্রকাণ্ড বাড়িতে তিনি একা থাকেন। সঙ্গী বলতে কেবল একটি হা-হা করে হাসা পুতুল এবং বিলেত থেকে আমদানি করা অসংখ্য জিনিসপত্র। স্ত্রী মিমির সঙ্গে তাঁর বনিবনা নেই। তাই কিটু থাপা নামে এক ম্যাসিওরের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক যাপন করেন। এদিকে তিনি খবর পেয়েছেন, মিমিও এক সম্পর্কে লিপ্ত। সেই প্রেমিক মিলন বসাককে তিনি চিঠি লিখে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠান। মিলনের বাড়িতে আসা থেকেই কাহিনীর সূত্রপাত।
আরও পড়ুন: দাঙ্গার মাঝে ভালোবাসার গল্প
এই সিরিজ়ে এরপর আর একটি ঘটনারও উল্লেখ করা সম্ভব নয়। সৌমেন্দ্র ও মিলনের কথোপকথনের মাধ্যমে রহস্যের শাঁস একটু-একটু করে ছাড়াতে শুরু করলেও আচমকাই বেশ কিছু প্লট টুইস্টে তা বদলে যাচ্ছিল। ফলত, দর্শক যখনই কোনও কিছু অনুমান করবেন, পরমুহূর্তেই তাঁরা ভুল প্রমাণিত হবেন।
মিমি ও কিটুর কথা বারেবারে ফিরে এলেও তাঁদের উপস্থিতি সীমাবদ্ধ থাকে সৌমেন্দ্র ও মিলনের ঠোঁটেই। তাঁদের কেমন দেখতে, তার কল্পনার ভার পরিচালক দর্শকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। আরও একটি বিষয় দর্শকের জন্য রেখে দিয়েছেন পরিচালক। যবনিকা পতনের সময় তাঁর নিজের ভাবনা দর্শকের উপর চাপিয়ে না দিয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তবু প্রশ্ন রয়ে যায়। ছবি বা সিরিজ়ের কাহিনী বা বইয়ের পাতার চরিত্র হোক, কিংবা বাস্তবের কেউ, সব চরিত্রকেই কি সাদা বা কালোয় বিভাজন করা যায়? নাকি সবাই সাদা আর কালোর মিশেলে ধূসর?
আরও পড়ুন: স্লিপার সেলের কর্মকাণ্ড নিয়ে ছবিতে ইন্দ্রনীল, রাজনন্দিনী, শতাফ
প্রথমবার কোনও ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করলেন কৌশিক। প্রথম সিরিজ়েই তাঁর সাবলীল ও বাস্তবোচিত অভিনয় দিয়ে বাজিমাত করলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করলেন অনির্বাণ। এই প্রবীণ-নবীন জুটির মধ্যেকার জমাট রসায়ন গোটা সিরিজ় জুড়ে বারবার প্রমাণিত হলো।
একসময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও কৌশিক সেন ‘টিকটিকি’ নাটকে অভিনয় করতেন। সাংঘাতিক মঞ্চসফল নাটক ছিল সেটি। কৌশিক ও অনির্বাণ দুজনেই নাট্যজগতের মানুষ হওয়ায় তাঁরা প্রায় বিনা আয়াসেই এই কাহিনীকে ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তুললেন।
সিরিজ়ের চিত্রনাট্য লিখেছেন পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ও ধ্রুব। কাহিনী পদ্মনাভ কিছুটা নিজের মতো করে চলচ্চিত্রোপযোগী করলেও, অ্যান্থনি শ্যাফর রচিত ‘স্লিউথ’ নাটকের মূল নির্যাসটি তিনি ধরে রেখেছেন। কয়েকটি অংশ অতিরিক্ত দীর্ঘ বলে মনে হলেও, সিরিজ়ের শেষলগ্নে সেই দীর্ঘায়িত অংশগুলির অর্থ বোঝা যায়। এছাড়া শুধু টানটান রহস্যই নয়, গোটা সিরিজ় জুড়ে বেশ কিছু কৌতুকপূর্ণ পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করেছেন ধ্রুব ও পদ্মনাভ, যাকে সাহিত্যের ভাষায় ‘রিলিফ’ বলা হয়। সেই কৌতুকদৃশ্যগুলির ক্ষেত্রে কোনও অংশে মনে হয়নি যে পেটে কিল মেরে হাসানো হচ্ছে।
সায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের আবহ যথাযথ। মহম্মদ পিয়াসুদ্দিনের সম্পাদনাও ভালো। তবে চিত্রায়ণের জন্য সৌভিক বসু বিশেষ কৃতিত্বের দাবী রাখেন।
সব মিলিয়ে, কেউ যদি টানা বসে একটি টানটান লকড রুম মিস্ট্রি দেখতে চান, ‘টিকিটিকি’র বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না।