আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল বাংলা গান, নেতৃত্বে ছিলেন রুমা
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেনে বসেছে যুব উৎসবের আসর। সালটা ১৯৭৪। বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে গানের দল। সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাঁদের দেশের সংস্কৃতির একটুকরো নমুনা। একসময় মঞ্চে উঠে এল কুড়িজনের একটা দল যেখানে মহিলারা পরে আছেন লালপাড় সাদা শাড়ি আর পুরুষরা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির সঙ্গে গলায় লাল সাদা উত্তরীয়। তাঁরা একে-একে গাইলেন বাংলার জাতীয়তাবাদের গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, গণসঙ্গীত। মুগ্ধতায় ভেসে গেল দর্শক। সেদিন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় দল রুমা গুহঠাকুরতা এন্ড কোং-এর হাতে উঠেছিল সেরার শিরোপা। পরবর্তীকালে সেই কুড়িজনের দল বাড়তে-বাড়তে বিরাট বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার নামে যাদের একডাকে চিনতেন সারা দেশের মানুষ।
মঞ্চের একদিকে একদল পুরুষ অন্যদিকে একদল মহিলা, আর মাঝখানে হারমোনিয়াম নিয়ে কয়্যারের প্রাণপ্রতিমা রুমা গুহঠাকুরতা, কয়েক দশক ধরে এ এক চেনা ছবি ছিল বাংলা গানের মঞ্চে। ভারতবর্ষে প্রথম সমবেত সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করার কৃতিত্ব তাঁরই প্রাপ্য। অথচ তাঁর ছোটবেলা কেটেছে গান নয়, বরং নাচের মধ্যে দিয়ে। সাত বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে আলমোড়া বেড়াতে গিয়ে উদয়শংকরের কাছে নাচ শিখতে শুরু করেন রুমা। নাচের অনুষ্ঠান করতেই মুম্বই পৌঁছে যান, আর মাত্র দশ বছর বয়সে বম্বে টকিজের দেবীকারানীর চোখে পড়েন।
১৯৪৪ সালে পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর ছবি ‘জোয়ার ভাটা’ দিয়ে শুরু হয় রুমার অভিনয়জীবন।
আড়ও পড়ুন: তিনবার অভিনেতা পাল্টে ‘গুপী’ হলেন তপেন
এরপর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রবেশ করে একদিকে গান ও অন্যদিকে অভিনয় নিয়ে মেতে ওঠেন রুমা। ১৯৫৮ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ও সলিল চৌধুরীর ছত্রছায়ায় থেকে গড়ে তোলেন নিজস্ব গানের দল ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার। অন্যদিকে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় নায়িকারূপে তাঁর প্রথম ছবি ‘পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট’। এরপর একে-একে আসতে থাকে ‘আশিতে আসিও না’, ‘অভিযান’, ‘গঙ্গা’, ‘পলাতক’, ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘গণশত্রু’ ও আরও অজস্র ছবি।
অন্য নায়িকাদের থেকে কিসে আলাদা ছিলেন রুমা? তিনি অন্য কারোর গাওয়া গানে লিপ দিতেন না। ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে একটি গান ছিল ‘তুমি আকাশ এখন হতে যদি’, যেটিতে লিপ দেবেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রীর চরিত্রাভিনেত্রী। গানটি মান্না দে ও বনশ্রী সেনগুপ্তর দ্বৈত কণ্ঠে রেকর্ডিং করা হয়ে গিয়েছিল। তখন ওই চরিত্রে অন্য এক অভিনেত্রীর অভিনয় করার কথা ছিল। পরে অভিনেত্রী বদল হয়ে ওই জায়গায় এলেন রুমা। তাঁর শর্তমতোই আগের রেকর্ডিং বাতিল করে মান্না দে ও রুমাকে দিয়ে ওই গান আবার গাওয়ানো হয়। সেই গানের জনপ্রিয়তা আজও এতটুকু ম্লান হয়নি।
আড়ও পড়ুন: শেষ দৃশ্যে ভাঙা হোল্ডার, সত্যজিতের জয়জয়কার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম রেখেছিলেন কমলিকা। সেই নাম যদিও তিনি ব্যবহার করেননি কোথাও, ডাকনামেই জগৎবিখ্যাত হয়েছিলেন এই বাঙালি গায়িকা-নায়িকা। ২০১৯ সালের ৩ জুন ৮৫ বছর বয়সে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রুমা।