পরিস্থিতির নিরিখে সত্য বিচার হয়, দেখালেন সৃজিত

ছবি: সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই 

পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায় 

অভিনয়ে: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়, অর্জুন চক্রবর্তী, সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক, সৌরসেনী মৈত্র, কৌশিক কর, নূর ইসলাম

দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৭ মিনিট

RBN রেটিং ★★★★★★★★☆☆

সত্য কী? কাকে বলে সত্য? ছোটবেলায় ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে আমরা সকলেই ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ আপ্তবাক্যটি শিখি। কিন্তু ছোটবেলার সেই সত্যি কথা যতটা নির্দোষ মন নিয়ে বলা যায়, বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে আমরা জেনে যাই সত্য ঠিক ততটা একমাত্রিক বা নিষ্পাপ হয় না। চাঁদের গায়ে পৃথিবীর ছায়ার মতোই সত্যের গায়েও লেগে থাকে পরিস্থিতির ছায়া। নিজেদের ভেতরে ঠিক-ভুলের বিচার করতে-করতে একটা সময় আমরা বুঝে যাই সর্বৈব সত্য বলে কিছু হয় না। যা হয় তা পরিস্থিতির নিরিখে হয়। সৃজিতের ছবি ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ (Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei) এই মূল ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে। মূল কাহিনি ’12 Angry Men’ বা ‘এক রুকা হুয়া ফয়সলা’ও তাই ছিল। তবে সৃজিত এর সঙ্গে যোগ করেছেন আরও কিছু গল্প, যা হয়তো দর্শককে দম নেওয়ার জায়গা করে দেবে। 

আরও পড়ুন: ‘আশিকি ৩’ ছাড়লেন তৃপ্তি দিমরি

মূল কাহিনিতে সরাসরি প্রবেশ করার উপায় ছিল না কারণ বর্তমানে জুরি ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই। যে সময়ের কাহিনি, সে সময় ছিল। সেই কারণে পরিচালককে অন্য গল্পের আশ্রয় নিতে হয়েছে। কৌশিক (গঙ্গোপাধ্যায়) রয়েছেন এক বিচারকের ভূমিকায়। তাঁর ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় বিচার পদ্ধতি। মতামত প্রদানকারীরা আশেপাশের চেনা মানুষজন। এদের প্রত্যেকের রয়েছে বিশেষ-বিশেষ প্রেক্ষাপট, রয়েছে যন্ত্রণার অতীত। সেই জায়গা থেকেই এক একটা মানুষ এক একরকম। কেউ অতিরিক্ত সাবধানী তো কেউ অতীব দুর্মুখ। কেউ নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে, কেউ বা শুরু থেকেই হতাশ। ক্রমশ বাড়তে থাকে তর্কবিতর্কের চাপ, চড়তে থাকে কথোপকথনের পারা। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় কি? 

Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei

বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ছবিতে বা মূল ইংরেজি ছবিতেও জুরিরা একটি ঘরের মধ্যে নিজেদের বন্দি রেখে তর্ক চালিয়ে গিয়েছিল। সৃজিত সেই চেম্বার ড্রামাকে চার দেওয়ালের বাইরে বার করে এনেছেন। সেটার কারণ বাড়তে থাকা তর্কের চাপের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়ে দেওয়াও হতে পারে আবার দর্শককে বন্ধ ঘরের ক্লান্তির হাত থেকে মুক্তি দেওয়াও হতে পারে। তবে বন্ধ ঘরে প্রতিটি সদস্যের মতামত বদল গল্পের গতিকে যে পরিমাণ ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিল, বহিঃদৃশ্যে তা স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা কম বলে মনে হয়। বারো রাশির চেয়ারের সঙ্গে প্রত্যেক সদস্যের ভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং মতানৈক্য বেশ অর্থপূর্ণ। ভিন্ন-ভিন্ন পটভূমিতে গল্পকে তুলে ধরার মধ্যে বেশ একটা ভিজ়ুয়াল রিলিফের ব্যাপার এসেছে। যদিও তাতে গল্পের টানটান উত্তেজনা কমেনি। থিয়েটারে বসে আলোচনার সময় পিছনে একই নাটকের অভিনয় চলার দৃশ্য বেশ অভিনব তাতে সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন: ‘আশিকি ৩’ ছাড়লেন তৃপ্তি দিমরি

