অপু-দুর্গার রঙিন কাশবন, প্রতিবাদে সরব বাংলার পরিচালকরা
RBN Web Desk: পর্দা জুড়ে বিস্তৃত কাশবন। দিগন্তে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে আসছে ট্রেন। সেই ট্রেন কাছ থেকে দেখার নেশায় ছুটে যায় অপু ও দুর্গা। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা বলে বিবেচিত হয় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পথের পাঁচালী’ ছবির এই দৃশ্য। এবার সেই দৃশ্যই রঙিন হওয়া নিয়ে প্রতিবাদে সরব হলেন সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম ভট্টাচার্য, শুভ্রজিৎ মিত্রের মতো পরিচালকরা।
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিকেত বেরা সম্প্রতি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে ‘পথের পাঁচালী’র কিছু দৃশ্যকে রঙিন করে ২.১৪ মিনিটের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। অনিকেতের দাবি তিনি নিজে সত্যজিৎ ভক্ত, তাই এই কাজটা পরীক্ষামূলকভাবেই করতে চেয়েছেন। তাঁর সহকর্মী অধ্যাপকরা অনেকেই বিভিন্ন বিদেশী ছবি নিয়ে নানারকম পরীক্ষামূলক কাজ করে থাকেন। তাই তিনিও তাঁর প্রিয় পরিচালকের ছবি নিয়ে সেটাই করেছেন।
সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় রেডিওবাংলানেট-কে জানালেন, “এক্সপেরিমেন্টই যদি করতে হয় তাহলে উনি সেটা নিজের কাছেই রাখুন। ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্র কি জানতেন না ছবিটাকে রঙিন করলে কেমন দেখাবে? তিনি তো ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ রঙিন করেছিলেন। এটা করলেন না কেন? সিনেম্যাটিক কারণেই ‘পথের পাঁচালী’ সাদাকালোয় তোলা হয়েছিল। সাদাকালো ছবি মানে একটা সময়কে ধরা। তার একটা আলাদা আবেদন আছে, অর্থ আছে। সেটাকে রঙিন করে দেওয়া মানে তার অর্থকেই পাল্টে ফেলা।”
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
গত বছর ‘ফেলুদা: ফিফটি ইয়ারস অফ রে’জ় ডিটেকটিভ’ তথ্যচিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নবাগত পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন সাগ্নিক। “এই তথ্যচিত্রে ব্যবহৃত প্রতিটা ক্লিপের জন্য আমাকে অনুমতি নিতে হয়েছিল। এর আগে ‘মুঘল-এ-আজ়ম’ বা ‘হাম দোনো’ রঙিন করা হলেও সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুমতি নিয়েই করা হয়েছিল। পারলে বার্গম্যান বা চ্যাপলিনের ছবি রঙিন করে দেখাক। সেটা করার জন্যও অনুমতি প্রয়োজন,” জানালেন তিনি। এ বিষয়ে অবিলম্বে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি তুললেন সাগ্নিক।
পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক যোগেশ মাথুরের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে বলে জানালেন সাগ্নিক। “তাঁর মতে নৈতিক দিকটা বাদ দিলেও টেকনিক্যাল দিক থেকেও খুব নিম্নমানের কাজ হয়েছে,” জানালেন সাগ্নিক।
আরও পড়ুন: সব কান্নার শব্দ হয় না, বেজে উঠল পটদীপ
‘অন্তর্লীন’ ও ‘ফ্ল্যাট নং ৬০৯’-এর পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য জানালেন, “আমার বক্তব্য খুব পরিষ্কার। এত বছর আগে তৈরি একটা ছবির কন্টেন্ট পাল্টে ফেলা এক ধরণের অপরাধ। যিনি এটা করেছেন তাঁর শাস্তি হওয়া উচিত। অনুমতি ছাড়া অন্য একজনের ছবিতে আমি যা খুশি তাই করতে পারি না। প্রকাশ পাওয়ার পর এই ভিডিওর ভিউ সংখ্যা প্রায় ৭০,০০০। আরও মানুষ দেখছেন। এটাকে তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। এই জিনিস চলতে দিলে তো সব সাদাকালো ছবি নিয়েই এক্সপেরিমেন্ট হবে। এটা হতে দেওয়া যায় না।”
সাগ্নিকের মতই কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেন শুভ্রজিৎ মিত্র। “কাজটা এক্সপেরিমেন্টাল,” বললেন তিনি, “তাই সেটা নিয়ে আমার তেমন আপত্তি নেই। তবে তার মান অত্যন্ত খারাপ। একটা ছবির বিষয়বস্তু বিবেচনা করে তাকে রঙিন বা সাদাকালো করা হয়। সেই সাদাকালোর নানারকম টোনাল কোয়ালিটি থাকে। এই ভিডিওর রঙ ওইসময়ের রঙিন সেলুলয়েডের মতো নয়। প্রতিটা দৃশ্যের নিজস্ব গভীরতা থাকে, সেটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আশির দশকের কিছু বাংলা ছবিতে এরকম রঙ দেখা যেত। সর্বজয়া স্নান সেরে ফিরছেন, তার শাড়িটা লাল ডুরে হলেই দেখতে ভালো লাগে, সেটাই আমাদের চিরকালের চেনা ছবি। সেটা নীল হয়ে গেলে দেখতে ভালো লাগবে না।”
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের শেষাংশ অবলম্বনে ‘অভিযাত্রিক’ পরিচালনা করছেন শুভ্রজিৎ। এই উপন্যাসের প্রথমাংশ নিয়ে সত্যজিতের ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৬ ও ১৯৫৯ সালে। উল্লেখ্য, ‘অভিযাত্রিক’ও মুক্তি পাবে সাদাকালোয়।
“’পথের পাঁচালী’র এই ক্লিপে যে রঙটা আনা হয়েছে সেটা এই ছবির সঙ্গে যায় না। সুব্রতবাবু সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফারদের মধ্যে অন্যতম। সেই খোদার ওপর খোদকারী করতে গেলে একটু চিন্তাভাবনা করে করা উচিত ছিল। তবে এটাও ঠিক যে ‘পথের পাঁচালী’ ছাড়া অন্য কোনও ছবি নিয়ে এই কাজটা করলে হয়ত এত কথা উঠত না,” বললেন শুভ্রজিৎ।
বিনোদন দুনিয়ার সব খবর পেতে জয়েন করুন আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল