মন আজ ঈষৎ ভারাক্রান্ত

উমার চলে যাওয়া বাঙালির কাছে বড় বেদনার, বড় বিষাদের। আনন্দময়ী মা এসে বছরের কয়েকটা দিন সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেন। সারা পৃথিবীর বাঙালি আনন্দে মেতে ওঠেন এই কটা দিন। তবু সেই মাকেও চলে যেতে হয় সময়ের নিয়মে। ‘নবমী নিশি রে, তোর দয়া নাই রে’ বলে প্রাণ কাঁদলেও দশমীর সকাল তার নিয়ম মতোই এসে পড়ে। তবু মা দুর্গার চলে যাওয়া বলে কথা। তাকে তো আর যেমন তেমন ভাবে যেতে দেওয়া যায়না। প্রাচীনকাল থেকে মা দুর্গাকে বাড়ির মেয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে এসেছে। মেয়ে বাপের বাড়ি এলে তার চলে যাওয়ার সময় মন ভারাক্রান্ত হলেও নিয়মের ত্রুটি রাখতে নেই। তাই বহুকাল ধরে সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ম মেনে আজও উমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর রীতি চলে আসছে।

Durga Puja Vijaya Dashami

দশমী মানে পুজোর শেষ। বচ্ছরকার দিনের আনন্দ উৎসবের ইতি। তাই পাল্টে যায় ঢাকের বোল। যে ঢাকিরা গতকাল অবধি আনন্দের সুর বাজিয়ে এসেছে তারাই আজ বাজাবে, ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন।’ এক অদ্ভুত বিদায়ী সুর থাকে এই বোলে। সকাল থেকেই মনখারাপের রেশ চলে ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের মনে। বিসর্জনের পুজো শেষে দর্পণে মায়ের মুখ দেখার রীতি বহু পুরোনো। বাড়ির পুজোয় নিয়ম করে সকলে দর্পণে মায়ের মুখ দেখেন।

এরপরে সিঁদুর খেলা। বিষাদের মধ্যেও যেন আনন্দের সুর নিয়ে আসে এই একান্ত নিজস্ব বাঙালি প্রথা। বাড়ির সমস্ত বিবাহিত মহিলা মা দুর্গাকে সিঁদুর পরিয়ে মুখে পান সুপারি মিষ্টি ও জল দেন। হাতে দেওয়া হয় ধানদূর্বা। কানে কানে বলা হয় ‘আবার এসো মা।’ প্রণাম করা হয় মায়ের পায়ে হাত দিয়ে। ছোটরা তাদের বইপত্র স্পর্শ করিয়ে নিয়ে যায় মা দুর্গার পায়ে। তারপর মহিলারা একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেন। সিঁদুরের ছোঁয়া দেন একে অন্যের হাতের শাঁখা লোহায়। সৌভাগ্য ও সৌহার্দ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে সিঁদুর খেলা। মণ্ডপে বেজে ওঠে শেষ ঢাকের সুর। চলে ধুনুচি নাচ। বাড়ির ছোট বড় পুরুষ (বর্তমানে মহিলারাও) স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন এই ধুনুচি নাচে। বারোয়ারি পুজোগুলোতেও এই প্রথা পালিত হয়ে থাকে।

Durga Puja Vijaya Dashami

এরপর শুরু হয় বিসর্জনের তোড়জোড়। মেয়ে চলে যাওয়ার প্রতীকী হিসেবে অনেক বাড়ির পুজোয় এখনও কনকাঞ্জলি দেবার নিয়ম চলে আসছে। মেয়ে একা শ্বশুরবাড়ি ফিরবে, শিব আসেনি তাকে নিতে। তাই তাকে জানাতে হবে। অতএব নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে কৈলাশে খবর দেওয়া হতো যে মা ফিরছেন। এ প্রথা বহু বনেদি বাড়ির পুজোয় ছিল। এখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন হবার ফলে অনেক জায়গায় এই প্রথা উঠে গেছে। কেউ বা নীলকন্ঠ পাখির বদলে অন্য পাখি ব্যবহার করেন। কেউ পায়রার গলায় নীল রঙ লাগিয়ে তাকে উড়িয়ে নিয়মরক্ষা করেন। কেউ বা বন্দুকের গুলির শব্দ করে পুজো সমাপ্তির ঘোষণা করেন।

শোভাবাজার রাজবাড়িতে আগে নীলকন্ঠ পাখি ওড়াবার রীতি ছিল। এখন উপায় নেই বলে নীলকন্ঠ পাখির মূর্তি জলে ভাসানো হয়। ঠাকুরদালান থেকে বেরিয়ে দেবীকে নৌকায় তোলার আগেই পাখির মূর্তি ভাসিয়ে দেওয়া হয়। শোভাবাজারের নিয়ম অনুযায়ী আজও দুই নৌকা ফাঁক করে দেবী মূর্তির বিসর্জন দেওয়া হয়। কোনও কোনও বাড়িতে দেবীমূর্তিকে দোলায় করে নিয়ে যাওয়া হয়, কোথাও বা মাথায় করে। এই রীতির তাৎপর্য হিসেবে বলা হয়, যেহেতু মৃতদেহকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার চল রয়েছে, তাই দেবীকে অন্যভাবে নিয়ে যেতে হবে।

ঐতিহ্যের পুজো: ছাতুবাবু-লাটুবাবু

কথিত আছে দেবীর বিসর্জন কখনওই বিষণ্ণ মনে, অশ্রুসজল নয়নে করতে নেই। দেবীকে খুশি মনে বিদায় জানাতে হয়। তাই শোভাযাত্রা করে, বাজি ফাটিয়ে, আনন্দ সহযোগে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকের বোলে চলে বিসর্জনের নাচ। শাঁখ ও উলুধ্বনিতে গমগম করে পূজামন্ডপ। শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় গঙ্গার দিকে। প্রথমে হয় ঘট বিসর্জন। চিন্ময়ী দেবী মর্ত্য ছেড়ে কৈলাশে পাড়ি দেন। এরপর দেবীমূর্তিকে জলের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে তিন বা সাতপাক ঘোরানো হয়। তারপরে বিসর্জন। এত মাসের এত প্রস্তুতি, এত আয়োজন, এত আনন্দের অবসান ঘটিয়ে সলিল সমাধি ঘটে মৃন্ময়ী মায়ের।

বাঙালিদের যেমন দশমী, সারা ভারতে তেমন দশেরা। সন্ধিপূজায় দুর্গা মায়ের কাছে আশীর্বাদ নিয়ে রামচন্দ্র রাবনকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করেন বিজয়া দশমীর দিন, এই হলো অকাল বোধনের গল্প। সেই রাবনবধের কাহিনী আজও মানুষকে দুষ্টের দমন ও সত্যের জয়ের পথে সমাজকে চালিত করার প্রেরণা দিয়ে যায়। নানান জায়গায় তৈরি করা হয় বাজি ও বারুদে ঠাসা অতিকায় রাবনের মূর্তি। রামচন্দ্র সেজে কোনও একজন সেখানে তীর নিক্ষেপ করে অগ্নিসংযোগ করেন। জ্বলে ওঠে রাবন, অবসান হয় অন্ধকারের, অসত্যের।

বিসর্জনের পর আসে বিজয়ার আনন্দঘন মুহূর্ত। সে কথা বলার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাবো।

Durga Puja Vijaya Dashami

কলকাতাবাসী গঙ্গায় বিসর্জন দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু জেলার আর এক প্রান্তে টাকির ইছামতী নদীতে চলে অন্য এক অভিনব বিসর্জন। নদীর এপারে ভারতের টাকি শহর। ওপারে বাংলাদেশের খুলনা। দুই দেশের প্রতিমা নিয়ে নৌকাগুলো একই সঙ্গে ইছামতির জলে নামে। দুই পাড়ে নামে মানুষের ঢল। অজস্র মানুষ নৌকায় করে অন্য পাড়ের মানুষকে বা মাটিকে একবার ছুঁয়ে দেখে আসেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুরো নদীতে বিএসএফ ও বিডিআর মোতায়েন করা হয়। আগে এই বিসর্জনের সময়টুকুতে দুই দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া হতো। সে বড় আবেগের মুহূর্ত ছিল। অচেনা মানুষও একে অন্যের সঙ্গে হাত মেলাতেন। ওদিকে একের পর এক নৌকা থেকে বিসর্জন হচ্ছে এক একটি বাড়ি বা ক্লাবের দুর্গাপ্রতিমা। সেই দৃশ্য নিজে চোখে না দেখলে বর্ণনা করা কঠিন। কিছুক্ষণের জন্য ওপারের মানুষ এখানে আসতেন। আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরে যেতেন। বর্তমানে সরকারি নিয়মের কড়াকড়িতে এখন আর পুরো সীমান্ত খোলা হয় না। নদীর মাঝ বরাবর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নৌকা দিয়ে নদীকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। তবু সেই আবেগকে বেড়া দিয়ে ভাগ করে দেওয়া যায়নি। এখনও উৎসাহ আর প্রাণের টান একইরকম থেকে গিয়েছে।