তবে অভিযুক্ত ছেলেটির গান শুনতে যাওয়ার এবং পরে গানের লাইন বলতে না পারার যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ কোনও অনুষ্ঠানে শোনা গানের কথা প্রকৃত সঙ্গীত রসিক ছাড়া বাকি দর্শকের মনে থাকার কথা নয়। শতকরা নব্বইজনকে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবে না। মূল গল্পে সিনেমার উল্লেখ বরং অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত ছিল। 

Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei

সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা ভিন্ন ধরনের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেভাবে ঘটনার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এসেছে, সমঝদার দর্শক তা উপভোগ করবেন। চিত্রনাট্য সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে আম জনতা এ হেন গুরুগম্ভীর ছবি দেখতে কতটা পছন্দ করবেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবু এই সময়ে এবং এই সমাজে দাঁড়িয়ে ছবির বিষয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেই সূত্রেই উঠে এসেছে অর্থনৈতিক বৈপরীত্য থেকে ধর্মীয় রেষারেষি এবং লুকিয়ে রাখা পারস্পরিক ঘৃণাও। যা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে প্রায় কেউই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, এড়িয়ে যেতেই ভালোবাসে, সেই সমস্ত অস্বস্তিকর এবং অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন সৃজিত। সেখানে শিশু বয়সে যৌন নিপীড়ন থেকে শুরু করে অস্থির শৈশব সবই এসেছে। এই সমস্ত সাবপ্লটের সংযোজন ছবিকে অন্যভাবে উপস্থাপিত করেছে বলা বাহুল্য। 

Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei

অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজ সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। একাধিক তারকা একই ছবিতে থাকলে সাধারণত কেউ-কেউ চিত্রনাট্যের স্বার্থে একটু অবহেলিত হন। এখানে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে প্রত্যেককে সমান জায়গা দেওয়ার। তবু আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয় পরমব্রতর নাম। নিজের স্বাভাবিক স্বত্বার বাইরে গিয়ে এক রূপান্তরকামীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করলেন তিনি। আগাগোড়া বাহুল্যবর্জিত এবং সংযত অভিনয়ে রীতিমতো অবাক করলেন তিনি বহুদিন বাদে। এছাড়াও ঋত্বিকের উল্লেখ করতেই হয়। অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক ও বিরক্তি উদ্রেককারী চরিত্রে তিনি অসামান্য। এর সঙ্গেই বলা যায় অনির্বাণ, দুই কৌশিক, রাহুল, কাঞ্চন, সুহোত্র, ফাল্গুনী, সৌরসেনী প্রত্যেকের নাম। আসলে কাউকেই বাদ দেওয়ার কোনও জায়গা নেই। সকলেই নিজের চরিত্রে সেরাটুকু দিয়েছেন। 

Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei

ছবির চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা এবং আবহ সবকিছুই যথাযথ। দুটি গান ছবির মেজাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শুনতে ভালো লাগে। রাপূর্ণা ভট্টাচার্যের কন্ঠে ‘তোমার ঘরে বসত করে’ গানটি ছবি শেষের পরেও মনে থেকে যাবে। তবে এই ছবি একান্তই বড়পর্দায় দেখার মতো। মোবাইল ফোন বা টেলিভিশনের পর্দায় ছবির বিষয় বুঝতে সমস্যা না হলেও এই মাপের অভিঘাত হয়তো পাওয়া যাবে না। তাই বাঘা-বাঘা তারকাদের সেরা অভিনয় দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া অবশ্যকর্তব্য। 

Anurag Kashyap

Like
Like Love Haha Wow Sad Angry
31

Swati

Editor of a popular Bengali web-magazine. Writer, travel freak, nature addict, music lover, foody, crazy about hill stations and a dancer by passion. Burns the midnight oil to pen her prose. Also a poetry enthusiast.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *