অন্ধকারের দেবী
তন্ত্রশাস্ত্র মতে দশমহাবিদ্যার দশজন দেবী হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী ও কমলা। এই দশটি রূপের প্রথম রূপ হলো কালী। মার্কণ্ডেয় চন্ডী অনুযায়ী মহাকালীর ধ্যানমন্ত্র হলো, ‘ওঁ খড়্গং চক্রগদেষুচাপপরিঘান শূলং ভুসূণ্ডিং শিরঃ। শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্।। নীলাশ্মদ্যুতিমাস্যপাদদশকাং সেবে মহাকালিকাম্।। যামস্তৌচ্ছয়িতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্।।’
Image: bitcointalk.org
প্রধানতঃ শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করে থাকেন। শক্তির আরাধনা করেন যারা, তাদের শাক্ত বলা হয়। কালীর অন্য নাম হলো আদ্যাশক্তি বা শ্যামা। শাক্ত মতে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আদি কারণ হলেন দেবী কালিকা। দেবীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পুরানে পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তিনি চতুর্ভূজা রূপেই পূজিতা হন। পায়ের তলায় থাকেন মহাদেব। গলায় থাকে মুন্ডমালা। হাতে খড়্গ, ছিন্নমুন্ড ও বরাভয় মুদ্রা। জিভ থাকে বাইরে।
সোনায় সোহাগা
ব্রহ্মযামল মতে কালি হলেন বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বস্তুত এই বঙ্গে কালীর যত মন্দির দেখা যায়, তা আর কোথাও দেখা যায় না। কোথাও কোথাও কালীকে ‘কলকাত্তাওয়ালি’ বলেও ডাকা হয় থাকে। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা অনুষ্টিত হয়। মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জৈষ্ঠ্যমাসে ফলাহারী কালীপূজাও করে থাকেন অনেকে। এছাড়া প্রতি শনি-মঙ্গলবারে ও প্রতি অমাবস্যায় সমস্ত কালীমন্দিরে কালীপূজা হয়ে থাকে। বিভিন্ন মন্দিরে দেবী ভবতারিণী, করুনাময়ী, আনন্দময়ী, ব্রহ্মময়ী প্রভৃতি নামে পূজিতা হয়ে থাকেন।
তন্ত্রমতে কালীর আটটি রূপের কথা জানা যায়। এগুলি হলো দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। প্রত্যেক রূপের আলাদা বিশেষত্ব ও মাহাত্ম্য রয়েছে।
দক্ষিণাকালী: চতুর্ভূজা, মুক্তকেশী ও করালবদনী এই রূপের গলায় মুন্ডমালা থাকে। দক্ষিণে যমের অবস্থান। দেবী কালিকার ভয়ে সে পলায়মান। তাই দেবীর এই রূপের নাম দক্ষিণা। দেবী শ্যামবর্ণা। বাম দিকের উর্ধ ও অধহস্তে আশীর্বাদ ও অভয়মুদ্রা। দেবীর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত। নিম্নাঙ্গে নর হস্তের আচ্ছাদন। দক্ষিণ পদ শিবের বক্ষে অবস্থিত।
যে আগুন নেভে না
শ্মশানকালী: ঘোর অমাবস্যার মতো কৃষ্ণবর্ণা দেবীর এই রূপ। দুই চোখ রক্তবর্ণ। ইনি মহাশক্তির আদিরূপ। দেবীর এক হাতে থাকে সুরাপাত্র ও অন্য হাতে নরমাংস। রূপে ভয়ঙ্করী হলেও ওষ্ঠে স্মিতহাস্য থাকে।
সিদ্ধকালী: ইনি দক্ষিণাকালীর অন্য রূপ। দেবী ত্রিনয়না ও মুক্তকেশী। দক্ষিণ হস্তে খড়্গ। তার আঘাতে চন্দ্রমণ্ডল থেকে ঝরে পড়ে অমৃত, দেবীর হাতের নর কপালের মধ্যে। দেবীর গায়ের বর্ণ নীলাভ। সর্বাঙ্গ অনাবৃত। সূর্য ও চন্দ্র দেবীর দুই কর্ণকুণ্ডল। দেবীর দুই পদ শিবের বক্ষে ও উরুতে অবস্থিত। এই রূপে দেবী সাধারণত সিদ্ধ সাধকদের আরাধ্যা হয়ে থাকেন।
গুহ্যকালী: দেবীর এই রূপকে আকালী বলেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে। এই রূপ মহাবিদ্যার স্বরূপ। এই রূপে দেবী গৃহীর সম্মুখে প্রতীয়মান হন না। এই রূপ শুধুমাত্র সাধকের কাছে আরাধ্যা। এই দেবী দ্বিভুজা। গাত্রবর্ণ জলভরা মেঘের ন্যায় কালো। দেবীর জিভ রক্তবর্ণ। গলায় পঞ্চাশটি নরমুন্ডের মালা পরেন দেবী। এছাড়া নাগমালাও থাকে। মাথার ওপর থাকেন অনন্তনাগ। ললাটে অধিষ্ঠান করেন অর্ধচন্দ্র। দেবীর কঙ্কনে থাকেন তক্ষক ও নাগরাজ অনন্ত। দেবী নরমাংস ভক্ষণ করেন। অট্টহাস্যরতা দেবী ভয়ালরূপী ও সাধকের অভীষ্ট সিদ্ধকারিনী।
ঐতিহ্যের পুজো: রানী রাসমণি
ভদ্রকালী: স্বর্ণবর্ণা দেবী ভক্তের কল্যাণ করে থাকেন। ললাটে অর্ধচন্দ্রের অবস্থান। দেবীর মাথায় জটাজুট। এই রূপ কালিকাপুরাণের। তন্ত্রমতে তিনি কৃষ্ণবর্ণা। জগৎকে গ্রাস করতে উদ্যত দেবীর ভয়ঙ্করী রূপ।
চামুন্ডাকালী: দুর্গাপুজোর সময় সন্ধিপূজায় দেবীর চামুন্ডারূপের পূজা হয়ে থাকে। মার্কণ্ডেয়পুরাণ অনুযায়ী চন্ড ও মুন্ড নামক দুই অসুরকে বধ করার জন্য দেবী চামুন্ডার সৃষ্টি হয়। দেবীর গায়ের রঙ নীল পদ্মের মতো, পরনে বাঘছাল, অস্থিসার দেহ ও দন্ত দৃশ্যমান। চন্দ্রহাস ও দন্ড এই বিকটাকার দেবীর অস্ত্র। ভারতের বিভিন্ন স্থানে দেবী চামুন্ডার মন্দির রয়েছে। তবে বাংলায় দেবী চামুন্ডার পূজার প্রচলন খুব একটা নেই।
মহাকালী: ইনি দশভূজা, পঞ্চদশ নয়না। দশ হাতে দশ রকম অস্ত্র বর্তমান। দেবী সালংকারা। দেবীর কালরূপের কারণ মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুর। এদের বিনাশ করার জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা দেবী মহাকালীর আবাহন করেন।
মন আজ ঈষৎ ভারাক্রান্ত
শ্রীকালী: কৃষ্ণবর্ণা দেবী ত্রিশূলধারিণী ও নাগপাশ বিশিষ্টা। দারুক নামের এক অসুরকে নিধন করার উদ্দেশ্যে দেবীর সৃষ্টি হয়। বলা হয় দেবী মহাদেবের শরীরে প্রবেশ করেছিলেন, সেইসময় তাঁর কণ্ঠের বিষে দেবীর দেহের বর্ণ কালো হয়ে যায়।
মনে করা হয় ‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দ থেকে এসেছে। অর্থ কৃষ্ণবর্ণ ও মৃত্যু স্বরূপ। মহাভারতে এক দেবীর বর্ণনা আছে যার নাম কালরাত্রি। অনেকের মতে সেই থেকেই কালীর ধারণার উৎপত্তি হয়েছে। তবে বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞানীদের মতে কালী যে রূপে বাংলায় পূজিতা হন তা কোনও পৌরাণিক রূপ নয়। বরং লৌকিক নানা কাহিনী ও কল্পনা থেকে এই দেবীর সৃষ্টি। তবে বাংলার নানান জায়গায় কালিভক্তির প্রভূত নিদর্শনকে এত সরলভাবে ব্যাখ্যা করা বোধহয় সম্ভব নয়।
Image: veeel.deviantart.com
কালিপুজোর সঙ্গে দীপাবলীর ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মনে করা হয় রামচন্দ্র লঙ্কায় রাবনকে বধ করে যখন অযোধ্যায় ফিরে আসেন তখন নগরবাসী সারারাত আলোকোজ্জ্বল নগরীতে উৎসব পালন করেন। সেই থেকে দীপাবলীর অর্থ অশুভের বিনাশ ও সত্যের জয়। আলোর প্রকাশ ও কালীর আরাধনা মানুষের মনের সমস্ত অন্ধকার দূর করে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করে।
Khub I bhalo…