ঐতিহ্যের পুজো: লাহাবাড়ি

বিজয়ার কথা বলতে হলে সেকালের বিজয়া পালনের কথা চলেই আসে। যদিও কেউই মন থেকে চায় না দশমীর দিনটা আসুক, তবু সে তো আসবেই। তাই বাড়ির হেঁসেলে পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিজয়ার মিষ্টান্নের প্রস্তুতি চলতেই থাকত। কারণ বিজয়া মানেই অনেক ধরণের খাবার, অনেক ধরণের মিষ্টি। বিজয়া মানে আবার ইলিশ মাছও। গঙ্গায় ঠাকুর পড়ে গেলে আর ইলিশ খাওয়া যাবে না, এ এক অলিখিত নিয়ম চলে আসছে বাঙালির জীবনে বহুদিন ধরে। তাই দশমীতে ইলিশ খাওয়ার চল ছিল অনেক বাড়িতে। পূর্ববঙ্গীয় পরিবারগুলিতে রীতি ছিল ইলিশ মাছ খেয়ে ঠাকুরকে সিঁদুর পরাতে যাবার।

ফিরে আসি মিষ্টির কথায়। পুজোর অনকে আগে থেকেই নারকেল পাড়ানো হতো। নারকেল ছাড়া যে বিজয়ার মিষ্টি হবে না। নানারকম ছাঁচ দিয়ে তৈরি হতো নারকেলের মিষ্টি। নিদেনপক্ষে নারকেল নাড়ু তো হতোই। মিষ্টির দোকানে বানানো হতো নারকেলছাপা আর চন্দ্রপুলি। তবে একটা সময় দোকানের মিষ্টি খুব কম বাড়িতেই খাওয়ানো হতো। সব কিছুই তৈরি হতো বাড়িতে। ঠাকুর ভাসান যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। একদিকে বাড়ির ছোটরা যখন নিয়ম করে ১০৮ বার দুর্গানাম লেখায় ব্যস্ত ওদিকে রান্নাঘরে তখন তৈরী হতো ঘুগনি আর কুচো নিমকি।

Durga Puja Vijaya Dashami

যারা ভাসানে যেত তারা ফেরার পরে সবাইকে দেওয়া হতো শান্তির জল। তারপর প্রণাম ও কোলাকুলির প্রথা। ছোটরা বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে আর সমবয়সীরা কোলাকুলি করবে, এই হলো বিজয়ার রীতি। সারা বছরের ক্ষোভ, দ্বেষ ভুলে ভালবেসে একে অপরকে কাছে টেনে নেওয়াই বিজয়ার উদ্দেশ্য। কোনও কোনও বাড়িতে আবার বিজয়া দশমীর দিন সিদ্ধিপান করা হতো। পুজোমণ্ডপে থাকতো রসগোল্লা ও বোঁদে। সেই দিয়ে বিজয়া সারার পর ছেলেপুলের দল বেরিয়ে পড়তো পাড়ার অন্য সব বাড়িতে। পায়ে হাত দিতে প্রণাম করলেই পাওয়া যেত একবাটি ঘুগনি, একমুঠো কুচো নিমকি আর নারকেল নাড়ু।

ঐতিহ্যের পুজো: সাবর্ণ রায়চৌধুরী

আজ আর সেই দিন নেই। বিজয়া এখন শুধুমাত্র নিয়মরক্ষা আর বিজয়া সম্মিলনীতেই সীমাবদ্ধ। সময়ের অভাবে বাড়ির মিষ্টি, নিমকির জায়গা করে নিয়েছে দোকানের মিষ্টি বা পেস্ট্রি, প্যাটিজ, পিৎজা। বিজয়া করতে যাবার তাড়াও আজকাল আর বিশেষ কারোর মধ্যে দেখা যায়না। একান্নবর্তী মানসিকতা ভাঙতে ভাঙতে আজ অনু পরমাণুতে এসে ঠেকেছে। বেড়েছে কাজের চাপ, কমেছে সময়। তাই আজ ফোনে বা মেসেজেই বিজয়া সেরে নেয় পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বাঙালি।

তবু পুজো শেষ এখনও সকলের মনে বিষাদের ছায়া নিয়ে আসে। এখনও নবমী নিশি আট থেকে আশি সকলের কাছে বড় দুঃখের রাত। আন্তরিকতার আড়ম্বর কমলেও উৎসবের ছোঁয়া সকলের মনকে কটা দিনের জন্য ভিজিয়ে দিয়ে যায়। তাই আজও মা দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে অতি আধুনিক তরুণ প্রজন্মও বলে ওঠে ‘আসছে বছর আবার হবে।’

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
181

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

One thought on “মন আজ ঈষৎ ভারাক্রান্ত

  • Very beautifully presented …

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *