ওটিটি মাধ্যমে বিষয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন সুধীর
RBN Web Desk: ওটিটি বা ডিজিটাল মাধ্যমে বিষয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন বিশিষ্ট পরিচালক সুধীর মিশ্র। ২৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবারের সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতার মঞ্চে আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। বিষয় ছিল ওটিটির যুগে সিনেমার ভবিষ্যত।
বর্তমানে ওয়েব সিরিজ় ও ওয়েব ফিল্মের দাপটে বড়পর্দায় ছবির জৌলুস কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। অনেক বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে ওটিটির মাধ্যমে, এ কথা অনস্বীকার্য। সুধীরের মতে, ওটিটি মাধ্যম পরিচালকদের যে পরিমাণ স্বাধীনতা দিয়েছে সেটা সিনেমায় পাওয়া যায় না। সিরিজ়ের ক্ষেত্রে একটা পর্বের দৈর্ঘ্য যেহেতু বাঁধা থাকে না, তাই কাজের পরিসর অনেকটাই বেড়ে যায়। এছাড়াও এত বেশি মানুষ এখন ওটিটি ব্যবহার করছেন যে সেটাকে কিছু ক্ষেত্রে টেলিভিশনের পরিপূরক বলা চলে। এছাড়া অভিনেতা নির্বাচন বা কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজকের হুকুম মেনে চলতে হয় না। ওটিটির দৌলতে বহু গুণী অভিনেতা, যারা হয়তো তেমনভাবে ছবিতে কাজ করছিলেন না, আজ সাধারণ মানুষের কাছে তারকা হয়ে উঠেছেন।
এই সূত্রে সুধীর মনে করেন ওটিটির কল্যাণেই আজ মনোজ বাজপেয়ী বা কেকে মেননের জনপ্রিয়তা এ দেশে প্রায় শাহরুখ খানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এছাড়া নওয়াজ়উদ্দিন সিদ্দিকি, শেফালী শাহ, পঙ্কজ ত্রিপাঠির মতো অভিনেতারা কেউ আজ বসে নেই। প্রত্যেকের হাতে কাজ রয়েছে এবং জনপ্রিয়তায় এরা বড়পর্দার তারকাদের থেকে কোনও অংশে কম নন। শুধু তাই নয়, বহু অচেনা বা স্বল্প চেনা অভিনেতারাও ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ করে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, যেমন ‘পাতাললোক’ সিরিজ়ের জয়দীপ অহলাওয়াত।
এছাড়া এই মাধ্যমে যে কোনও বিষয় নিয়ে যতটা বিশ্লেষণ বা পরীক্ষামূলক কাজ করা যায় সেটা সিনেমায় করতে গেলে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় বলে মনে করেন সুধীর। বাণিজ্যিক ছবির ভূমিকাকে তিনি অস্বীকার করতে চান না, কারণ সেটা দেখতে বহু মানুষ প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছেন এবং তার থেকে বিনোদন নিচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখার মতো কাজ বেশিরভাগটাই এখন ওটিটি মাধ্যমে দেখা যায় এটাও ঠিক।
আরও পড়ুন: বাইপোলার ডিসঅর্ডার থেকে চরম অবসাদ, হোমসে ‘ডুবে’ গিয়েছিলেন জেরেমি
তবে এক্ষেত্রে তিনি প্রশ্ন তোলেন ওটিটি মাধ্যম কি শুধু ভূত, গোয়েন্দা, যৌনতা, সাসপেন্স থ্রিলার, মনস্তাত্বিক কাহিনী দেখিয়েই ক্ষান্ত দেবে? নতুন ধরণের বিষয় নিয়ে কাজ করলে কি কোথাও দর্শক হারাবার ভয় থেকে যাচ্ছে? নাকি দর্শকেরই আরও বেশি আধুনিক মনস্ক হওয়া দরকার?
তবে ভালো ছবি তৈরির ক্ষেত্রেও সমাধান সূত্র মিলল সুধীরের বক্তব্য থেকেই। তিনি কল্পনা করেন, যদি এমন হতো আজকের দিনে সত্যজিৎ রায় কোনও ওটিটি অফিসে ঢুকছেন ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্য হাতে, সেটা আদৌ এই মাধ্যমে সম্ভব ছিল কি? তাঁর মতে, আন্দ্রেই তারকোভস্কি বা ইঙ্গমার বার্গম্যান যে ধরণের ছবি করতেন, তা কখনওই এই মাধ্যমে করা সম্ভব হতো না। এমনকি জাঁ লুক গোদারের ছবিও নয়।
এই প্রসঙ্গে মৃণাল সেন ও বাদল সরকারের কথাও উঠে এল। সুধীর মনে করান, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের সাহায্য ছাড়া ‘পথের পাঁচালী’ তৈরি হতো না। কাজেই সরকারী অনুদান শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এ কথা অস্বীকার করা চলে না। সরকার এগিয়ে এলে আরও অনেক ভালো কাজ বড়পর্দায় হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে শিল্পের উৎকর্ষতার কথা মাথায় রেখে। একমাত্র তাহলেই নতুন পরিচালকরা যেভাবে কাজ করতে চাইছেন তা বাস্তবায়িত হবে।
আরও পড়ুন: বেহিসেবী জীবনযাপন, আজ স্মৃতির অতলে সৌমিত্র
এই প্রসঙ্গে যে কোনও বিতর্কিত বিষয়েই কথোপকথনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। তাঁর মতে বিরোধ থাকতেই পারে, তাই বলে কথা বলব না কেন? দু’পক্ষ যদি মুখোমুখি আলোচনায় বসে তাহলে সমাধান সূত্র বেরোতে বাধ্য। যে কোনও বিষয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে একে সার সত্য বলে মানেন সুধীর। দর্শকের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলে এ কথা তিনি স্পষ্ট করে দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে সবরকম মতামতকে তিনি স্বাগত জানান, এবং আগ্রহ নিয়ে তা শুনতেও চান। বিরোধিতা থাকবেই, একমাত্র কথোপকথনই দূরত্ব ঘোচাতে পারে।
ছবি: গার্গী মজুমদার